বোয়ালমারী (ফরিদপুর) প্রতিনিধি: ফরিদপুরের বোয়ালমারী পৌরসভার কলেজ রোডস্থ গণকবরকে পেছনে ফেলে নির্মাণাধীন বহুতল ভবনের কাজ প্রশাসনের হস্তক্ষেপে দুই মাস বন্ধ থাকার পর আবার শুরু হয়েছে। প্রশাসনের নিষেধ অমান্য করে কাজ চলমান রাখায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন স্থানীয় বীরমুক্তিযোদ্ধারা। প্রশাসনের ঢিলেঢালা ভাবের কারণে ব্যক্তিগত উদ্যোগে স্থাপনা নির্মাণের কাজ চলমান থাকার ফলে মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে শহীদদের বীরত্বগাথার শেষ স্মৃতিচিহ্নও আজ হুমকির মুখে।
জানা যায়, ৭১এ স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন পাকিস্তানি ও তাদের দোসর রাজাকার আল বদর বাহিনী ছাত্রনেতা রেজাউলসহ শতাধিক মুক্তিকামী বাঙালিকে হত্যা করে সরকারি কলেজ সংলগ্ন ছনের ক্ষেতে মাটি চাপা দিয়ে রাখে। মূল বধ্যভূমির উপর মালিকানা শর্তে বসতবাড়ি নির্মানের সময় শহীদদের কঙ্কাল উঠে এলে বসতবাড়ির পাশেই তা পুনরায় সমাধিস্থ করেন স্থানীয় বীরমুক্তিযোদ্ধাগণ। পরবর্তীতে সেখানে আওয়ামীলীগের প্রেসিডিয়াম মেম্বার, সাবেক সংসদ সদস্য মো. আব্দুর রহমানের উদ্যোগে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়।
স্থানীয় প্রশাসন ২০২০ সালে পৌরসভার শিবপুর মৌজার ১২২৭ দাগের ৪৭ শতাংশ জমি অধিগ্রহণ করে গণকবরটি সংরক্ষণ ও স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের জন্য প্রস্তাবনা পাঠানো হয় জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে। যাতে স্মৃতিস্তম্ভ, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণে জাদুঘর ও সাংস্কৃতিক চর্চাকেন্দ্র স্থাপন করা যায়। কিন্তু দুই বছর আগে প্রস্তাবনা পাঠানো হলেও তা এখনও বাস্তবায়ন হয়নি।
গণকবরটি যে জায়গায় অবস্থিত সেই স্থানের জমির মালিকানা ছিল সরকারি কলেজের জীববিজ্ঞান বিভাগের ডেমোনেস্ট্রেটর মানিক শীলের নামে। পরে ওই জমির হাত বদল হয়। ব্যক্তিমালিকানাধীন সম্পত্তিতে হওয়ায় সরু একটি সড়ক ও সামান্য কিছু জায়গা ছেড়ে দিয়ে সম্প্রতি জমিটির মালিক উপজেলার রূপাপাত ইউনিয়নের কাটাগড় গ্রামের মো. খালিদ হাসান বহুতল ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে। এতে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের গুরুপূর্ণ উপাদান মুছে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন অনেকই।
বোয়ালমারী প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি ও সাপ্তাহিক চন্দনা সম্পাদক, কবি কাজী হাসান ফিরোজ বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের বোয়ালমারীতে যে গণহত্যার ঘটনা ঘটেছিল, তার প্রমাণ কলেজরোডস্থ এই গণকবর বা বধ্যভূমি। যা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসেরও গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। পরবর্তী প্রজন্মের জন্য মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানতে এ গণকবরটি সংরক্ষণ অত্যন্ত জরুরি। ইতোপূর্বে মূল গণকবরের উপর বসতবাড়ি, গণকবর ঘেঁষে শৌচাগার নির্মাণ করা হয়েছে, যা লজ্জাজনক। বাড়ি নির্মানের সময় খননকাজে উঠে আসা শহীদদের হাড় কঙ্কাল পুনরায় মুক্তিযোদ্ধারা সমাধিস্থ করে যেখানে গণকবরের স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। বহুতল ভবন নির্মানের ফলে সেটিরও সংকোচন হলে শহীদদের বীরত্বগাথার ইতিহাস মুছে যাবে। এটা সংরক্ষণের জোর দাবি জানাই।
এ ব্যাপারে বোয়ালমারী উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার অধ্যাপক আব্দুর রশীদ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, বধ্যভূমির স্থানে স্মৃতিসৌধ স্থাপনের জন্য পুরো প্লট (৪৭ শতাংশ) অধিগ্রহণ করার জন্য ইউএনও কর্তৃক জেলা প্রশাসকের নিকট প্রস্তাব পাঠানো আছে। কিন্তু সম্প্রতি সেখানে জনৈক ব্যক্তি বহুতল ভবন নির্মাণ করছে। বিষয়টি এসিল্যান্ডকে জানিয়েছি। তিনি কী ব্যবস্থা নিয়েছেন জানি না।
বোয়ালমারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদের প্রশাসক মো. রেজাউল করিম জানান,উপজেলা প্রশাসন থেকে দুই বছর আগে ভূমি অধিগ্রহণের জন্যে প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছিলো। যে প্রকল্পের অধীনে বধ্যভূমিতে স্মৃতিসৌধ স্থাপনের কথা ছিলো, প্রস্তাবনা পাঠানোর পূর্বেই সে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় মন্ত্রণালয় প্রকল্পের অনুমোদন দেননি। তিনি আরো বলেন, উপজেলা প্রশাসনের কোন প্রকল্প অনুমোদন দেয়ার ক্ষমতা নেই।
মন্ত্রণালয় অনুমোদন না দেয়া পর্যন্ত আমরা কোন ব্যক্তি মালিকানাধীন জায়গায় কোন স্থাপনা নির্মাণে বাধা দেয়ার ক্ষমতা উপজেলা প্রশাসনের নেই। ভবিষ্যতের কথা ভেবে আমরা পাকা বাড়ি নির্মাতাকে অনুরোধ করেছি। তিনি আমাদের অনুরোধে নির্মাণ কাজ দুই মাসাধিককাল বন্ধ রেখেছেন। বাড়ি নির্মাতার অভিযোগ- প্রশাসনের কথা রাখতে গিয়ে নির্মাণ সামগ্রির মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় তার অনেক ক্ষতি হয়েছে।
নির্বাহী অফিসার বলেন, প্রকল্প পাস হলে স্থাপনার মালিকগণ স্থাপনা ভেঙে দিতে বাধ্য। প্রকল্প অনুমোদনের পূর্বে আমি বাধা দিলে তিনি আমার বিরুদ্ধে উর্ধতন কর্তৃপক্ষের নিকট অভিযোগ দেয়ার ক্ষমতা রাখেন। তারপরও আমি ব্যক্তিগতভাবে তাকে একাধিকবার বুঝিয়েছি।
দৈনিক কলম কথা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।