নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল এন্ড এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র ও রিসার্চ এ্যাসিস্ট্যান্ট আরমান রেজা শাহ্ ও একই বিভাগের অধ্যাপক ড. নাদিম রেজা খন্দকার পিএইচডি-র ‘কৃষি বর্জ্য ও মাটি থেকে পরিবেশবান্ধব ইট’ কিভাবে তৈরি করতে হয় এ সংক্রান্ত একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন। ৭ মাস গবেষণার পর এই সফলতা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন তারা। আধুনিক ইমারত নির্মাণে এই পরিবেশবান্ধব ইট সুদূরপ্রসারি ভূমিকা রাখবে বলে আশাবাদী তাদের। আরমান রেজা শাহ্ ঠাকুরগাঁও শহরের সরকারপাড়া অধ্যাপক মো. আব্দুল কুদ্দুস শাহ্-র ছেলে।
ইট উৎপাদনের কথা শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে উপরিভাগের মাটি কেটে ফসলি জমির বারোটা বাজানো কিংবা জ্বালানি কাঠ, গাড়ির পুরোনো টায়ার ও রাবার পুড়িয়ে পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতির নানা চিত্র। গতানুগতিক এই ধারার বাইরে কৃষি বর্জ্য ও মাটি থেকে পরিবেশবান্ধব ইট তৈরিতে সফলতা অর্জন করেছে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল এন্ড এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রফেসর ড. নাদিম রেজা খন্দকার ও নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল এন্ড এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের রিসার্স এ্যাসিসটেন্ট আরমান রেজা শাহ্। পোড়ানো ইটের বিকল্প পরিবেশবান্ধব আধুনিক পদ্ধতির ইট হিসেবে এটি পরিচিত হবে- এমনটাই আশা তাদের।
নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল এন্ড এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের দাবি, কৃষিবর্জ্য ও মাটি দিয়ে তৈরি ইট পোড়ানো ইটের চেয়ে বেশি শক্তিশালী। এছাড়া ব্যয় সাশ্রয়ীও। আর এই ইটের ওজন অনেক কম হওয়ায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাড়তি সুবিধাও রয়েছে।
‘গবেষণার শুরুটা কিভাবে’- এ নিয়ে কথা হয় মো. আরমান রেজা শাহ্-র সাথে। তিনি জানান, কোভিড পরিস্থিতির জন্য তখন সারাদেশের সব শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান বন্ধ, অনলাইন সেমিস্টার চলছিল, সে-সময়ই মূলত এই গবেষণা করার আগ্রহ জন্ম নেয়। আমি প্রফেসর ড. নাদিম রেজ খন্দকার স্যারের সাথে যোগাযোগ করি এবং স্যার এ বিষয়ে কাজের জন্য আগ্রহ পোষণ করি। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে আমি আমার দাদাবাড়ি (ফুলবাড়ি, দেবীগঞ্জ, পঞ্চগড়) যাই। আমি ছোটবেলা থেকেই এ অঞ্চলে মাটির ঘরের প্রচলন দেখে এসেছি। সেদিক থেকে প্রচন্ড আগ্রহ থেকে কাজ শুরু করি।
প্রথমদিকে ওই এলাকার মাটির বাড়িগুলো পরিদর্শন করি এবং এসব বাড়ির বাসিন্দাদের সাথে কথা বলি। তারা কি কি ম্যাটেরিয়াল ব্যবহার করেন, তৈরী করতে কি কি সমস্যার সম্মুখীন হন এবং মাটির বাড়ির ব্যবহারের সুবিধা নিয়েও আলোচনা করি। খেয়াল করে দেখি, এই অঞ্চলে প্রচুর ধানের চাষ হয় এবং ফসল তোলার পর উচ্ছিষ্ট বিশাল একটা অংশ তারা পুড়িয়ে ফেলেন যেটাকে আর কোনোভাবেই ব্যবহার করা হয়না।
সেখান থেকেই চিন্তায় আসে, এই বর্জ্য থেকে মাটির বাড়ির জন্য ইট প্রস্তুত করার বিষয়টি। সেখান থেকে স্যাম্পল সংগ্রহ করি (মাটি, কৃষিবর্জ্য)। সেখান থেকেই কয়েকটি রেশিও ধরে ইটের স্যাম্পল প্রস্তুত করে ফেলি। সেগুলোকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয় এবং ড. নাদিম রেজা স্যারের তত্বাবধানে এই ইটের স্যাম্পলগুলোকে ২৪ ইসিবি, বাংলাদেশ আর্মি ল্যাবে কম্প্রেসিভ স্ট্রেন্থ টেস্ট করানো হয়। সেখানে আশাব্যঞ্জক ফল আমরা পাই।
বলে রাখা ভালো, সাধারণ ইটের কম্প্রেসিভ স্ট্রেন্থ ধরা হয় ২১০০ পিএসআই। আমরা ২টি রেশিও থেকে গড় ভ্যালু পাই ১৯০০ পিএসআই এবং ২৪০০ পিএসআই। পরবর্তীতে এই ইটের আরও কিছু স্যাম্পল পিডব্লিউডি-তে পাঠানো হয় এবং সেখানেও একই রকম ভ্যালু পাওয়া যায়।
আমদের উদ্দেশ্যঃ
১. সাস্টেনেবল ডেভেলপমেন্ট গোলকে মাথায় রেখে পরিবেশ বান্ধব ইন্সট্রাকশন ম্যাটেরিয়াল তৈরী করা।
২. কার্বন নিঃসরণের মাত্রা কমানো।
৩. পরিবেশ বান্ধব বাসস্থান ব্যবহারে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা।
আমদের সফলতাঃ
১. এই ইট প্রস্তুত করতে খরচের পরিমান প্রায় শূণ্য।
২. যেহেতু এগুলো প্রস্তুত করতে পোড়ানোর প্রয়োজন হয়না, তাই কার্বন নিঃসরণের মাত্রা শূণ্য।
৩. অধিক চাপ নিয়ে পারার ক্ষমতা থাকায়, গ্রামের মানুষেরা দীর্ঘদিন একটি মানসম্মত বাসস্থানে থাকতে পারবে।
৪. তরুণ সমাজকে গবেষণায় উদ্ভুদ্ধ করা।
সমস্যাঃ যেহেতু এটি একটি নব্য গবেষণা তাই আমরা এখনই বলবো না এই ইট ১০০% ব্যবহারযোগ্য। আমাদের আরও বিস্তর গবেষণা করতে হবে এবং আমাদের স্পন্সশিপের প্রয়োজন কমার্শিয়ালি এই ইট প্রস্তুত করে সবার নাগালের মধ্যে নিয়ে আসার। তবে ইতোমধ্যেই আমরা এই ইটের ব্যবহার ও বিস্তার নিয়ে গবেষণা শুরু করেছি এবং সমস্যাগুলোর সমাধান খুব দ্রুত বের করার চেষ্টা আমরা করছি।
তিনি আরমান রেজা শাহ আরো বলেন, পোড়ানো ইটের শক্তির মাত্রা থাকে মানভেদে কৃষিবর্জ্য ও মাটি দিয়ে তৈরি ইট বেশ শক্তিশালী ও পরিবেশবান্ধব। গবেষণাতেও ভালো ফলাফল পাওয়া গেছে। এই ইট বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরুর উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে।
নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল এন্ড এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রফেসর ড. নাদিম রেজা খন্দকার বলেন, আমরা গবেষণায় দেখেছি, কৃষিবর্জ্য ও মাটি দিয়ে তৈরি ইট পোড়ানো ইটের তুলনায় ভালো। কারণ একদিকে এটি বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় অবদান রেখে পরিবেশ ভালো রাখবে, সেই সাথে কাঁচামালের জোগানও স্থানীয়ভাবে মোকাবেলা করা যাবে।
তিনি আরো বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মাটির ঘর নির্মাণ করছে কারণ এই ঘরে বসবাস করা বেশ আরামদায়ক। আমরা মানুষকে মাটির ঘর নির্মাণে উদ্বুদ্ধ করতেই এই গবেষণা করেছি। সফলতাও পেয়েছি। এখন এই ইট বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন করতে অর্থের প্রয়োজন। সরকার আর্থিকভাবে সহযোগিতা করলে তাহলে কৃষিবর্জ্য এই ইট বাণিজ্যিকভাবে রপ্তানি করা সম্ভব।
দৈনিক কলম কথা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।