সম্প্রতি জাতিসংঘে উইঘুর মুসলিম নির্যাতনের বিরুদ্ধে বিতর্ক প্রস্তাবে ভোট দেয়া থেকে বিরত ছিল মুসলিম বিশ্বের অনেক দেশ। বিপক্ষে ভোট দিয়েছে মোট ১৯টি দেশ যাদের মধ্যে বেশিরভাগই মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ।
শুধু এবারই নয়, জাতিসংঘে যতবারই উইঘুর ইস্যুতে গণভোট কিংবা বিস্তৃত আলোচনা হয়েছে ততবারই নীরব ভূমিকায় দেখা গেছে মুসলিম বিশ্বকে। এর কারণ সবারই কমবেশি জানা। তবে নানান কারণে সরাসরি আঙ্গুল তোলার উপায় নেই চীনের বিরুদ্ধে। দ্য গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভিন্নমতাবলম্বী লিও জিয়াওবোকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পাইয়ে দেয়ার জন্য চীন নরওয়ের উপর বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল। তেমনি ১৯৮৯ সালে দ্য স্যাটানিক ভার্সেস বই লেখার অপরাধে সালমান রুশদির উপর মৃত্যুদণ্ড আরোপ করে ইরান। এই সকল বিষয়ে আবার সরব ছিল অনেক মুসলিম দেশ। যাই হোক, উইঘুরে চীনের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ গত এক দশকে উঠেছে তাতে মুসলিম বিশ্বের নীরবতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে সংবাদমাধ্যমে।
বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, একবিংশ শতাব্দীর অন্যতম বড় অপরাধ সংঘটিত হয়েছে জিনজিয়ানের বৃহত্তর মুসলিম অঞ্চলে। সেখানকার মুসলমানদের সংখ্যা কমানোই চীনের কমিউনিস্ট সরকারের মূল উদ্দেশ্য বলে জানিয়েছেন বিবিসি। এমনকি সেখানকার মুসলিম নারীদের বন্ধ্যাকরণ যন্ত্র ব্যবহারেও বাধ্য করছে বলেও অভিযোগ উঠেছে চীনের বিরুদ্ধে। এছাড়াও বিবিসির ওই প্রতিবেদনে জানা গেছে শিশুদের পরিবার থেকে আলাদা করা হচ্ছে যাতে করে তারা ইসলামের শিক্ষা অর্জন করতে না পারে।
এই তথ্যগুলোর সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে। তবে চীন যে উইঘুর মুসলমানদের দমন করছে তার সত্যতা মিলেছে। সাংবাদিকরা এখন ইউক্রেন-রাশিয়া সংকটের সরাসরি ভিডিও করছে, সিরিয়ায় চলমান যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে লাইভ ফুটেজ নিতে পারছে। তবে মুসলমান দমনের সংবাদ সংগ্রহে কোনোভাবেই জিনজিয়ানের আশেপাশেও যেতে পারেন না।
সেখানকার মানুষদের গোটা পৃথিবী থেকে ভিন্ন এক কায়দায় বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছে। এতে করে মানুষ ওই অঞ্চলের বর্বরতা সম্পর্কে স্পষ্টভাবে জানতে পারছে না। তবে জাতিসংঘে চীন বিরোধী দেশগুলো যখনই জাতিসংঘে উইঘুর নিয়ে আলোচনা করে তখনই চুপসে যায় মুসলমানপ্রধান দেশগুলো। এর কারণ কী তা জানা যাক।
যে কারণে মুসলিম দেশগুলো নীরব
২০১৯ সালে জাতিসংঘে চীনের বিরুদ্ধে একটি পশ্চিমা নিন্দা প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়েছিল। এতে উইঘুরে গণহত্যা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠে। যদিও জাতিসংঘে সেবার ভেটো দেয় পাকিস্তান, সৌদি আরব, মিশর, আরব আমিরাত, আলজেরিয়াসহ অনেক মুসলিম প্রধান দেশ। এরপর কেটেছে ২ বছর। ২০২২ সালের শুরুর দিকে পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদে অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কো অপারেশন বা ওআইসির সম্মেলনে একমাত্র ভিন্নমতাবলম্বী দেশের কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান করেন চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই। ৫৭টি মুসলিম দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সঙ্গে তার এই অংশগ্রহণ নতুন এক রূপরেখা অঙ্কন করে। বৈঠক শেষে ওআইসির পক্ষ থেকে কাশ্মীর, ইয়েমেন থেকে সিরিয়া, ফিলিস্তিন থেকে মিয়ানমার প্রায় সকল সংকটাপন্ন মুসলমানদের অবস্থান তুলে ধরে যৌথ বিবৃতি দেয়া হয়। কিন্তু সেখানে উইঘুর মুসলমানদের নিপীড়ন নিয়ে কোনো বিবৃতি দেয়া হয়নি।
এতে করে ফের নিন্দার ঝড় উঠে সারাবিশ্বে। উইঘুরে মুসলমানদের নির্যাতন অস্বীকার করার পেছনে একাধিক কারণ খু্ঁজে পান গবেষকরা। একই ধর্ম, একই বিশ্বাস হওয়ার পরেও দেশগুলোর অর্থনৈতিক অবস্থা কিন্তু একরকম নয়। একবিংশ শতাব্দীতে মুসলিম দেশগুলোতে পশ্চিমাদের চেয়ে চীনের বিনিয়োগ সবথেকে বেশি। বর্তমানে চীনা বিনিয়োগ পৌঁছে গেছে তেল সমৃদ্ধ উপসাগরীয় দেশগুলোতেও। বলা হয়ে থাকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পর দ্বিতীয় অর্থনৈতিক সমৃদ্ধ দেশ চীন। তবে মার্কিনিদের সঙ্গে টক্কর দিতে, এশিয়ায় পশ্চিমা বলয় ভাঙতে চীন বিনিয়োগের মাধ্যমেই তার কূটনীতিক শেকল মজবুত করেছে। আর মুসলমান দেশগুলোর বেশিরভাগই এশিয়া এবং আফ্রিকায় অবস্থিত।
২০১৩ সালে বেইজিংয়ের ঘোষণাকৃত বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ বা বিআরআই গত এক দশকে বিশ্বজুড়ে বেশ পরিচিতি পেয়েছে। যদি খালি চোখে তাকানো যায় তবে দেখা যাবে এটি দুই প্রধান লাইনে এগোচ্ছে। প্রথমটি বিশ্ব বাণিজ্য রুটের গুরুত্বপূর্ণ ক্রসিং পয়েন্ট যেমন- মিসরের সুয়েজ খাল, পাকিস্তানের দোয়াদর বন্দর, মালয়েশিয়া এবং ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে এশিয়া প্যাসিফিক ট্রানজিট! অন্যটি হলো প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর উপসাগরীয় এবং আফ্রিকান দেশগুলো।
ইসলামাবাদের ওআইসি সম্মেলনে চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর উপস্থিতিতে প্রশ্নবিদ্ধ হয় পাকিস্তান। অনুমান করা হয়, চীন সরকারের শর্ত মানতেই এমনটা করা হতে পারে। এবার মুদ্রার অন্য পিঠ উল্টানো যাক, ২০০৫ সাল থেকে ২০২১ সসাল পর্যন্ত পাকিস্তানে প্রায় সাড়ে ৬৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করেছে চীন। এর মধ্যে ৫০ বিলিয়নই ছিল দেশটির অবকাঠামো এবং নির্মাণকাজে।
এবার সৌদি আরবের দিকে তাকানো যাক! তাদের বলা হয় মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্বদানকারী এবং ওআইসির সচিবালয়ের কার্যালয়। সেখানেও চীনের ৪৩ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ রয়েছে। যার মধ্যে ৩৬ বিলিয়ন ডলার শুধুই নির্মাণ কাজে ব্যয় হচ্ছে। তেল সমৃদ্ধ দেশটিও শুধু প্রযুক্তি সক্ষমতা না থাকায় চীনের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখেছে। এরপরেই রয়েছে ইরান! দেশটি মুসলিম প্রধান হলেও বরাবরই মুসলিম বিদ্বেষী দেশগুলোর উপর নানান অবরোধ এবং হুমকিধমকি দিয়ে থাকে। কিন্তু সেখানেও বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ উপহার নিয়ে পৌঁছে গেছে চীন। ইরানে এখন প্রায় ২১ বিলিয়ন ডলারের চীনা বিনিয়োগ রয়েছে। এছাড়াও সংযুক্ত আরব আমিরাতেও বড়সড় আখড়া করে রেখেছে চীনারা। সেখানকার হোটেল-মোটেল, নির্মাণকাজসহ বেশকিছু খাতে চীনা বিনিয়োগ বেড়েছে।
এগুলো ছিল শুধুই উদাহরণ। অর্থনৈতিকভাবে ছোট মুসলমান দেশগুলোও একই কাজ করছে। যদিও এর পেছনে চীনের সঙ্গে আমদানি-রপ্তানি গভীরভাবে জড়িত বলেই এমনটা হচ্ছে। সৌদি আরব সাম্প্রতিক সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা জোটের সাথে তেল উৎপাদন নিয়ে দরকষাকষি করে শেষমেশ মার্কিনিদের নাখোশ করেছেন। অথচ দেশটি উইঘুর ইস্যুতে পুরোপুরি নীরব থেকে মুসলিম বিশ্বের প্রকৃত নেতার পরিচয়টিকেও প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। ইসরাইলি পত্রিকা হারেৎটজের এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, ২০২০ সালের ডিসেম্বর নাগাদ প্রায় ২৫ হাজার মুসলিমকে হত্যা করা হয়েছে জিনজিয়ানে। যদিও এই তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করেনি চীন ভিত্তিক কোনো মাধ্যম। যাই হোক, বিশ্বে যখন মুসলিম দেশগুলো দিন দিন মার খেয়ে যাচ্ছে তখন শুধুই অর্থনৈতিক স্বার্থে চীনের ছায়ায় আশ্রয় নেয়া বোকামি নাকি বুদ্ধিমানের কাজ তা সময় বলে দিবে।
তথ্যসূত্র: বিবিসি, দ্য গার্ডিয়ান
দৈনিক কলম কথা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।