রিয়াজ উদ্দিন রুবেল, নোয়াখালী প্রতিনিধি: টুং টাং শব্দে কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে ব্যস্ত সময় পার করছেন নোয়াখালী সুবর্ণচর উপজেলার কামাররা। চলছে হাঁপর টানা, পুড়ছে কয়লা, জ্বলছে লোহা। হাতুড়ি পিটিয়ে কামার তৈরি করছেন দা, বটি, ছুরিসহ মাংস কাটার বিভিন্ন সরঞ্জাম।

যদিও করোনা পরিস্থিতিতে বর্তমানে বিক্রিবাট্টা নেই, তাই সারাদিন কঠোর পরিশ্রম করলেও মুখে নেই কোন উচ্ছাস, নেই প্রাণ ভরা হাসি। তারপরও আসন্ন কোরবানির ঈদের কথা মাথায় রেখে নতুন আশায় বুক বেঁধে ব্যস্ত সময় পার করছেন কামার শিল্পীরা। হাতুড়ি আর লোহার টুংটাং শব্দে মুখরিত কামার পাড়াগুলো।ঈদের দিন পর্যন্ত চলবে এমন ব্যস্ততা। তবে কয়লা, লোহাসহ সবকিছুর দাম বেড়ে যাওয়ায় আগের মতো লাভ হয় না।

কিন্তু পূর্ব পুরুষের ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে তারা কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন বলেও জানিয়েছেন অনেকে। প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত পরিশ্রম করছেন কামাররা। প্রতিবছর কোরবানির ঈদে তাদের জিনিসপত্রের কেনা-বেচা বেড়ে যায়। এ থেকে অর্জিত টাকায় সারা বছরের খোরাক জোগাড় করেন। অথচ বছরের বেশিরভাগ সময়ই কামার শিল্পের সঙ্গে জড়িতরা একপ্রকার বেকার সময় কাটান। উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চাপাতি, দা, বটি, চাকু, ছুরি তৈরি এবং পুরোনো অস্ত্র শান দিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন কামররা। দম ফেলারও সময় যেন তারা পাচ্ছেন না।

ঈদ উপলক্ষে লোহার বিভিন্ন সরঞ্জাম তৈরিতে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন কামার শিল্পীরা। ঈদ মৌসুমে কেউ কেউ রাস্তার পাশে খোলা জায়গায় অস্থায়ী দোকান বসিয়ে দা, ছুরি, চাকু বিক্রি করছেন। কোরবানির পর এমন অস্থায়ী দোকানগুলা আর দেখা মিলবে না। চরবাটা খাসেরহাট বাজারে বিপুল মজুমদার নামে এক কামার শিল্পী জানান, আমি ৩০ বছর যাবত এ ব্যবসা করি।

এক সময় আমাদের লোহার তৈরি দা, বটি, চাপাতি, চাকুসহ বিভিন্ন জিনিসপত্রের যে কদর ছিল বর্তমানে তা আর নেই। বিগত দুই বছর করোনার কারণে আমাদের এ ব্যবসা এখন ক্ষতির সম্মূক্ষীণ। আমার দোকানে চারজন কর্মচারি আছে। তাদের মাসিক বেতন ১৫ থেকে ১৬ হাজার টাকা। করোনাকালীন ২ বছর প্রায় সময় দোকান বন্ধ রাখতে হয়েছে। বিগত ২ বছরে প্রায় ১থেকে দেড় লক্ষ টাকার ক্ষতি হয়েছে।

করোনার পূর্বে সকল খরচ বাদ দিয়ে প্রতি বছরে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকার মতো লাভ হতো কিন্তু এখন করোনার কারণে আমাদের এ ব্যবসায় ক্ষতি ছাড়া লাভ নেই। এভাবে চলতে থাকলে আমাদের এ ব্যবসা বন্ধ করে দিতে হবে। তালতলীতে কামার ব্যবসায়ী লোকেশ কর্মকার বলেন, বর্তমানে মেশিনের সাহায্যে আধুনিক যন্ত্রপাতি তৈরি হচ্ছে। ফলে আমাদের তৈরি যন্ত্রপাতি মানুষ তেমন একটা কিনছেন না।

হয়তোবা এক সময় এই পেশাই আর থাকবে না। তবে কোরবানির ঈদের সময় আমরা একটু আশাবাদী হই। আমাদের পূর্বপুরুষরা এই কাজ করে আসছেন তাই আমরা এ পেশা ধরে রেখেছি। সারা বছর তেমন কোনো কাজ না থাকলেও কোরবানির সময় আমাদের তৈরি সরঞ্জামের চাহিদা বেড়ে যায়। একটি দা, বটি ও ছুরি শান দিতে ৫০ থেকে ৮০ টাকা আর তৈরি করতে গেলে মজুরিসহ এক কেজি ওজনের একেকটি দা, বটি, চাপাতি ৮০০ টাকা থেকে ১০০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, এই পেশায় এখনো আমরা যারা আছি তারা খুবই অবহেলিত। বর্তমানে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের দাম বেশি হলেও সে অনুযায়ী আমরা আমাদের তৈরি করা সরঞ্জামের ন্যায্যমূল্য পাই না। এখন আমাদের লোহাও বেশি দামে কিনতে হয়। এই পেশায় থেকে পরিবার পরিজন নিয়ে সংসার চালাতে খুবই কষ্ট হয়। ভবিষৎতে হয়তো এ শিল্প একদিন হারিয়ে যাবে। ক্রেতারা জানান, কয়েক দিন পরেই ঈদ। গরু ও ছাগল জবাই দিতে এবং মাংস কাটতে প্রয়োজন চাকু ও ছুরির। সে কারণে বাজারে এসেছি দা, বটি ও ছুরি কিনতে। তবে গতবছরে এসব জিনিসের যে দাম ছিল তার চেয়ে এবারে দাম খানিকটা বেশি। কামার ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করে বলেন এই মহামারি করোনার সময়ে আমরা কোনো ধরনের সরকারি সহায়তা পায়নি। কেউ আমাদের খোঁজ খবরও নেয়নি। আমরা আমাদের পরিবার নিয়ে খুবই কষ্টে আছি। সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে কামার শিল্পীরা বলেন, সরকার আমাদের এ শিল্প রক্ষায় কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করবে এবং এই করোনা মহামারিতে সহযোগীতায় এগিয়ে আসবে।