‘আমার সামান্য কিছু জমি আছে, তাই দিয়ে কোনো রকমে সংসার চালাই। এক ছেলে রাজশাহী ভার্সিটিতে পড়ে, আর এক মেয়ে সেও ভার্সিটিতে চান্স পেয়েছে। ঋণ পরিশোধ এবং ছেলেকে টাকা পাঠানোর জন্য সম্প্রতি গরু বিক্রির একটি স্লিপের জন্য হাবিবুর চেয়ারম্যানের কাছে গিয়েছিলাম, ভোটের সময় তার জন্য কতকী করলাম, আর এখন সে আমাকে নাকি চেনেই না। গরুর সিরিয়াল (বিক্রয় রশিদ) তো দিলেনই না, আবার বলে আমাকে নাকি চিনেই না।’ এ কথা গুলো আক্ষেপ করে বলছিলেন, লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলাধীন দহগ্রাম ইউনিয়নের এক নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা কৃষক সিদ্দিক আলী।
একই ওয়ার্ডের অপর এক বাসিন্দা খোরশেদ আলমের স্ত্রী ফুলবানু আক্ষেপ করে বলেন, ২০ হাজার টাকায় স্লিপ কিনে তারপর বাজারে গরু বিক্রি করেছি। অনেক ঘুরেছি, পাইনি। বাধ্য হয়ে টাকা দিয়ে স্লিপ কিনে নিয়েছি।
তিনি আরও বলেন, সাহায্য সহযোগিতার আশায় ভোট দিয়ে ফরিদুলকে মেম্বার বানিয়াছি। এখন কোনো সহযোগিতা পাই না। তারা টাকা নিচ্ছে, সিরিয়াল দিচ্ছে। গত ঈদে অনেক ঘুরেও সিরিয়াল না পেয়ে অবশেষে ২০ হাজার টাকায় বাধ্য হয়ে স্লিপ কিনে নিয়েছি।
জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে দহগ্রামের সাধারণ কৃষকের এমন অভিযোগ এখন ভূরি ভূরি। চার নম্বর ওয়ার্ডের কয়েকজন কৃষক জানান, কয়েক দিন আগে প্রতিটি স্লিপ ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকায় বিক্রি হলেও বর্তমানে ওই স্লিপের দর উঠেছে ৩০ থেকে ৩২ হাজার টাকা। প্রতি সপ্তাহে দহগ্রাম থেকে করিডোর গেট দিয়ে ৬০টি গরু দেশের মূল ভূখণ্ডে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেয় বিএসএফ। পাটগ্রাম পৌর শহরের গরুর হাট শুরু হয় প্রতি রোববার ও বৃহস্পতিবার। সেই অনুযায়ী দহগ্রাম থেকে প্রতি শনিবার ৩০টি ও বুধবার ৩০টি গরু আসে দহগ্রাম থেকে। এসব গরু একসাথে জড়ো করে বিজিবি বিএসএফর তত্ত্বাবধানে দেশের মূল ভূখণ্ডে করিডোর গেট পার করে দেয়া হয়। তবে গরুগুলো কাগজে কলমে কৃষকের দেখানো হলেও বাস্তবে এসবের অধিকাংশ চোরাই পথে আনা ভারতীয় গরু। সিন্ডিকেট সদস্যরা দহগ্রাম ইউপি চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমান ও ইউপি সদস্যদের সাথে যোগসাজশ করে সাধারণ কৃষকদের বঞ্চিত করে দীর্ঘদিন থেকে এই অবৈধ ব্যবসা করে যাচ্ছে।
স্থানীয় সূত্র জানায়, গত ইউপি নির্বাচনে নির্বাচিত সদস্যদের গলায় সিন্ডিকেট সদস্যরা টাকার মালা পড়িয়েছে। সে সব ছবি ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে। সচেতন মহলের প্রশ্ন-কোন স্বার্থে তারা নির্বাচিত সদস্যদের গলায় টাকার মালা পড়িয়েছে তা দুদকের তদন্ত করে দেখা উচিত। দহগ্রাম থেকে প্রতি সপ্তাহে যেসব গরু আনা হয় তার থেকে প্রতি ইউপি সদস্য চার-পাঁচটি, সংরক্ষিত নারী সদস্য একটি এবং চেয়ারম্যান ছয়-সাতটি ভাগ করে নেন। তবে বিভিন্ন সদস্যের অংশ থেকে প্রতি সপ্তাহে এক-তিনটি গরু বিজিবির সিজার লিস্টে দেখানো হয়। দহগ্রামে এভাবেই চলছে গরুর সিন্ডিকেট বাণিজ্য। বিষয়টি ওপেন সিক্রেট।
জানা গেছে, দহগ্রামে কার ক’টি গরু আছে সেই তালিকা আছে কৃষকের কাছে। পাঁচ বছর পরপর এই তালিকা প্রণয়ন করার কথা, সেই অনুযায়ী আগের যে তালিকা তার মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়েছে। পুলিশ, বিজিবি ও স্থানীয় প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার সমন্বয়ে নতুন তালিকা প্রণয়ন করা হয়েছে। কিন্তু ওই তালিকা অজ্ঞাত কারণে আজও আলোর মুখ দেখেনি।
এ বিষয়ে দহগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদের সচিব আনিসুর রহমান প্রায় একমাস আগে তালিকা সম্পূর্ণ হয়েছে জানিয়ে বলেন, এ ব্যাপারে বিজিবি বলতে পারবে। হালনাগাদ না করে মেয়াদত্তীর্ণ ওই তালিকায় কিভাবে এখনো গরু যাচ্ছে জানতে চাওয়া হলে তিনি কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। এভাবে জনপ্রতিনিধিরা সাধারণ কৃষকদের বঞ্চিত করে প্রতি সপ্তাহে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।
দহগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদের এক নম্বর ওয়ার্ড সদস্য ফরিদুল ইসলাম অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, অনেকে অনেক কথা বলতে পারে। তবে তিনি এ বিষয়ে সাক্ষাতে কথা বলবেন জানিয়ে ফোন কেটে দেন।
দহগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমান আগের তালিকা দিয়ে এখনো গরু যাচ্ছে জানিয়ে বলেন, আপনারা সরেজমিন এসে দেখেন, এর বেশি কিছু বলতে পারব না। কৃষকের রেজিস্ট্রার মেইনটেন করে কাগজ দেয়া হয়। এর বাইরে কারো কাছ থেকে কোনো টাকা-পয়সা নেয়া হয় না বলে তিনি দাবি করেন।
দৈনিক কলম কথা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।