আমরা কি জানি পৃথিবীর প্রথম নির্ভুল মানচিত্র অঙ্কনকারী ও বিশ্বের প্রথম স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের আবিষ্কারক কে ছিলেন? কিংবা গুটিবসন্তের আবিস্কারক, স্ট্যাটিস্টিক এর প্রতিষ্ঠাতা, আলোক বিজ্ঞান, রসায়ন, বীজগণিত ও ত্রিকোণমিতির জনক কে? কেই বা মিল্কিওয়ের গঠন সনাক্ত করেছিলেন? পদার্থ বিজ্ঞানে শূন্যের অবাস্থান কে সনাক্ত করেছিলেন? ফাউন্টেন পেন, উইন্ডমিল, ঘুর্নায়মান হাতল, পিন হোল ক্যামেরা, প্যারাসুট, শ্যাম্পু, ইত্যাদি জিনিস বা বস্তু কারা আবিস্কার করেছিলেন? এই প্রতিটি জিনিস বা বস্তুর আবিষ্কারক, গবেষক, উদ্ভাবক ছিলেন মুসলিম বিজ্ঞানীরা। যা আমরা খুব কম মানুষই জানি।

বর্তমানে যে মুসলিমরা জ্ঞান, বিজ্ঞান, আবিস্কার সহ বিভিন্ন দিক দিয়ে পিছিয়ে পড়েছে তা অস্বীকার করার কোনো উপায়ই নেই। এটা নিয়ে অনেক মুসলিম শিশু, কিশোর বা সাধারণ মুসলিমরাই হীনমন্যতায় ভোগে। তারা দেখে সকল বিজ্ঞানীরাই ইহুদি, খৃষ্টান বা অমুসলিম। তাদের মনে প্রশ্ন জাগে কেন মুসলমানদের মধ্যে কোনো বিজ্ঞানী নেই? মুুুসলমানরা কি এসকল বিষয়ে তেমন পারদর্শী নয়?
 
এই পরিস্থিতির জন্য অনেকগুলো কারণই দায়ী-
মুসলিম বিজ্ঞানী নেই! মুসলিমদের উদ্ভাবনী মেধা নেই! মানব সভ্যতার সকল বড় বড় আবিস্কার করেছেন অমুসলিম বিজ্ঞানীরা এই তত্ত্ব কে আমাদের দিয়েছে? বিজ্ঞানী হিসেবে গ্যালারিও, আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল, লুইস পাস্তুর, আলফ্রেড নোবেলদের কথা জানলেও; জাবির ইবনে হাইয়ান, আল কিন্দি, আল খাওয়ারিজমি, আল ফরগানি, আল রাজী, ইবনে সিনা, আল ফারাবী, ওমর খৈয়াম’দের কথা আমরা কয় জনই বা জানি? কেন এমনটা হল?
এর কয়েকটি কারণ হলো :
১. ক্রুসেডারদের সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্রের অংশ হিশেবে ইসলামি স্বর্ণযুগ আড়াল করা বা মুসলিম বিজ্ঞানীদের পরিচয় লুকানো এবং তাদের পরিচয় নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করার ঘৃণ্য প্রচেষ্টা।
২. মুসলমানদের সরলতার সুযোগ নিয়ে অমুসলিমদের চাপিয়ে দেওয়া শিক্ষা ব্যবস্থার বিকৃত তত্ত্বগুলো মেনে নেওয়া; মুসলমানদের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস, মুসলিম বিজ্ঞানী এবং তাদের আবিস্কারগুলো কৌশলে পাঠ্যক্রম থেকে বাদ দেওয়া।
৩. বর্তমানে আমাদের এ বিষয়গুলো জানার ইচ্ছা থেকে পড়ালেখা না করা।৭৫০ থেকে ১২৫৮ সাল পর্যন্ত সময়টা ইসলামের স্বর্ণযুগ বা ইসলামিক রেনেসাঁ হিসেবে পরিচিত। এই সময় মুসলিম সভ্যতা জ্ঞান-বিজ্ঞান, আবিস্কার, রাজনীতি, বাণিজ্য, ভূখণ্ড, দর্শন সব দিক থেকে স্বর্ণ শিখরে আরোহণ করে। এবং সেই সময় এই মুসলিম সভ্যতার সাথে অন্য কোন সভ্যতার তুলনাই ছিলনা। এই সম্পর্কে ঐতিহাসিক জ্যাক লিখেছেন, “ইসলাম তার ক্ষমতা, শিক্ষা ও শ্রেষ্ঠতর সভ্যতার জোরে বিশ্বে পাঁচ শত বছর আদিপত্য করেছে।” 

কিন্তু ক্রুসেডারদের পরবর্তী প্রজন্ম মুসলিমদের এই গৌরবউজ্জ্বল অর্জন ও ইতিহাস বিকৃত করার জন্য অত্যন্ত সুচিন্তিত ভাবে নানা প্রচেষ্টা চালায়। তারা তাদের দুরভিসন্ধি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে এই সময়টাকে অর্থাৎ মধ্যযুগকে অন্ধকার এবং বর্বর যুগ হিসেবে চিহ্নিত করতে চেয়েছে। কিন্তু সত্য ইতিহাস কখনো মুছে ফেলা যায় না। হ্যাঁ, মধ্য যুগ অন্ধকারাছন্ন এবং বর্বর ছিল তবে সেটা মুসলিম সভ্যতা নয়। বরং তখন গোটা ইউরোপই অন্ধকার এবং কুসংস্কারাছন্ন ছিল।

অবাক করা বিষয় হচ্ছে, পশ্চিমারা স্বর্ণযুগের মুসলিম বিজ্ঞানীদের নানান বই ল্যাটিন ভাষায় অনুবাদ করতে গিয়ে অত্যন্ত অদ্ভুত এবং ঘৃণিত এক কাজ করে বসে। তারা ইতেহাসে প্রথম বারের মত অনুবাদের পাশাপাশি মুসলিম বিজ্ঞানীদের নাম পর্যন্ত পরিবর্তন করে ফেলে, যেটাকে তারা বলে ল্যাটিন ভাষায় নাম অনুবাদ। আচ্ছা নাম কি কখনো অনুবাদ করা যায়! বা নাম কি অনুবাদ করার মত কোন জিনিস!? তারা মুসলিম বিজ্ঞানীদের এমন এমন নাম দেয় যা শুনে বুঝার উপায় নেই যে উনারা আসলে মুসলিম।

মুসলিম লেখক ও বিজ্ঞানীদের নাম বেশ বড়সড় হলেও, ল্যাটিন ভাষায় তাদের নাম দেওয়া হয়েছে একটি মাত্র শব্দে। যেমন- ইবনে সিনার পুরো নাম আবু আলী আল-হুসাইন ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে সিনা হলেও পরিবর্তন করে তার নাম দেওয়া হয়েছে আভিসিনা(Avicenna), বীজগণিতের জনক আল খাওয়ারিজমির নাম দেওয়া হয়েছে এলগোরিজম(Algorism), প্রথম মানচিত্র অঙ্কনকারী আল-ইদ্রিসের নাম দেওয়া হয়েছে দ্রেসেস(Dresses)। শুধু এই কয়েকজনের নাম নয় বরং সকল মুসলিম বিজ্ঞানীদের প্রতিই তারা এই অবিচার করেছে।

তাদের দেওয়া এই নামগুলা যখন কোন শিক্ষার্থী বা যে কেউ প্রথম বার শুনবে, তারা কখনো চিন্তাও করবেনা যে উনারা আসলে মুসলিম। নাম শুনে উনাদেরকে অমুসলিম হিশেবে ভেবে নিবে। মানে ব্যাপারটা একবার ভেবে দেখেছেন, কত গভীর আর সুদূর প্রসারী চক্রান্ত। আব্দুল্লাহ, মোহাম্মদ, আবু বকর, আল-শরীফ এই সুন্দর ইসলামিক নাম গুলো পর্যন্ত তাদের সহ্য হল না। ইসলামিক স্বর্ণযুগের শুরুতেও তো মুসলিমরা প্রাচীন গ্রিক ও ভারত দার্শনিকদের নানা রচনা আরবি, সিরিয় ইত্যাদি ভাষায় অনুবাদ করেছে, কই তারা তো এমনটা করেনি। এই পুরো ব্যাপারটা আমাদের কাছে অত্যন্ত অদ্ভুত ঠেকেছে। লেখকের আসল নাম বদল করে নতুন নাম দেওয়ার মত এমন ঘটনা এর পূর্বে বা এর পরে কখনো ঘটেছে বলে আমার জানা নেই।তারা শুধু নাম বিকৃত করা পর্যন্তই থেমে থাকেনি, এমনকি তাদের পরিচয় নিয়েও নানা বিভ্রান্তি ও ধুম্রজাল সৃষ্টি করেছে। কারো ক্ষেত্রে বলা হচ্ছে উনি আদৌ মুসলিম নন, কারো অবদানকে খাটো করে দেখানো হয়েছে। রসায়নের জনক জাবির ইবনে হাইয়ান এমন এক চক্রান্তের স্বীকার। ইউরোপের এক ঐতিহাসিকের দাবি, জাবির ইবনে হাইয়ান ছাড়াও আরেক জন জাবির ছিলেন। উনার নাম ‘জিবার’ এবং উনি ইউরোপের অদিবাসী। এমন আরও অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে।এবার আমাদের অবস্থা নিয়ে কিছু কথা বলা যাক। আমরা কি মুসলিম বিজ্ঞানী, তাদের আবিস্কার, গবেষণাগুলো সম্পর্কে জানার চেষ্টা করেছি? তাদের নিয়ে আলোচনা কিংবা লেখা-লেখি? আমাদের শিশু কিশোররা কি গ্যালারিও, নিউটনদের পাশাপাশি নাসিরুদ্দিন তুসি, আল-ফরগানি, আল-ফারাবীদের সম্পর্কে কখনো জেনেছে, তাদের সম্পর্কে কখনো পড়েছে? বিজ্ঞান বিষয়ক শিশুতোষ বা কিশোর লেখাগুলতে তারা কি কখনো মুসলিম বিজ্ঞানীদের অসাধারণ গবেষণা, আবিস্কারগুলো সম্পর্কে জেনেছে? কেন এমনটি হল? আসলে এই বিষয়ে পশ্চিমারা যে নীতি বা শিক্ষা ব্যবস্থা আমাদের উপর চাপিয়ে দিয়েছে, আমাদের পরাজিত মন মানসিকতাও তা বিনাদ্বিধায় মেনে নিয়েছে।

জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে মুসলমানদের অবদান অন্যান্য ধর্ম ও জাতির তুলনায় অনেক অনেক বেশি। ইসলামের সূচনা থেকেই শিক্ষা-দীক্ষায়, জ্ঞান-বিজ্ঞান, সভ্যতা ও সংস্কৃতিতে মুসলমানদের যাত্রা শুরু হয়। মুসলিম দার্শনিকদের সৃষ্টিশীল প্রতিভার ফলেই জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় অভাবনীয় সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয়েছে।

জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রায় সব শাখায় মুসলমানদের অবদান রয়েছে। জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চাকে ইসলাম যেহেতু মর্যাদা দান করে উৎসাহিত করেছে; ফলে যুগে যুগে অনেক মুসলিম মনীষী জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন। মানবিক জীবনের যাবতীয় সমাধান মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে রয়েছে। কুরআনকে পর্যবেক্ষণ করে মানবতার কল্যাণে মুসলিম বিজ্ঞানীগণ বিভিন্ন বিষয় আবিষ্কার করেছেন। চিকিৎসাশাস্ত্র, রসায়নশাস্ত্র, পদার্থবিদ্যা, জ্যোতির্বিদ্যা, উদ্ভিদবিদ্যা, গণিত, ভূগোল প্রভৃতিসহ আরো বিভিন্ন বিষয়ে মুসলিম মনীষীদের ব্যাপক অবদান লক্ষণীয়।

জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় মুসলমানদের যে অবিস্মরণীয় অবদান রয়েছে সেখান থেকে সংক্ষেপে কিছু আলোচনা করলাম :

চিকিৎসাশাস্ত্র : জ্ঞান-বিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা হলো চিকিৎসাবিজ্ঞান। শরীর সম্পর্কিত বিদ্যা হলো চিকিৎসাবিজ্ঞান। চিকিৎসাবিজ্ঞানের অগ্রযাত্রা ও উৎকর্ষ সাধনের ক্ষেত্রে মুসলমানদের অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইতিহাসবিদ আল কিফতি তাঁর ‘তারিখুল হুকামাত’-এ লিখেছেন, ‘হজরত ইদ্রিস (আ.) হলেন প্রথম চিকিৎসাবিজ্ঞানী। আর ইসলামের সর্বশেষ নবী মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন শ্রেষ্ঠ চিকিৎসা বিজ্ঞানী। চিকিৎসাশাস্ত্রে কুরআনের অবদান উল্লেখ করতে গিয়ে জার্মান পণ্ডিত ড. কার্ল অপিতজি তাঁর ‘Die Midizin Im Koran’ গ্রন্থে দেখিয়েছেন যে কোরআনের ১১৪টি সুরার মধ্যে ৯৭টি সুরার ৩৫৫টি আয়াত চিকিৎসাবিজ্ঞান সংশ্লিষ্ট। তাছাড়া হাদিসের শ্রেষ্ঠতম গ্রন্থ বুখারী শরিফে ‘তিব্বুন নববি’ শীর্ষক অধ্যায়ে ৮০টি পরিচ্ছেদ রয়েছে। সেখানে রোগের চিকিৎসা পদ্ধতি, রোগ নিরাময় ও রোগ প্রতিরোধ কার্যাবলি সংবলিত। এছাড়াও চিকিৎসাশাস্ত্রে বিভিন্ন মুসলিম মনীষীগণ বিশেষ ভূমিকা রাখেন। তাদের মধ্যে ইবনে সিনা, আল-রাজী, আল-কিন্দি, আলী আত তাবারী, ইবনে রুশদ প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।ঔষধশাস্ত্র : মুসলমানগণ চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতির সাথে সাথে ঔষধ শাস্ত্রে ব্যাপক অবদান রাখে। তারা নিজেরা বিভিন্ন রোগের ঔষধ তৈরি করতো। তাছাড়া ঔষধ তৈরি এবং বিভিন্ন রোগের সমাধান প্রসঙ্গে বিভিন্ন গ্রন্থ রচনা করেন। যেমন ইবনে সিনা’র ‘কানুন-ফিত-তিব্ব’, আল রাজী’র ‘কিতাবুল মনসুরী’, আলবেরুনী’র ‘কিতাব আস সায়দালা’ আলী আল মাওসুলির চক্ষু চিকিৎসার সবচেয়ে দুর্লভ ও মূল্যবান গ্রন্থ ‘তাজকিরাতুল কাহহালিন’ প্রভৃতি গ্রন্থ রচনা করেন।অস্ত্রোপচার : মুসলিম বিজ্ঞানী আল-রাজী সর্বপ্রথম অস্ত্রোপচার বিষয়ে আধুনিক ভাবনা উদ্ভাবন করেন।

চক্ষু চিকিৎসায় : চক্ষু চিকিৎসায় মুসলমানদের মৌলিক আবিষ্কার রয়েছে। আলী আল মাওসুলি চোখের ছানি অপারেশনে সিদ্ধহস্ত ছিলেন। জর্জ সার্টনও তাকে জগতের সর্বপ্রথম মুসলিম চক্ষু চিকিৎসক বলে অকপটে স্বীকার করেছেন। তার ‘তাজকিরাতুল কাহহালিন’ চক্ষু চিকিৎসায় সবচেয়ে দুর্লভ ও মূল্যবান গ্রন্থ। এছাড়া চিকিৎসাশাস্ত্রে হাসান ইবনে হাইসাম, আলবেরুনি, আলী ইবনে রাব্বান, হুনাইন ইবনে ইসহাক, আবুল কাসেম জাহরাবি, জুহান্না বিন মাসওয়াই, সিনান বিন সাবিত, সাবিত ইবনে কুরা, জাবির ইবনে হাইয়ান প্রমুখও উল্লেখযোগ্য।

হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা : রাসুল (সা.) তাঁর জীবদ্দশায় বিশেষত যুদ্ধকালীন সময়ে যে ভ্রাম্যমাণ চিকিৎসাকেন্দ্র গড়ে তুলেছিলেন সে ধারণাকে কাজে লাগিয়ে পরবর্তীতে মুসলিম শাসকগণ সঠিক চিকিৎসা, পরীক্ষা-নিরীক্ষা, গবেষণা এবং ব্যবহারিক জ্ঞানর্চচার স্বার্থে বিভিন্ন স্থানে স্থায়ী চিকিৎসাকেন্দ্র তথা হাসপাতাল গড়ে তোলেন। খলিফা ওয়ালিদ ইবনে মালিকের শাসনামলে প্রথম স্থায়ী হাসপাতাল তৈরি করা হয়। ধর্ম-বর্ণ ভেদে সবাই সেখানে চিকিৎসা পেত। রোগভেদে ছিল আলাদা ওয়ার্ড ব্যবস্থা। মুসলিম সালতানাতে প্রতিষ্ঠিত তৎকালীন হাসপাতালের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: সিরিয়ার দামেস্ক শহরের আল-নুরী হাসপাতাল, জেরুজালেমের আল সালহানি, বাগদাদের আল-সাইয়িদাহ, আল-মুক্তির আদুদি হাসপাতাল, কায়রোর আল মানসুরি হাসপাতাল, আফ্রিকার মরক্কোর আল-মারওয়ান ও তিউনিসের মারাবেশ হাসপাতাল উল্লেখযোগ্য।

রসায়নশাস্ত্র : বিজ্ঞানের সর্ববৃহৎ ও প্রধান শাখার নাম রসায়ন। রসায়নশাস্ত্রের জনক বলা হয় জাবির ইবনে হাইয়ানকে। রসায়নশাস্ত্রে বিভিন্ন মুসলিম মনীষী অবদান রাখেন। তাদের মধ্যে জাবির ইবনে হাইয়ান, খালিদ বিন-ইয়াজিদ, জাকারিয়া আল রাজী, আল-জিলদাকী প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।

যৌগিক সূত্র আবিষ্কার : জাবির ইবনে হাইয়ান প্রথম এসিড, গন্ধক, দ্রাবক, জল দ্রাবক, রৌপ্যক্ষার ও অনান্য যৌগিক সূত্র আবিষ্কার করেন। তাছাড়া তিনি ভস্মীকরণ ও লঘুকরণকে বৈজ্ঞানিক নিয়মে আলোচনা করেছেন।

ডিমের পানি প্রস্তুতকরণ : একাদশ শতাব্দীর বিখ্যাত রসায়নবিদ ইমাম জাফর আস-সাদিক সর্বপ্রথম রসায়ন শাস্ত্রের আলোকে ডিমের পানি প্রস্তুতকরণ পদ্ধতি আবিষ্কার করেন।

ধাতুর পরিবর্তন : মুসলিম মনীষী আবুল কাশেম আল ইরাকী সর্বপ্রথম ধাতুর পরিবর্তন সর্ম্পকে ধারণা দেন।

জ্যোতির্বিদ্যা : জ্যোতির্বিদ্যা হলো মহাকাশ সম্পর্কীত বিজ্ঞান। গ্রহ, নক্ষত্র, চন্দ্র, সূর্য ও অলৌকিক বস্তু সমূহের গতিবিধি নিয়ে যে শাস্ত্র আলোচনা করে তাকে জ্যোতির্বিজ্ঞান বলে। পৃথিবীর গতিবিধি, অক্ষাংশের পরিবর্তন, ধূমকেতুর রূপ নির্ণয় ইত্যাদি ক্ষেত্রে মুসলমানদের অবদান ঈর্ষনীয়। জ্যোতির্বিদ্যার উৎকর্ষ সাধনে যে কজন অবদান রেখেছে তাদের মধ্যে আল মনসুর, আন মামুন, আবু মাশার, আল খারেজমী, আবুল হাসান প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।

মানচিত্রের ধারণা : বিশ্ব মানচিত্রের প্রথম ধারণা দেন মুসলিম মনীষী আল-ইদ্রিসী। পরবর্তীতে এটিই বিশ্ব মানচিত্রের মডেল হিসেবে স্বীকৃত হয়।

বর্ষপঞ্জি ও নক্ষত্র : উমর খৈয়াম প্রথম বর্ষপঞ্জি প্রনয়ণ করেন। পরবর্তীতে আল-বাত্তানী সর্বপ্রথম নক্ষত্রের চার্ট তৈরি করেন।

উদ্ভিদবিদ্যা : উদ্ভিদবিদ্যায় মুসলমানদের অবদান অপরিসীম। উদ্ভিদবিদদের মধ্যে ইবনে বাতরের নাম উল্লেখযোগ্য। লতাপাতা সম্পর্কিত তাঁর তথ্যবহুল গ্রন্থটি আজও সকলের কাছে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। তাছাড়া মুসলমানরা ভূতত্ত্ব ও প্রাণিতত্ত্বে উন্নতি সাধন করেছিলেন।

পর্দাথবিদ্যা : জ্ঞান-বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার ন্যায় মুসলমানরা পর্দাথবিদ্যায় ব্যাপক অবদান রেখেছেন। পর্দাথবিজ্ঞানে যেসব মনীষী অসামান্য অবদান রেখেছেন তাদের মধ্যে ইবনে রুশদ, আলবেরুনী, আল-খারেজমী, ইবনুল হাইসাম প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। পর্দাথবিজ্ঞানের উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে তামহিদুল মুসতাকাররে লিমানিল মামারবে, কিতাবুল মানায়িব, রিসালাতু ফিশাশফক প্রভৃতি।

গণিতশাস্ত্র : গণিতশাস্ত্রের প্রচলন, অগ্রগতি, ও উৎকর্ষতায় মুসলমানদের অবদান অনস্বীকার্য। যারা গণিতশাস্ত্রকে উন্নতির আসনে বসিয়েছেন তাদের মধ্যে রয়েছে- আল বেরুনী, আল-খারেজমী, আল-কারখী, ওমর খৈয়াম, আবুল ওয়াদা প্রমুখ।

সংখ্যাবাচক চিহ্ন : মুসলিম গণিতবিদ আল খারেজমী সর্বপ্রথম সংখ্যাবাচক চিহ্নের ব্যবহার বিষয়ে ধারনা দেন। গণিতশাস্ত্রের উপর তার বিখ্যাত গ্রন্থ হলো কিতাবুল হিন্দ। এখানে তিনি গণিতের বিভিন্ন জটিল বিষয়ের সমাধান দেখিয়েছেন।

দূরত্ব নির্ণয় : বিজ্ঞান ও গণিত জগতের এক অনন্য নাম ইবনুল হাইশাম। তিনিই প্রথম জ্যামিতিক গণনার সাহায্যে পৃথিবীর যেকোনো দুটি স্থানের মধ্যে দূরত্ব নির্ণয় করেন।

সমুদ্র সূর্য ও নক্ষত্র : মুসলিম বিজ্ঞানী আল-ফারাবী সর্বপ্রথম সমুদ্রে সূর্য ও নক্ষত্র সমূহের উচ্চতা নির্ণয় করার আস্তারলব নির্মান করেন।

মুসলমানদের বিভিন্ন আবিষ্কার, গবেষণাকর্ম ও সূত্রের সাহায্যে বিজ্ঞানকে করেছে সমৃদ্ধশালী। বিজ্ঞানে মুসলমানদের অবদান বর্ণনাতীত। যদিও মুসলমানদের কৃতিত্বের অনেক কিছুই ষড়যন্ত্রমূলকভাবে বাদ পড়েছে। কিন্তু একথা সবাইকে স্বীকার করতে হবে যে মুসলমানরা আধুনিক বিজ্ঞানের সফল পথিকৃৎ।

আমরা কি পারিনা ইসলামের স্বর্ণযুগের ইতিহাস নিয়ে চর্চা করেতে, মুসলিম বিজ্ঞানদের অবদান ও আবিস্কার নিয়ে কথা বলতে? আমাদের শিশু-কিশোররা যখন তাদের পূর্বপুরুষদের এই গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস এবং অর্জনগুলো সম্পর্কে জানবে, তখন তাদের মধ্যে আর হীনমন্যতা কাজ করবেনা। এই ইতিহাস আর গল্পগুলো তাদেরকে অনুপ্রাণিত করবে দারুণভাবে। হলিউড, বলিউড এর নায়ক-নায়িকা, গায়ক বা সেলিব্রেটি খেলোয়াড় কিংবা তথাকথিত টিকটক সেলিব্রেটিদের বদলে খোঁজে পাবে তার আসল আদর্শকে। তখন ইবনে সিনা, ছাবেত ইবনে কোরা, ওমর খৈয়ামরা হবে তাদের আইডল।

কিছু কিছু তথ্য,

১. বিজ্ঞানে মুসলমানদের অবদান,-মুহাম্মদ নুরুল আমীন।২. স্বর্ণযুগে মুসলিম বিজ্ঞানীদের আবিষ্কার-সাহাদত হোসেন খান,থেকে নেওয়া।