যশোর ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে বর্তমানে ইন্টার্ন চিকিৎসকদের দাপট চলছে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের গাছাড়ার কারণে ইন্টার্নরা যা খুশি তাই করছেন। তারা ইচ্ছেমতো রোগীকে রেফার করছেন, ঘোষণা করছেন মৃত্যুও। যা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ছাড়া পারেন না। অধিকাংশ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বিভিন্ন ক্লিনিক-ডায়াগনোস্টিক সেন্টারে কাজ করেন। হাসপাতালে বিশেষজ্ঞরা শুধু খাতা কলমে রয়েছেন। সবকিছুই করছেন ইন্টার্নরা।
হাসপাতালের রেকর্ড অনুযায়ী গত ২৪ ঘণ্টায় সার্জারি, অর্থপেডিক, মেডিসিন, শিশু, লেবার ও গাইনি ওয়ার্ড থেকে মোট ১৬ জন রোগীকে ঢাকা এবং খুলনায় রেফার করেছেন ইন্টার্ন ডাক্তাররা। এছাড়া, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের দেখা না পেয়ে এ সময় ২০ জন রোগী শহরের বিভিন্ন ক্লিনিকে গিয়ে সেবা নিয়েছেন। যা হাসপাতালের ছাড়পত্র খাতায় পলাতক বলে উল্লেখ করেছেন সেবিকারা।
হাসপাতালের প্রশাসনিক বিভাগ সূত্রে জানা যায়, হাসপাতালটি ২০০৩ সালে একশ’ শয্যা থেকে ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে উন্নীত হয়। এরপর থেকে খুলনা বিভাগের ঝিনাইদহ, মাগুরা, নড়াইল, সাতক্ষীরা, কুষ্টিয়া ও খুলনার একাংশের রোগীরা উন্নত সেবার জন্য এই হাসপাতালে ছুটে আসেন। এ হাসপাতালে প্রতিদিন গড়ে সাড়ে চারশ’ থেকে ছয়শ’ রোগী ভর্তি থাকেন। আউটডোরে আসেন প্রতিদিন সহস্রাধিক রোগী। এই হাসপাতালে স্থায়ী রাজস্ব ও অস্থায়ী রাজস্ব মিলে মোট ৫৬ জন চিকিৎসককে পদায়ন করা হয়। এছাড়া, হাসপাতাল পরিচালনার জন্য মেডিকেল কলেজের ক্লিনিক্যাল বিভাগের অধ্যাপক, সহকারী অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপককে মন্ত্রণালয় থেকে সেবা প্রদানের নির্দেশ রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, তারা শিক্ষার্থীদের ক্লিনিক্যাল ক্লাসের পরে বিশেষ রোগী ছাড়া দেখেন না।
হাসপাতালের একাধিক কর্মচারী ও সেবিকা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা সকালে একবার ওয়ার্ডে রাউন্ডে যান। এরপর আর দেখা পাওয়া যায় না। তারা না থাকায় হাসপাতালে আসা সকল রোগীকে ব্যবস্থাপত্র দিয়ে থাকেন ইন্টার্ন চিকিৎসকরা। তারা বলেন, হাসপাতালে জরুরি অবস্থার কোনো রোগী আসলেও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের দেখা পাওয়া যাচ্ছে না। তখনও ইন্টার্ন চিকিৎসকরাই ভরসা। বর্তমানে হাসপাতালে আগত রোগীরা সঠিক সেবা পাচ্ছেন না। অফিস সময়ের পরে রোগী ভর্তি হলে তাকে পরেরদিন সকাল নয়টা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হচ্ছে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সাক্ষাতের জন্য।
১৪ সেপ্টেম্বর যশোর-বোনাপোল সড়কের নবীবনগরে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হন ঝিকরগাছার রাজাপুর গ্রামের ইকা (৪৫) নামে এক ব্যক্তি। স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করেন। জরুরি বিভাগের ডাক্তার রোগীকে প্রাথমিক ব্যবস্থাপত্র দিয়ে সার্জারি ওয়ার্ডে ভর্তির পরামর্শ দেন। সেখানে দায়িত্বরত ডাক্তার রোগীকে সিটিস্ক্যান করাতে বলেন। ১৫ সেপ্টেম্বর সকালে রোগীর স্বজনরা একটি বেসরকারি হাসপাতাল থেকে সিটিস্ক্যান করে আনার পর কোনো বিশেষজ্ঞ বা কনসালটেন্টের সাথে পরামর্শ না করে কাউসার আহমেদ নামে এক ইন্টার্ন ডাক্তার তাকে ঢাকায় রেফার করেন। এরপর ঢাকার তিনটি হাসপাতালে নিলেও চিকিৎসা নিতে পারেননি তিনি। ওইসব হাসপাতাল থেকে বলা হয় ইকা সুস্থ। তার কোনো সমস্যা নেই।
স্ত্রী খাদিজা বেগম জানান, ডাক্তারের কথামতো ১৫ সেপ্টেম্বর দুপুরে তারা তার স্বামীকে ঢাকায় নিয়ে যান। প্রথমে তাকে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপতালে নেন। কিন্তু সেখানকার ডাক্তাররা রোগীর সিটিস্ক্যান দেখে জানান তার কোনো সমস্যা নেই। তাকে কেনো ঢাকায় রেফার করা হয়েছে যশোর থেকে। রোগীকে বাড়িতে ফিরিয়ে আনতে বলেন। সেখান থেকে তাকে চোখের ডাক্তার দেখানোর পরামর্শ দেন। এরপর ইকাকে জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু সেখানেও তাকে ভর্তি করেননি চিকিৎসকরা। সেখান থেকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ফিরিয়ে দেয়া হয়। সর্বশেষ, তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান স্বজনরা। ঢামেক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাদের জানান, রোগীর অবস্থা খারাপ না। তাকে যশোর থেকে ঢাকায় রেফার করার কোনো যুক্তি ছিল না। রোগীর বর্তমান যে অবস্থা তাকে যশোরেই চিকিৎসা করানো সম্ভব।
ইকার স্ত্রী বলেন, তারা গরিব মানুষ। রোগীর যদি সমস্যা না থাকে তাহলে তাকে কেনো ঢাকায় রেফার করা হলো। ঢাকায় গিয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে ঘুরে তাদের হয়রানির শিকার হতে হয়েছে। ঢাকায় নেয়ার কারণে তাদের খরচ হয়েছে অনেক টাকা। ওই ইন্টার্ন ডাক্তারকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
ইকার ভাগ্নে কাজী শাহেদ আহমেদ জানান, যশোরে ফেরার পর তিনি হাসপাতালের ডাক্তারের বিরুদ্ধে হয়রানি ও ক্ষতিপূরণ দাবি করে লিখিত অভিযোগ করেছেন। কিন্তু আজও পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেয়নি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
ইন্টার্ন ডাক্তার কোনো রোগীকে সরাসরি রেফার করতে পারেন কিনা জানতে চেয়ে কাওসার আহমেদকে ফোন করলে তিনি বক্তব্য দিতে রাজি হননি।
হাসপাতালের সিনিয়র কনসালটেন্ট আব্দুর রহিম মোড়ল জানান, ইন্টার্নরা শিক্ষানবিশ। তারা এখনো শিখছেন। গুরুত্বপূর্ণ কোনো রোগীকে অবশ্যই রেফার করতে হলে কনসালটেন্টকে জানাতে হবে। কোনো ইন্টার্ন ডাক্তার ইচ্ছেমতো রেফার করতে পারেন না।
হাসপাতালের সাবেক তত্ত্বাবধায়ক আবুল কালাম আজাদ লিটু বলেন, তিনি যখন দায়িত্বে ছিলেন তখন কনসালটেন্টের অনুমতি নিয়ে ইন্টার্নরা রোগী রেফার করতেন। যদি এখন সরাসরি করে থাকে তবে তা নিয়মের বাইরে গিয়ে করছেন। এসব অনিয়ম বন্ধ করতে হবে।
হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক আখতারুজ্জামান বলেন, পাস করে ইন্টার্নরা ডাক্তার হয়েছেন। অবশ্যই তাদের রেফার করার নিয়ম রয়েছে। তারা প্রয়োজন মনে করলে রোগীকে রেফার করতে পারেন। এমন নির্দেশনা তাদের লগ বইতে দেয়া আছে।
দৈনিক কলম কথা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।