প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে কর্মরত একজন প্রভাবশালী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ক্ষমতা অপব্যবহারের ব্যাপক অভিযোগ পাওয়া গেছে। যিনি মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) থাকাবস্থায় চিহ্নিত দুর্নীতিবাজ ও বিএনপি ঘরানার কর্মকর্তাদের প্রাইজপোস্টিং দেন। এমনকি এসব বদলি বাণিজ্যে ওই কর্মকর্তার পরিবারের ঘনিষ্ঠ লোকজনও জড়িয়ে পড়েন। কৌশল হিসাবে তিনি প্রকাশ্যে অফিস চালাতেন সিএসপি স্টাইলে, কিন্তু নীরবে চলত তদবির বাণিজ্য।
আলোচিত এই কর্মকর্তার নাম মো. আব্দুস সবুর মন্ডল। যিনি বর্তমানে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিবের পরই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদ এপিডি (নিয়োগ, পদোন্নতি ও প্রেষণ) অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব হিসাবে কর্মরত। অথচ চাকরি জীবনের শুরু থেকে তিনি সরকারি দল আওয়ামী ঘরানার কর্মকর্তা হিসাবে পরিচিত। কথায় কথায় ‘আমার শাশুড়ি আওয়ামী লীগের এমপি’ বলে নিজের শক্ত অবস্থান জানান দেওয়ার চেষ্টা করেন। এর ফলে তাকে অন্তত গত ১৪ বছরে পদোন্নতি ও প্রাইজ পোস্টিং নিয়ে কোনো বেগ পেতে হয়নি।
প্রসঙ্গত, অতিরিক্ত সচিব মো. আব্দুস সবুর মন্ডল মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর থেকে বদলি হয়ে এপিডি হিসাবে পোস্টিং পান গত মে মাসের শেষদিকে। তিনি অফিসিয়ালি এ অধিদপ্তর থেকে ১ জুন বিদায় নেন। বিদায় নেওয়ার প্রাক্কালে মাত্র পাঁচ দিনে ২৮ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে তিনি বদলি করেন, যা ছিল খুবই আলোচিত ও বিতর্কিত বদলি। কারণ তাদের অনেকে চিহ্নিত দুর্নীতিবাজ ও বিএনপি-জামায়াত ঘনিষ্ঠ কর্মকর্তা-কর্মচারী। এ ধরনের বদলি অধিদপ্তরের অনেককে হতবাক করে।
সূত্র বলছে, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সবচেয়ে লোভনীয় পোস্টিং হিসাবে পরিচিত ঢাকা মেট্রোর গুলশান সার্কেলে পোস্টিং পান বিএনপি ঘরানার কর্মচারী নাজমুল হোসেন খান। যুগান্তরের মাগুরা প্রতিনিধি জানান, নাজমুল হোসেন খানের পুরো পরিবার বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। তার ছোট চাচা হাসান ইমাম সুজা বর্তমানে মাগুরা জেলা বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক। আরেক চাচা জেলা যুবদলের সাবেক সভাপতি। ১৯৯৯ সালে বিএনপি সরকারের সাবেক মন্ত্রী মির্জা আব্বাসের সুপারিশে তার চাকরি হয়। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এলে নাজমুলকে পাঠানো হয় ঢাকার বাইরে। কিন্তু সবুর মন্ডলের হাত ধরে তিনি এখন ‘মধুর হাঁড়ি’ গুলশানে।
সূত্রমতে ডিএনসির প্রাইজ পোস্টিংয়ের র্যাংকিংয়ে গুলশানের পরই রমনা সার্কেল। ইন্সপেক্টর তমিজউদ্দীন মৃধাকে রমনায় পোস্টিং করা হয়েছে। তার বাড়ি পাবনা। অধিদপ্তরের সবাই জানেন তমিজ উদ্দিন বিএনপি ঘরানার লোক। সাবেক জোট সরকারের সময় তিনি প্রভাবশালী ছিলেন। কিন্তু হঠাৎ করে এ কর্মচারীর রমনায় পোস্টিং দেখে বিস্মিত হন অনেকে।
সূত্র জানায়, এসআই মাহবুবুর রহমান (বর্তমানে ভারপ্রাপ্ত ইন্সপেক্টর) মোটা অঙ্কের অর্থ খরচ করে উত্তরা সার্কেলে পোস্টিং নেন। তার বদলিতে মধ্যস্থতা ও ঘুস লেনদেনের মূল ভূমিকায় ছিলেন সিপাহি সাজ্জাদ হোসেন। বর্তমানে তিনি অধিদপ্তরের ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়ের ওয়্যারলেস অপারেটর। সাজ্জাদ নিজেকে সবুর মন্ডলের চাচাতো ভাই বলে পরিচয় দেন। সবুর মন্ডল নারকোটিক্সে যোগ দেওয়ার পরপরই বেপরোয়া হয়ে ওঠেন তিনি।
সূত্র বলছে, ঢাকা মেট্রোর অন্যতম লোভনীয় পোস্টিং কোতোয়ালি সার্কেলে আনা হয় কুড়িগ্রামে সাংবাদিক লাঞ্ছনার ঘটনায় আলোচিত ইন্সপেক্টর জাহিদুর রহমানকে। অথচ নারি কেলেঙ্কারি ও মামলা বাণিজ্যসহ একাধিক অভিযোগে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা চলছে।
এভাবে জামায়াত-বিএনপিপন্থি এবং বিতর্কিতদের প্রাইজ পোস্টিং প্রসঙ্গে জানতে চাইলে নারকোটিক্স এক্সিকিউটিভ অফিসার ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক এবং সবুজবাগ সার্কেলের ইন্সপেক্টর নজরুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, ‘এসব নিয়ে কথা বলার এখতিয়ার তাদের নেই। তবে সবগুলো পোস্টিং অর্ডার এখনো ওয়েবসাইটে পাওয়া যাবে। তাই সরকার বা গোয়েন্দা সংস্থা চাইলে বিষয়টি খোঁজ নিয়ে দেখতে পারে।’
সূত্র বলছে, বিতর্কিত পোস্টিং ছাড়াও সবুর মন্ডলের আমলে সোর্সমানি লোপাটের অভিযোগ আছে। এক্ষেত্রে অভিনব কৌশল নেওয়া হয়। ঢাকাসহ বিভিন্ন আঞ্চলিক কার্যালয়ের ব্যাংক হিসাবে টাকা পাঠিয়ে নগদে ফেরত আনা হয়। এ নিয়ে মাঠ পর্যায় থেকে ক্ষুব্ধ কর্মকর্তাদের অনেকে বেনামে চিঠি লেখেন। এমনকি তৎকালীন সুরক্ষা সচিব মোকাব্বির হোসেনের কাছেও এ অভিযোগ দেওয়া হয়।
প্রসঙ্গত যুগ্মসচিব থাকাকালে ২০১৯ সালের ২৫ জুলাই আব্দুস সবুর মন্ডলের প্রটোকলের জন্য মাদারীপুরের কাঁঠাবাড়ি ঘাটে ৩ ঘণ্টা ফেরি আটকে রাখা হয়। এতে আটকা পড়ে ঢাকাগামী একটি অ্যাম্বুলেন্সও। এ সময় মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আহত স্কুলছাত্র তিতাস ঘোষের মর্মান্তিক মৃত্যু হলে দেশজুড়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে। প্রশাসনে যা ‘ফেরি কেলেঙ্কারি’ নামে পরিচিত। নিশ্চয় প্রভাবশালী মহলের কারণে তাকে বেগ পেতে হয়নি। না হলে তাকে এ ঘটনায় অনেক খেসারত দিতে হতো। এমনকি পরবর্তী পদোন্নতি ও প্রাইজ পোস্টিং পাওয়া নিয়ে এক ধরনের অলিখিত সংকট হওয়ার আশঙ্কা ছিল। কিন্তু উল্টো তার পদোন্নতির পাশাপাশি বরং প্রাইজ পোস্টিং হয়েছে।
বক্তব্য : বিতর্কিতদের প্রাইজ পোস্টিং এবং নিজের ভাই ও শাশুড়ির তদবির প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আব্দুস সবুর মন্ডল মঙ্গলবার দুপুরে বলেন, ‘তিনি একক সিদ্ধান্তে কোনো পোস্টিং করেননি। প্রতিটি পোস্টিংয়ের আগে সংশ্লিষ্ট সবার মতামত নেওয়া হয়। তবে তার শাশুড়ি একটি পোস্টিংয়ের তদবির করেছিলেন। এটা সত্য। পরে বিষয়টি নিয়ে তিনি তৎকালীন সচিবের সঙ্গে কথা বলে সিদ্ধান্ত নেন।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘তার ভাই পোস্টিং নয়, আউটসোর্সিং নিয়োগের বিষয়ে তদবির করেছিলেন। তার তদবিরে কয়েকজন আউটসোর্সিং জনবল নেওয়া হয়। বাংলাদেশের বাস্তবতায় এটি অপরাধের কিছু নয়। তবে মহাপরিচালক হিসাবে তিনি সর্বোচ্চ সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন। চাকরি জীবনের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত কেউ তার বিরুদ্ধে ন্যূনতম দুর্নীতির অভিযোগ তুলতে পারেনি। পারবেও না।’
তিনি বলেন, ‘মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর একটি দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠান। এজন্য অধিদপ্তরের কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারী বিভিন্ন লিংকে তার ভাইসহ নিকট-আত্মীয়দের কাছে পৌঁছে যায়। এতে বেশকিছু পোস্টিং তদবিরের মুখে পড়তে হয় তাকে।’ কম্প্রিহেনসিভ অ্যাকশন প্ল্যান কর্মসূচির বিষয়ে উত্থাপিত অভিযোগ প্রসঙ্গে সবুর মন্ডল বলেন, ‘এটি একটি উদ্ভাবনী কর্মসূচি। যার মাধ্যমে সমাজের সব স্তরের সম্পৃক্ততায় মাদকের অভিশাপ থেকে মুক্তির চেষ্টা করা হচ্ছে। কর্মসূচি পুরোপুরি বাস্তবায়ন হলে মাদক নির্মূলে বিস্ময়কর সফলতা মিলবে বলে তার বিশ্বাস।’
দৈনিক কলম কথা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।