সফররত ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বিএনপির সাক্ষাৎ না হওয়ায় নানা আলোচনা ছড়িয়েছে রাজনীতিতে। বলা হচ্ছে, সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি সাক্ষাতের সুযোগ পেলেও বিএনপির না পাওয়ার ঘটনা বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ রাজপথের বিরোধী দল বলে পরিচিত বিএনপি এ দেশের রাজনীতিতে এখনো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তবে দলটির নেতারা বলছেন, ‘তাঁরা দলগতভাবে নিজেরা আগ্রহী হয়ে মোদির কাছে সময় চাননি। তাই সাক্ষাৎও হয়নি।’

জানতে চাইলে বিএনপির ফরেন অ্যাফেয়ার্স কমিটির চেয়ারম্যান আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী কালের কণ্ঠকে কৌশলী জবাব দেন। তিনি বলেন, ‘এতটুকু জানি বিএনপির সঙ্গে সফররত ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর কোনো সাক্ষাত্সূচি নেই।’ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘জাতীয় পার্টি বা ১৪ দল তো বিরোধী দল নয়। তারা সরকারি দলের অংশ। সরকারই ওই সাক্ষাতের ব্যবস্থা করেছে। এখানে আমাদের বলার কী আছে!’
তবে ফরেন অ্যাফেয়ার্স কমিটির প্রভাবশালী সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু কালের কণ্ঠকে বেশ স্পষ্ট করেই বলেন, ‘আমরা তো সাক্ষাতের বিষয়ে আগ্রহ দেখাইনি। আমাদেরকে নানা কর্নার থেকে বলা হয়েছে যে আমরা চাইলে সফররত প্রধানমন্ত্রী সাক্ষাৎ দেবেন। কিন্তু আমরা চাইব কেন? লেজ কেটে দিলে তো সাক্ষাৎ পাওয়াই যেত।’ ‘তা ছাড়া সফররত প্রধানমন্ত্রী মোদির আইটেনারিতে (সফরসূচি) বিএনপির সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ রাখা হয়নি। তাই এর বাইরে গিয়ে দেখা করাটা আমরা যুক্তিযুক্ত মনে করিনি’ বলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির এই সদস্য।

ফরেন অ্যাফেয়ার্স কমিটির আরেক সদস্য ড. আসাদুজ্জামান রিপন কালের কণ্ঠকে জানান, ‘যেহেতু সাক্ষাতের ব্যাপারে বিএনপি অফিশিয়ালি আগ্রহ দেখায়নি, সেহেতু মোদির সফরসূচিতে বিএনপির থাকারও কারণ নেই।’ ‘তা ছাড়া করোনায় আক্রান্ত হয়ে প্রতিদিন ৩৩-৩৪ জন করে মানুষ মারা যাচ্ছে। এ জন্য বিএনপি সুবর্ণ জয়ন্তীর সব কর্মসূচি স্থগিত করেছে। তাই স্বাস্থ্যগত কারণেও বিষয়টির ওপর জোর দেওয়া হয়নি’ বলেন বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির এই বিশেষ সম্পাদক।

প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক নিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে আলোচনা আছে দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে। তবে বিএনপির পক্ষ থেকে দেশটির সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের সব চেষ্টা সত্ত্বেও সম্পর্কের দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি হয়নি বলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন। তাঁদের মতে, বর্তমান শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারকে অসন্তুষ্ট করে ভারতীয় কূটনীতিকরা এখনি বিএনপির সঙ্গে সম্পর্ক স্পষ্ট করতে রাজি হচ্ছে না।
স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উপলক্ষে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এখন বাংলাদেশ সফরে রয়েছেন। কিন্তু এবারে বিএনপির সঙ্গে সাক্ষাতের কথা উল্লেখ নেই মোদির সফরসূচিতে। অন্যদিকে সূচিতে না থাকা সত্ত্বেও গতকাল দুপুরে সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি মোদির সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ পেয়েছে।

ফলে বিএনপির সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের বিষয়টি নতুন করে সামনে এসেছে। বলা হচ্ছে, বিএনপি ও ভারতের মধ্যে সম্পর্কের প্রণিধানযোগ্য অগ্রগতি হয়নি।

২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপির সাধারণ সম্পাদক রাম মাধবের সঙ্গে ব্যাংককে সাক্ষাতের চেষ্টা করেও সফল হয়নি বিএনপি। নির্বাচনের আগের দিন ভারতীয় একটি গণমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরই এমন তথ্য প্রকাশ করে ওই সময় বলেন, ‘আমরা ভারতের নেতৃত্বের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করেছি। আমাদের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ২০১২ সালে দিল্লি সফর করেছেন। ২০১৪ সালে বিজেপি ক্ষমতায় এলে বিষয়গুলোর পরিবর্তন ঘটবে বলে আমরা আশা করেছিলাম। মোদির সঙ্গে ওনার খুব ভালো সাক্ষাৎও হয়েছিল। কিন্তু তারপর আর কিছুই হলো না।’

প্রথম দফা প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ২০১৫ সালের জুনে ঢাকা সফরে এলে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ওই সময় নানা অনিশ্চয়তা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত মোদির সফরসূচিতে বিএনপির সাক্ষাতের কথা ছিল। কিন্তু এবারে নেই। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে দলটির প্রভাবশালী একজন নেতা কালের কণ্ঠকে জানান, সাক্ষাতের চেষ্টা করলে তাঁরা সফল হতেন। কিন্তু মোদি প্রশ্নে দেশের মানুষের মধ্যে বিরাজমান ‘অনুভূতি’র কথা চিন্তা করে তাঁরা সেটি করেননি।

আবার ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মোদি নিজে ইচ্ছা করলেও বিএনপির সঙ্গে সাক্ষাৎ হতো। কিন্তু সেটি না হওয়ায় বিএনপি প্রশ্নে ভারতের অবস্থান অস্পষ্টই রয়ে গেল বলে বিএনপির একাংশ মনে করেন। কূটনৈতিক বিষয়ে খবর রাখেন—দলটির এমন একজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘২০১৬ সালের অক্টোবরে চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিনপিংয়ের ইচ্ছায় বিএনপির সঙ্গে তাঁর বৈঠক হয়। সরকার পক্ষ থেকে ওই বৈঠক ঠেকানো যায়নি। এবারেও মোদি চাইলেই বৈঠক হতো। কিন্তু তিনি চাননি এটাই বাস্তবতা।’

স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর অনুষ্ঠান উপলক্ষে মোদির সফরের বিরোধিতা করে দেশের বাম ও ডানপন্থী ইসলামী কিছু দল কর্মসূচি পালন করলেও বিএনপি কৌশলগত কারণে নীরব রয়েছে। তবে সফরের তাৎপর্য নিয়ে দলটি প্রশ্ন তুলে বলেছে, পশ্চিমবঙ্গে যে নির্বাচন হচ্ছে নরেন্দ্র মোদি তার প্রচারণা চালাতে এসেছেন। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল অভিযোগ করেছেন, ‘সরকার জনগণক বাদ দিয়ে সুবর্ণ জয়ন্তী পালন করছে। শুধুমাত্র বিদেশি মেহমানদের নিয়ে এসে দেখানো হচ্ছে।’

বস্তুত, ২০০১ সালের নির্বাচনে ক্ষমতায় যাওয়ার পর চারদলীয় জোট সরকারের সময় থেকেই ভারতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্কের টানাপড়েন শুরু হয়। পর্যবেক্ষকদের মতে, অনেক চেষ্টা ও তৎপরতা সত্ত্বেও ওই সম্পর্কে আজ পর্যন্ত জোড়া লাগেনি। যদিও ২০১২ সালের অক্টোবর মাসে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়ার ভারত সফরের মধ্য দিয়ে ওই সম্পর্কে কিছুটা বরফ গলতে শুরু করে। কিন্তু তার মাত্র ছয় মাসের মাথায় ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় বাংলাদেশ সফরে এলে তাঁর সঙ্গে নির্ধারিত বৈঠক বাতিল করেন খালেদা জিয়া। সেদিন জামায়াতের ডাকে হরতাল চলছিল। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, ওই বৈঠক বাতিল হওয়ায় রাষ্ট্র হিসেবে ভারত ক্ষুব্ধ হয়। কারণ ভারতের শীর্ষ নেতৃত্বের ওপর বিএনপি আস্থা রাখেনি।