প্রতিবেদন টি করেছেন:নিরব কুমার দাস।

নওগাঁ জেলার ঠাকুর মান্দা মন্দির বা শ্রীশ্রী রঘুনাথ জিউ মন্দির হলো বাংলাদেশের নওগাঁ জেলার মান্দা উপজেলায় ঠাকুর মান্দা গ্রামে অবস্থিত একটি রাম মন্দির। এই মন্দিরটি প্রায় তিনশো বছরের পুরনো। মন্দিরের পূর্বদিকে রয়েছে শিব নদী।

মন্দিরের পুরোহিত এর কাছে থেকে জানা যায়,এক সময় মন্দিরের চারদিকে ছিল বিল। একদিন মান্দার বিলে স্নান করতে যান এক দরিদ্র অন্ধ ব্রাহ্মণ। তিনি ছিলেন রামভক্ত । স্নানকালে তিনি রাম, লক্ষ্মণ ও সীতা বিগ্রহ পান। তিনি বিগ্রহগুলোকে কোলে করে নিজের বাড়ি নিয়ে যান। পরে তিনি মন্দির তৈরি করে পুজো অর্চনা শুরু করেন। এতে তিনি তার দৃষ্টিশক্তি ফিরে পান। আর তার দরিদ্রতাও দূর হয়ে যায়। এ কথা লোকমুখে ছড়িয়ে পড়লে নাটোরের রাণী ভবানী ১৭৮০ সালে এই মন্দিরটি বড়ো পরিসরে নির্মাণ করেন।মন্দিরের সেবাইত ছিলেন “মানদাদেবী”। তার নামে এই এলাকার নাম মান্দা‌ হয়েছে । এছাড়া রঘুনাথ নামে মন্দিরের এক পুজারীর কথা শোনা যায় । জাগ্রত মন্দির হওয়ার জন্য মন্দিরের নাম শ্রী শ্রী রঘুনাথ জিউ মন্দির হয়েছে। ২০২০ সালের ৭ সেপ্টেম্বর ভারত সরকারের অর্থে তৈরি মন্দিরের বিশ্রাম ভবনের উদ্বোধন করা হয়।
এই মন্দিরটি খুব জাগ্রত ।এই মন্দিরে মানত করে অনেকের ইচ্ছে পূরণ হয়েছে। অনেকে দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেয়েছে । অনেকের সন্তান লাভ হয়েছে। মানতে অনেক মৃত শিশু প্রাণ ফেরার কথাও শোনা যায়। অনেক মুসলিমও এখানে মানত করে। বাসন্তী পূজার মহানবমীতে মন্দিরে রামচন্দ্রের পূজার মাধ্যমে রাম নবমী উৎসব শুরু হয়।যা ১৫ দিন অবদি চলে ।রাম নবমীতে এখানে ৯ দিনের মেলা বসে। এছাড়া মন্দিরে লক্ষাধিক ভক্ত আসে বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন জায়গা থেকে।
দীর্ঘ ১০ বছর দাম্পত্য জীবনে কোনো সন্তান নেই। মা হওয়ার আশায় বিভিন্ন চিকিৎসা করেও কোনো সন্তান হয় নি। এক বুক আশা নিয়ে সেই ভোর থেকে শাড়ির আচল বিছিয়ে শ্রী শ্রী রঘুনাথ জিউ মন্দিরের সামনে অপেক্ষা করছেন অনেক মা। তারা দেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা থেকে এসেছেন।

নওগাঁর মান্দা উপজেলার ইতিহাস ও ঐতিহ্যের অন্যতম ধারক ঠাকুর মান্দা শ্রী শ্রী রঘুনাথ জিউ মন্দির। প্রায় তিনশো বছরের ঐতিহ্যে বহন করে আসছে মন্দিরটি। বুধবার রাত ৩টা ৪৫ মিনিটে মন্দিরে ভগবান শ্রী রাম চন্দ্রের বিগ্রহে পূজা-অর্চনার মধ্য দিয়ে উৎসবের শুরু হয়। এরপর তীর্থ যাত্রীদের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়।

নয় দিনব্যাপী এ অনুষ্ঠান চলবে আগামী ১৩ এপ্রিল পর্যন্ত। উৎসবের প্রথম দিনে নানা ধর্মের প্রায় লক্ষাধিক মানুষের সমাগম ঘটে।

মান্দা উপজেলা সদর থেকে ১০ কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত ঐতিহাসিক ঠাকুর মান্দা। আত্রাই নদীর অন্যতম শাখা শিব নদী ও বিল মান্দার পশ্চিম তীরে জনপদটির অবস্থান। জনপদটি নওগাঁ-রাজশাহী মহাসড়কের ৫ কিলোমিটার পশ্চিমে এবং নওগাঁ জেলা শহর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত।

জানা যায়, `পুন্ড্র` জনপদের অন্যতম প্রাচীন জনপদ হিসেবে ঠাকুর মান্দার ঐতিহাসিক পরিচিতি রয়েছে। পাল আমলের বিভিন্ন প্রত্ন নিদর্শন এই জনপদ থেকে আবিষ্কৃত হয়। জনপদটিতে রয়েছে হিন্দু তীর্থের প্রাচীন রঘুনাথ জিউ মন্দির। প্রতি বছর রাম নবমী পূজার দিনে জন্মান্ধ শিশুদের আনা হয় এখানে।

হিন্দু সম্প্রদায় ছাড়াও অন্য সম্প্রদায়ের অনেক মানুষ তাদের দৃষ্টি প্রতিবন্ধীসহ নানান রোগের আক্রান্ত সন্তানদের নিয়ে আসেন এই মন্দিরে। ছোট্ট শিশু থেকে নানা বয়সের দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ও নানান রোগের আক্রান্তদের সারা দিন রেখে দেয়া হয় মন্দির প্রাঙ্গণে একটি নির্ধারিত স্থানে।

পুণ্যার্থীরা একসময় মন্দিরের চারপাশের বিল ও শিব নদীতে গঙ্গাস্নান করে ভেজা কাপড়ে বিল থেকে পদ্মপাতা তুলে মাথায় দিয়ে মন্দিরে যেত ঠাকুর দর্শন করতে। ভক্তরা আজো সেই রীতি-নীতি মানতে চান। কেউ কেউ আবার দুর্লভ পদ্মপাতা সংগ্রহ করে তা মাথায় দিয়ে তার ওপর মাটির পাতিল বোঝাই ভোগের মিষ্টান্ন মাথায় নিয়ে দীর্ঘ লাইন ধরে প্রভুর চরণে নিবেদন করেন। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এমনকি ভারত থেকেও আসেন হিন্দু পুণ্যার্থীরা।

অনেকে সপ্তাহব্যাপী মন্দিরের পাশে মাঠে তাবু গেড়েও অবস্থান করেন। ভক্তবৃন্দের ধর্মীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে রাতে পদাবলী কীর্তনেরও আসর বসানো হয়। মন্দিরটিতে দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত রাম নবমীর উৎসব অঞ্চলের বাসিন্দাদের সার্বজনীন উৎসব হয়ে উঠেছে। এ উপলক্ষ্যে মন্দিরটিকে ঘিরে জুড়ে বসেছে গ্রামীন মেলা।

নওগাঁ থেকে এই প্রথম মন্দিরে এসেছেন সুগন্ধা রানী। তিনি বলেন, মনো বাসনা পূরণ করার জন্যই মনে বিশ্বাস নিয়ে মানত করেছি। এখানে মানত করলে ঠাকুর তা পূরণ করেন। স্বামী সংসার ও সন্তান, বাবা-মাসহ সকলে যেন সুস্থ ও ভাল থাকে।

মন্দির কমিটির সভাপতি চন্দন কুমার মৈত্র জানান, প্রায় ২২ বছর ধরে সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। দীর্ঘদিন থেকে মন্দিরে আবাসন সমস্যা প্রকট। হাজারো ভক্ত মন্দিরে মানত করতে এসে উন্মুক্ত আকাশের নিচে রাত্রি যাপন করে। ভারত সরকারের অনুদানে একটি আবাসন তৈরি করা হচ্ছে যা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। মন্দিরে আগত তীর্থ যাত্রীরা যেন নিশ্চিন্তে অবস্থান করতে পারে সেজন্য আবাসন সমস্যা দূর করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।