পেশায় একজন কাঠ-মিস্ত্রী। অভাবের সংসারে পড়াশোনা বেশি দূর করতে না পারলেও পঞ্চম শ্রেনী পর্যন্ত কলম ধরেছেন। ছোটবেলা থেকেই বড় শিল্পী হয়ার স্বপ্ন দেখতেন। সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি তার। অভাব-অনটন আর দুঃখ-দুদর্শার মধ্যেও সংগীতই তাঁর জীবন। তবে গানকে কখনও পেশা হিসেবে বেঁচে নেননি তিনি। মাঠে-ঘাটে কাজ করতে করতে মনের জানালা খুলে গান গেয়ে উঠেন আপন মনে। কখনওবা পরিচিতজনদের আহব্বানে গান গেয়ে শোনান। বলছিলাম ঠাকুরগাঁ সদরের আকচা ইউনিয়নের বাগপুর এলাকার নাম না জানা শিল্পী উজেন্দ্রনাথ বর্মণের কথা।

গানের প্রবল আগ্রহ থাকলেও দরিদ্র বাবা-মার সংসারে গুরুর কাছে কখনও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেওয়া হয়নি তাঁর। রেডিওতে গান শুনে মুখস্ত করতেন তিনি। ২০০৫ সালে স্থানীয় একটি সংগীত বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এর পর ২০০৮ সালে বাংলাদেশ বেতার ঠাকুরগাঁওয়ে অডিশন দিলে শিল্পী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন তিনি। এরপর নিজ লেখা গানে ও নাটকে বেশ কিছু যাত্রা দলের সঙ্গে অভিনয় ও গান করেছেন। পুরস্কারও পেয়েছেন অনেক। স্থানীয়রা তাঁর গানের প্রশংসা করতেন। এতে করে গানের প্রতি তার আরও বেশি আগ্রহ জন্মায়। পঞ্চম শ্রেনী পাস করার পর সংসারে অভাবের কারণে পড়াশোনার ইতি টানতে হয় উজেন্দ্রনাথ বর্মণকে। বিয়ে করেছেন বছর কয়েক আগে। মা-বাবা, স্ত্রী ও দুই শিশুকন্যাকে নিয়ে নিয়ে চলছে তাঁর জীবনযুদ্ধ। প্রতিদিন গঞ্জ থেকে ১৫ কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে শহরে আসেন কাজ করতে আসেন। সন্ধ্যায় কাজ শেষ বাড়ি ফিরে আবার মাঠে কাজ করেন। প্রতি-শুক্রবার এলাকার শিশুদের বিনাঅর্থে গান শেখান। সহায়-সম্পত্তি বলতে তেমন কিছু নেই এই। শত দুঃখ-কষ্টের মধ্যেও গান তাঁর মুখে লেগেই আছে। গানই তাঁর জীবন।

স্থানীয়রা জানান, উজেন্দ্রনাথের গানের গলায় তারা মুগ্ধ। মানুষেরা তাঁর দেখা পেলেই আবদার করে বসেন গান শোনানোর জন্য। উজেন্দ্রনাথ ও কাউকে কখনও নিরাস করেন না। গান গেয়ে খুশি করেন মানুষকে। তবে গান গেয়ে নিজের আত্মার তৃপ্তি মেটালেও এই মানুষটির জীবন ঘেরা দুঃখ-গাঁথায়।

উজেন্দ্রনাথ বর্মণ বলেন, লেখাপড়া বেশি দূর করতে পারিনি। তবে স্কুলে পড়া মুখস্ত করার চেয়ে গান মুখস্ত করার প্রতিই আমার বেশি আগ্রহ ছিল। তখন সবাই আমার গানের গলার প্রশংসা করতো। তাদের প্রশংসা আমাকে আরও বেশি অনুপ্রাণিত করতো। ইচ্ছে ছিল বড় শিল্পী হবো। কিন্তু দরিদ্র বাবা-মার সংসারে অভাবের কারণে পঞ্চম শ্রেনীর পর পড়ালেখা ছেড়ে দিতে হয়। এরপরই মূলত আমার ইচ্ছের মৃত্যু হয়। তবে সংসার জীবনের শত অভাব-অনটনের মধ্যেও আত্মার খোরাক গানকে কখনও ছেড়ে দেয়নি। গানকে পেশা হিসেবে বেছে নিতে না পারলেও গান আমার জীবনের অংশ হয়ে গেছে। কবি মমেন সিংহ ২০১৪ সালে পুরাতন ঠাকুরগাঁয়ে বলদা পুকুর সংগীত বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন সেখানে আমি বিনা পারিশ্রমিকে বাচ্চাদের কবিতা ও গান শেখায়। আমার লেখা গান, কবিতা অনেক পুরস্কার পেয়েছে। এলাকার অনেক বাচ্চা আমার বাড়িতে আসে গান শেখার জন্য। তাদেরকে বিনা পারিশ্রমিকে গান শেখায় কারণ আমার লক্ষ্য একটাই সংগীত যেন সুস্থ্য সংগীত চর্চায় মানুষ থাকে।

কবি মোমেন সিংহ জানান, উজেন্দ্রনাথ বর্মন পেশায় একজন কাঠ-মিস্ত্রী। অভাব-অনটনের মধ্যেও গান চর্চা করে যাচ্ছেন। নিজ অর্থায়নে বলদা পুকুর সংগীত বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর তিনি গ্রাম ঘুরে ঘুরে বাচ্চাদের স্কুলে এসে সংগীত শেখান। এতে তিনি কোন টাকা নেন না। তিনি গান লিখেন, কবিতা লিখেন আবার বই হিসেবে প্রকাশ করেন। তিনি যাতে অর্থনীতিক দু্রবস্থা থেকেও সংগীত নিয়ে অনেক দূর যেতে পারেন।