দেশের সড়কপথের বিভিন্ন জায়গায় ২৬৫ কিলোমিটার এলাকায় সবসময় বিরাজ করে আতঙ্ক। সড়কে এসব স্থান আলাদা আলাদা হলেও কমন ফ্যাক্টর হচ্ছে যাত্রীদের বা গাড়িতে করে যারা চলেন তাদের অথবা পথিকজনের ভয়, আতঙ্ক।

এসব স্থানে প্রায়ই ঘটছে ছিনতাই, ডাকাতি এবং ধর্ষণসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকা-। পাশবিক নির্যাতনের ঘটনার ভুক্তভোগীরা এ ব্যাপারে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে অবহিত করেছে, আশা করেছে প্রতিকার মিলবে। প্রতিকার দূর অস্ত।

এসব স্থানে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হচ্ছে না অজানিত কারণে (অথবা আইনপ্রয়োকারী সংস্থা কারণ জেনেও না জানার ভান করে বলে)। ফলে ধরা যাচ্ছে না অপরাধকারী চক্রকে। আতঙ্কে হলেও এসব স্থানে নিয়মিত পুলিশি টহল থাকে না। এসব স্থানে রাতের অবস্থা আরও ভয়াবহ। যানবাহনে তল্লাশি হয় না বললেই চলে। এর সুযোগ নিচ্ছে অপরাধীরা।

টাঙ্গাইলে চলন্ত বাসে ধর্ষণের পর ডাকাতির ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতে ঢাকার অদূরে গাজীপুরে ঘটেছে বাসের ভেতরে ধর্ষণের ঘটনা। এসব ঘটনায় দেখা দিয়েছে আতঙ্ক।
সড়ক-মহাসড়কের যেসব স্থানে অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে পুলিশের কয়েকটি ইউনিট সেসব স্থানের একটি তালিকা করেছে। তালিকাটি পুলিশ সদর দপ্তরে পাঠানো হয়েছে।


জানা গেছে, মহাসড়কে অপরাধ বেড়ে যাওয়ায় পুলিশ সদর দপ্তর কঠোর হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার সকালে পুলিশের সবকটি ইউনিটের প্রধানদের চিঠি দেওয়া হয়েছে।
চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘মহাসড়কের ঝুঁকিপূর্ণ স্থানগুলোতে নজরদারি বাড়াতে হবে। দিনে-রাতে ২৪ ঘণ্টা পুলিশি টহল থাকতে হবে। টহলের সময় টহল পুলিশ ঘুমাতে পারবে না। যানবাহনে নিয়মিত তল্লাশি করতে হবে। চালক, হেলপার ও যাত্রীদের চেহারা ভিডিওতে ধারণ করে রাখতে হবে।’

যদি পুলিশের কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে এসব কাজে গাফিলতির অভিযোগ পাওয়া যায় তাহলে তার বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়।

সংশ্লিষ্টরা জানায়, দীর্ঘদিন ধরেই মহাসড়কে নানা অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। নানা কৌশল অবলম্বন করছে বটে কিন্তু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা। প্রতিদিন ঘটছে নানা ঘটনা। চলন্ত বাসে ডাকাতির পর নারীদের ওপর পাশবিক নির্যাতনের ঘটনায় জনমনে বেড়ে গেছে উদ্বেগ, দেখা দিয়েছে আতঙ্ক।
টাঙ্গাইল ও গাজীপুরে চলন্ত বাসে ধর্ষণের ঘটনার আলোচনা হচ্ছে বেশি। এ নিয়ে পুলিশও ব্যাপক সমালোচনার মধ্যে পড়েছে। যদিও টাঙ্গাইলের ঘটনায় ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দুই অভিযুক্তকারীকে গ্রেপ্তার করেছে তারা।

চলতি বছরের শুরু থেকে এ পর্যন্ত টাঙ্গাইলের মধুপুর-এলেঙ্গা সড়কে অন্তত ২০টি ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। বনাঞ্চল হওয়ায় ডাকাত দলের সদস্যরা ওই স্থানকে বেছে নিচ্ছে বলে বাসচালকদের অভিমত। ওই এলাকায় পুলিশের টহলও নিয়মিত থাকে না। পুলিশের বক্তব্য ডাকাত দলের সদস্যরা বিভিন্ন বাসস্ট্যান্ড থেকে যাত্রীবেশে বাসে ওঠে। পরে সুযোগমতো তারা বাসের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় এবং অপকর্ম সংঘটিত করে।

সড়কে অপরাধ বেড়ে যাওয়ায় গত বৃহস্পতিবার পুলিশ সদর দপ্তরে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বিশেষ বৈঠক করেছেন। হাইওয়ে পুলিশের প্রধান এবং কয়েকজন ডিআইজিও (রেঞ্জ) আলাদাভাবে বৈঠক করেছেন। যেসব মহাসড়কে অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে তার একটি তালিকা তৈরি করা হয়েছে। তালিকাটি পুলিশ সদর দপ্তরে পাঠানো হয়েছে।

হাইওয়ে পুলিশের প্রধান ও অতিরিক্ত আইজিপি মল্লিক ফকরুল ইসলাম বলেন, ‘প্রতিটি মহাসড়কে পুলিশের টহল বাড়ানো হয়েছে। থানা-পুলিশের পাশাপাশি হাইওয়ে পুলিশও রাস্তায় টহল দিচ্ছে। ৬৫টি স্থানে প্যাট্রোলপার্র্টি যানবাহন দাঁড় করিয়ে তল্লাশির পর ভিডিও করছে। ঝুঁকিপূর্ণ যেসব রাস্তা আছে সেখানে টহল বেশি দেওয়া হচ্ছে। কঠোরভাবে মহাসড়ক মনিটরিং করা হচ্ছে।’

প্রায় একই কথা বলেছেন ঢাকা রেঞ্জের উপমহাপরিদর্শক হাবিবুর রহমান। তিনি বলেছেন, ‘রেঞ্জ এলাকায় যেসব সড়ক আছে সেখানে পুলিশি টহল বাড়ানো হয়েছে। টাঙ্গাইলের ঘটনায় জড়িতদের আইনের আওতায় আনা হয়েছে। রাতের বেলায় টহল পুলিশের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। রাতের বেলায় যানবাহন তল্লাশি করা হচ্ছে। রাতের বেলায় পুলিশ সদস্যদের সতর্কভাবে দায়িত্ব পালন করতে বলা হয়েছে। কেউ দায়িত্ব পালনে অবহেলা করলে তাকে শাস্তির আওতায় আনা হবে।’

সূত্র জানায়, পুলিশের তালিকা অনুযায়ী দেশের সড়ক-মহাসড়কের ২৬৫ কিলোমিটার এলাকায় অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। সাধারণত সন্ধ্যার পর অপরাধীরা স্থানে স্থানে ঘাপটি মেরে থাকে। সুযোগ বুঝে তারা যানবাহন দাঁড় করিয়ে যাত্রীদের ওপর হামলে পড়ে। স্থানগুলো হলো ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মেঘনা ব্রিজের পূর্ব পাশের ১০ কিলোমিটার এলাকা, বগুড়ার সাত রাস্তা থেকে বনানী এলাকা পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার, জামালপুর মহাসড়কের রসুলপুর, কিশোরগঞ্জ মহাসড়কের কানারামপুর, মাজার বাসস্ট্যান্ড, জালুয়ার বাজার, আমতলা, নান্দাইল চৌরাস্তা ও তারের ঘাট, শেরপুর মহাসড়কের গোপালপুর, উদালধর, তারাকান্দা দক্ষিণ, বাইমকান্দি, গোরদাড়, পাইসলা ও বাইপাস, রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ মহাসড়কের রাজাবাড়ি, হরিপুর ও কামারপাড়া, নাটোর মহাসড়কের বানেশ্বর ও ঝলমলিয়া, নওগাঁ মহাসড়কের নওদাপাড়া, নওহাটা, মৌগাছি, কেশরহাট ও সাপাই, বরিশালের কাশিপুর, নথুলাবাদ ও চৌমাটা, কুমিল্লার নিমসার, দাউদকান্দির গৌরীপুর, চান্দিনা ও কালাকুচয়া বাজার, দেবিদ্বারের কংশনগর, সুয়াগাজী, মিয়াবাজার, চৌদ্দগ্রাম, মহিপাল ও নাথেরপটুয়া, ময়মনসিংহ-ঢাকা মহাসড়কের ভালুকার বরাডোবা, ভালুকা, চেলেরঘাট, বাঘামোরা, ত্রিশাল, হৈলরবাজার, কাজীরসিমলা, কানহর ও তুরখাই, টাঙ্গাইল মহাসড়কের মনতলা, সাহেববাজার, ভাপাকিরমোড়, কালীবাড়ি বাজার, চেচুয়াখালী বাজার ও গাবতলী, বাকেরগঞ্জের বোয়ালিয়া, রহমতপুর, জয়শ্রী, লাকুডিয়া বাজার ও মধুপুর-এলেঙ্গা এলাকা। এসব স্থানেই অপরাধীদের তৎপরতা বেশি।

ঘটনাবলি: গত ১৪ জানুয়ারি সোনার তরী পরিবহনে টাঙ্গাইলের এলেঙ্গা থেকে যাত্রীবেশে ওঠে সাত ডাকাত। সাভার আসার পর তারা অস্ত্রের মুখে চালক ও যাত্রীদের জিম্মি করে বাসের নিয়ন্ত্রণ নেয়। তাদের নজর পড়ে বাসে থাকা দুই তরুণীর ওপর। চক্রের সদস্যরা পালাক্রমে তাদের ধর্ষণ করে। তরুণীদের গাজীপুরের চন্দ্রা এলাকায় নামিয়ে দেয় ডাকাতরা। বাস ঘুরিয়ে আবারও চলে যায় টাঙ্গাইলের দিকে।

এরপর মির্জাপুর থেকে একটি তেলবোঝাই ট্রাক ছিনতাই করে। সেটি নিয়ে ডাকাত দলের দুই সদস্য ঢাকার দিকে যায়। বাকি সদস্যরা রাতভর বাস নিয়ে বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে ভোরে মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজের সামনে নেমে যায়। গত মঙ্গলবার রাতে কুষ্টিয়া থেকে আসা ঈগল পরিবহনের এক নারীযাত্রীকে ধর্ষণ করা হয়। লুট করা হয় বাসে থাকা যাত্রীদের মালামাল। গত ১৪ জানুয়ারি থেকে ৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সাভার থানায় দুটি ও তুরাগ, উত্তরা পশ্চিম, টাঙ্গাইল সদর, মির্জাপুর ও আশুলিয়ায় একটি করে সাতটি ডাকাতির মামলা হয়। এসব ঘটনায় মাঠে নামে ডিবি পুলিশ।

২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষা শেষে বগুড়া থেকে ময়মনসিংহ যাওয়ার পথে চলন্ত বাসে রূপা নামে এক নারীকে দল বেঁধে ধর্ষণের পর হত্যা করে বাসের চালক-হেলপার ও তাদের সহযোগীরা। পরে টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলার পঁচিশ মাইল এলাকায় বনের মধ্যে রূপার মরদেহ ফেলে যায় তারা।

২০১৬ সালের ১ এপ্রিল ভোরে গাজীপুরের কালিয়াকৈরের মৌচাকের এক পোশাককর্মী টাঙ্গাইলের ধনবাড়ী বাসস্ট্যান্ড থেকে ‘বিনিময় পরিবহন’-এর একটি বাসে করে কালিয়াকৈরের উদ্দেশে রওনা দেন। বাসে যাত্রী না থাকার সুযোগে কিছুদূর যাওয়ার পর বাসটির সুপারভাইজার বাসের জানালা-দরজা বন্ধ করে দেয়। এরপর গাড়ির চালক হাবিবুর রহমান নয়ন তাকে ভয় দেখিয়ে পেছনের সিটে নিয়ে ধর্ষণ করে। সুপারভাইজার রেজাউল করিম ও হেলপার ভুট্টুও পালাক্রমে ধর্ষণ করে। বাসটি ঢাকা না গিয়ে ময়মনসিংহ রোডের মধুপুরের একটি ফাঁকা জায়গায় মেয়েটিকে নামিয়ে দেয়। ২০১৮ সালের ৩০ আগস্ট রাতে বঙ্গবন্ধু সেতুর পূর্ব থানা বাসস্ট্যান্ডে এক প্রতিবন্ধী নারীকে ধর্ষণ করা হয়।