গল্পটা বিশ্বকে বিস্মিত করে নিজেদের সক্ষমতা জানান দেয়ার, গল্পটা মাথা তুলে দাঁড়াবার। গল্পটা পদ্মা সেতুর। এই গল্প বাংলাদেশের আকাশস্পর্শী অহংকারের। আর তাই প্রমত্তা পদ্মার উপর দিয়ে নির্মিত সেতুটি খুলে দেয়ার আগেই বিশ্বব্যাপী এটি পরিচিতি পেয়েছে বাংলাদেশের ‘মর্যাদা ও সক্ষমতার প্রতীক’ হিসেবে।

অপার সম্ভাবনার বাংলাদেশে সমৃদ্ধ আগামীর যে স্বপ্ন দেখা হয়েছিল একদিন, অনেক বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে সেই স্বপ্ন সত্যি হলো ২৫ জুন শনিবার। লেখা হলো নতুন ইতিহাস। সেই ইতিহাসের নায়ক এ দেশের মানুষ, উদ্বোধনী ভাষণেই উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, বাংলাদেশের মানুষের সমর্থন আর সাহসেই তিনি নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের কঠিন কাজটি সম্ভব করতে পেরেছেন। পদ্মা সেতু সত্যিকার অর্থেই এক স্বপ্ন।

 

সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে গিয়ে অনেক বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের মতো উন্নয়ন সহযোগী সরে যাওয়ার পর বড় ধরনের সমস্যায় পড়তে হয় বাংলাদেশকে। তখন আরো অনেক উন্নয়ন সহযোগী সরে যায়। দুর্নীতির মামলা হয়। সরে যেতে হয় তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রীকে। জেলে যেতে হয়েছিল তৎকালীন যোগাযোগ সচিবকে। দেশের ভেতরে কিছু রাজনৈতিক দলও তোলে দুর্নীতির অভিযোগ। দেশের কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তিও সোচ্চার হন। সে এক ন্যক্কারজনক পরিস্থিতি, জাতি তখন কঠিন অপমানের উপলব্ধিতে নিমজ্জিত এসময় সত্যিকারের বীরের ভুমিকায় অবতীর্ণ হন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সামনে থেকে বুক চিতিয়ে নেতৃত্ব দেয়ার শপথ আঁকড়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন সম্মুখে এবং ঘোষণা দেন নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করা হবে। তখন অনেকেই বলেছিলেন, এই দুঃসাহস দেখানো অর্থহীন। দেশের অর্থনীতি ভেঙে পড়বে। হুমকির মুখে পড়বে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ।

 

কিন্তু প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, আমার দেশের মানুষ সঙ্গে থাকলে অসম্ভবকে সম্ভব করে দেখাবো। বিগত ২৫জুন পদ্মা সেতু উদ্বোধন শেষে মাদারীপুরের শিবচরে আওয়ামী লীগের জনসভায় অংশ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের মানুষের ভালোবাসার প্রতি বিশ্বাস রেখে গর্বের সাথে বলেন, বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুর অর্থায়ন থেকে সরে যাওয়ার পর জনগণের ‘সাহস ও শক্তি’ নিয়েই সেতুর কাজ শুরু করেছিলাম। বলার অপেক্ষা রাখে না, আজকের দিনটির অপেক্ষায় ছিল বাংলাদেশের মানুষ। সেতু উদ্বোধনের পর পদ্মার দুই পারে মানুষের যে উচ্ছাস, যে আবেগের বহিঃপ্রকাশ দেখা গেছে, এককথায় তা অনন্য। পদ্মা-স্বপ্ন পূরণ হওয়ার পর দুই পারের মানুষ এখন নতুন স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে। এ স্বপ্ন এক নতুন দিনের, নতুন শুরুর। সমৃদ্ধির এক নবযাত্রার নতুন ইতিহাস গড়ার স্বপ্ন দেখছে বাংলাদেশের মানুষ। এই যে পুরো দেশ একটি রেখায় যুক্ত হলো, এ আনন্দ ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে। এই আনন্দের রেশ ধরে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। যে সম্ভাবনার কথা বলা হচ্ছে, সেই সম্ভাবনাকে সত্যি করতে হবে। দেশের অর্থনীতিতে নতুন যুগের যে সূচনা হতে যাচ্ছে, সেই যুগযাত্রায় সবাইকে সঙ্গী হতে হবে। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের আগেই চালু হয়েছে ফরিদপুরের ভাঙ্গা মোড় থেকে ঢাকার যাত্রাবাড়ী পর্যন্ত ৫৫ কিলোমিটার এক্সপ্রেসওয়ে। ভাঙ্গা থেকে পদ্মা সেতু পাড়ি দিয়ে ঢাকায় পৌঁছতে এখন সময় লাগবে ৪০/৪৫ মিনিট। বরিশাল, খুলনা এলাকা থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত রাস্তাও বেশ ভাল। ইচ্ছে করলে ভোরে রওনা দিয়ে ঢাকায় কাজ শেষ করে বিকেলে ফিরতে পারবেন দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার মানুষ। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীও এই প্রত্যাশার কথা জানালেন। ভাঙ্গা থেকে বরিশাল হয়ে কুয়াকাটা পর্যন্ত নির্মিত হচ্ছে ২৩০ কিলোমিটার এক্সপ্রেসওয়ে। এটির নির্মাণকাজ শেষ হলে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্র সৈকতে পৌঁছা যাবে মাত্র ৩/৪ ঘণ্টায়।

 

নিজস্ব অর্থে পদ্মা সেতু নির্মাণের ফলে সারা বিশ্বে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা ও ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর একটি সাহসী সিদ্ধান্ত তাকে একজন আত্মবিশ্বাসী, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দিয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি, ধারাবাহিক জিডিপি প্রবৃদ্ধি এবং বিভিন্ন সামাজিক সূচকে বাংলাদেশের অবস্থানের উন্নতি আজ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের সাহসী সিদ্ধান্ত উন্নয়ন সহযোগী ও দেশগুলোর দৃষ্টিভঙ্গিতেও ইতিবাচক পরিবর্তন এনেছে। একটি রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঞ্চলের উন্নয়নের পূর্বশর্ত হলো সেই অঞ্চলগুলোর জন্য একটি উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলা। পদ্মা সেতু শুধু একটি সেতুই নয়, এটি আমাদের উন্নয়ন, অহংকারের প্রতীক। আত্মমর্যাদা, আত্মপরিচয়, যোগ্যতার ফসল। পদ্মা সেতুটি সমাপ্ত হওয়ার সাথে সাথে বাংলাদেশ দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশের সাথে যুক্ত হবে। এই সেতু যোগাযোগ, বাণিজ্য, শিল্প, পর্যটন এবং অন্যান্য অনেক ক্ষেত্রে অবদান রাখবে। বিশেষত এটি ভুটান, ভারত এবং নেপালের সাথে বাণিজ্য ও পর্যটনের জন্য আরও দ্রæত সংযোগ স্থাপনে সহায়তা করবে। পদ্মা সেতু পুরোপুরি চালু হয়ে গেলে বার্ষিক জিডিপিতে এটি প্রায় ১.২ শতাংশ অবদান রাখবে, দারিদ্র্য হ্রাস করবে এবং দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের মানুষের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড বাড়াবে। এটি দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বিনিয়োগের দরজা খুলে দিবে এবং চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরকে সরাসরি বাংলাদেশের প্রধানতম স্থলবন্দর বেনাপোলের সাথে সংযুক্ত করবে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলটি দেশের প্রায় ২৭ শতাংশ জুড়ে এবং এ অঞ্চলে বাংলাদেশের ১৬৫ মিলিয়ন জনসংখ্যার প্রায় এক চতুর্থাংশ রয়েছে।

লেখকঃ সাজ্জাদ আলম খান সজল
সাংবাদিক, কলামিস্ট