দূর আলো জ্বললেও খুপড়ি ঘরটির সামনে অন্ধকার নেমেছে। দরজায় কড়া নেড়ে তিশা জিজ্ঞাসা করেন—‘আরে ঘর অন্ধকার ক্যান।’ তারপর দরজা ধাক্কা দিয়ে ঘরে প্রবেশ করে লাইট জ্বালিয়ে দেন তিশা।

জিজ্ঞাসা করেন, ‘আরে আইচক্যা এত তাড়াতাড়ি ঘুমাই পড়লি? ওই পরী উট, ক্ষুধা লাগছে। চল দুইজন মিলা কিছু খাই।’ পরীর কোনো সাড়া মেলে না। বিছানায় গিয়ে পরীকে ধাক্কা দেওয়ার পরও সাড়া মেলে না। পরীকে টেনে সোজা করতেই মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে তিশার। কারণ পরী মৃত অবস্থায় পড়ে আছে বিছানায়।

 

গল্পের শুরুটা এভাবেই করেছেন নাট্যকার। বলছি, ঈদুল আজহায় প্রচারিত ‘রিকশা গার্ল’ নাটকের কথা। নাটকটি শুরুর এক মিনিটের মধ্যে দর্শক হতভম্ভ হয়ে পড়েন, আটকে যান গল্পে। কারণ একটি মেয়ে কেন মারা গেলো? এই প্রশ্নটি যেকোনো দর্শকের মনেই জন্ম নেবে এটাই স্বাভাবিক।

এটাকে নাট্যকার আহমেদ তাওকীরের মুন্সিয়ানা বলা যায়। এই নাটকীয় উপস্থাপন নাটকটির বাকি গল্প জানার গভীর আগ্রহ তৈরি করেছে। যদিও পরের দৃশ্য থেকে নাটকের মূল গল্পে প্রবেশ করেছেন নির্মাতা রাফাত মজুমদার রিংকু।

 

নাটকটির মূল গল্প হলো—শহরের একটি বস্তিতে ছোট বোন পরীকে নিয়ে সংসার শিখার। সংসারের ভার বহন করতে রিকশা চালানো পেশা হিসেবে বেছে নেয় সে। প্রতিদিন বোনকে স্কুলে নামিয়ে শিখা রিকশা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। শিখার রিকশা চালানোর পেছনে লুকিয়ে আছে ‘রেজাউল’ নামে অন্য এক যুবকেরও গল্প।

এ যুবকের সঙ্গে ঘর বেঁধেছিল শিখা। এক সময় রিকশা চালক রেজাউল লাপাত্তা হয়ে যায়। কিন্তু প্রতিনিয়ত তার স্মৃতি তাড়িয়ে বেড়ায়; অপেক্ষায় দিন গুণে শিখা। সংগ্রাম করে বোনকে নিয়ে জীবন চালাতে থাকে। এ যেন এক অন্য জীবন। কারণ পুরুষের লালসার দৃষ্টি তাকে প্রতিটি মুহূর্তে খাবলে খায়।

 

গল্পের শেষ দিকে মারা যায় পরী; এক চিরকুট মারফত শিখা জানতে রেজাউল পরীকে ধর্ষণ করেছিল। মূলত এ কারণে নিরুদ্দেশ রেজাউল। এ ঘটনা জানার পর শিখার বিশ্বাস, হৃদয়ে যত্নে গড়া ভালোবাসার ঘর ভেঙে তছনছ হয়ে যায়। শিখা তবু বেঁচে থাকে; জীবনের তাগিদে।

গল্পের রিকশা চালক শিখা আমাদের সমাজের একটি বাস্তব চরিত্র। বুকের ভেতর এক সাগর কষ্ট পুষে জীবন সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া অসংখ্য নারীর প্রতিচ্ছ্ববি ভেসে উঠেছে তার চোখে-মুখে। আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় নারীরা প্রতিটি মুহূর্তে কতটা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগেন তারই প্রতিনিধিত্ব করেছে শিখা; যা গল্পকার স্বল্প সময়ে দর্শককে বলেছেন।

 

ঘরের মানুষের কাছে নারীরা নির্যাতনের শিকার হন, তা আরেকবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন নাট্যকার। আর এইসব বাস্তবতা নির্মাতা রিংকু দারুণভাবে পর্দায় উপস্থাপন করেছেন। যে শিখাকে নিয়ে এত কথা সেই শিখা চরিত্রটি রূপায়ন করেছেন হালের ব্যস্ততম অভিনেত্রী তানজিন তিশা। ছিমছাম গড়নের রিকশা চালক তিশার সাজসজ্জা তাকে আরো বেশি বাস্তবসম্মত করেছে।

গল্পের শুরুতে ক্যামেরার সামনে তিশার এন্ট্রি দারুণ সাবলীল। নাটকটির ব্যাপ্তিকাল ৪১ মিনিট ২৩ সেকেন্ড। পুরো সময়টাতে তিশা তার চরিত্রে মিশে ছিলেন। কখনো মনে হয়নি এটি কেবলই অভিনয়। বরং তার অভিব্যক্তি দর্শককে দারুণভাবে গল্পে টেনেছে। তার আনন্দ, বেদনায় দর্শকও আনন্দিত, ব্যথিত হয়েছেন।

 

দর্শক হিসেবে অন্তত আমার তেমনটাই মনে হয়েছে। যদিও তিশার কাছে দর্শকের এমনটাই প্রত্যাশা। কারণ এর আগেও তিশা নিজেকে প্রমাণ করেছেন; যার ব্যত্যয় এই নাটকেও ঘটেনি। তাই তিশার জন্য করতালি! গল্পের অন্যতম প্রধান চরিত্র রেজাউল। এ চরিত্রে অভিনয় করেছেন সোহেল মণ্ডল।

পর্দায় তার উপস্থিতি তুলনামূলক কম। কিন্তু স্বল্প সময়ের উপস্থিতি সোহেল মণ্ডলের প্রতি দর্শকের ঘৃণা জন্মেছে। এটাই তার স্বার্থকতা। আর আমাদের প্রাপ্তি নির্মল একটি গল্প, যে গল্প রূঢ় বাস্তবতার দরজায় কষাঘাত করেছে। সময়ের সঙ্গে এই কষাঘাত চলতে থাকুক; যতদিন না সময় থমকে দাঁড়ায়।