বয়স বাড়ার সঙ্গে হাড়ের জোড় ক্ষয় হওয়া থেকে হাঁটুর ব্যথায় ভোগা মানুষের সংখ্যা নেহাত কম নয়। আবার অপ্রত্যাশিত আঘাত, দুর্ঘটনা ও বিভিন্ন রোগের কারণে তরুণ ও মধ্যবয়স্কদের মাঝেও এই সমস্যা দেখা যায় প্রায়শই। কারণ যাই হোক না কেনো, হাঁটু ব্যথা দৈনিক জীবনযাত্রা কঠিন হয়ে যায়।

হাঁটু ব্যথা প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে একটি সাধারণ সমস্যা এবং প্রতিনিয়ত হাঁটা, দাঁড়ানো এবং ভারী কোন বস্তু নিচ থেকে উপরে উঠানোর সময় এটি আরো বেশি হয়ে থাকে। এছাড়া, যে ক্রীড়াবিদরা দৌড়ান বা খেলাধুলা করেন যেগুলিতে জাম্পিং বা দ্রুত দৌড়ানো জড়িত থাকে তাদের হাঁটুতে ব্যথা এবং সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।

হাঁটু ব্যথার কারণ:
মূলত প্রধান তিনটি কারণে হাঁটু ব্যথা বেশি হয়ে থাকে।

১.আঘাতজনিত
২. ক্ষয়জনিত
৩. বাতজনিত।

আঘাতজনিত ব্যথা খেলাধুলার ইনজুরি বা কোনো দুর্ঘটনায় লিগামেন্টের আঘাত থেকে হাঁটু বা জয়েন্টে ব্যথা হতে থাকে। আবার হাঁটুর জয়েন্টের কাছে কারটিলিস নামের যে নরম হাড় থাকে, সেখানে ক্ষয় দেখা দিলে হাঁটুর ব্যথা হতে পারে।

ক্ষয়জনিত ব্যথা বয়স্কদের (৪০ বছরের পর) ভেতর বেশি লক্ষ করা যায়। এ ধরনের সমস্যায় হাঁটুতে ব্যথা থাকার পাশাপাশি হাঁটু ফোলা থাকবে, ভাঁজ করতে সমস্যা হবে, হাঁটুর তাপমাত্রা বেড়ে যাবে, হাঁটুর আকৃতির পরিবর্তন হতে পারে, হাঁটু ভাঁজ করতে গেলে শব্দ হয়।

বাতজনিত ব্যথা যেকোনো বয়সে হতে পারে। অস্বাভাবিক ভার বহন করা কুলি ও মজুরেরা যদি অস্বাভাবিক ওজন বহন করে সেক্ষেত্রেও হাঁটুর উপর চাপ পড়ে ভেতরের বা বাইরের লিগামেন্টস ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেক্ষেত্রে বাতজনিত ব্যথা হতে পারে। হাঁটুতে বেশি চাপ পড়লে এর আশপাশের লিগামেন্টে বিভিন্ন ফর্মে ইনজুরি হতে পারে। বয়স্কদের অস্টিওআরথ্রাইটিস হলে ব্যথা হয়। ছোটদের রিউমাটয়েড জ্বরের জন্য ব্যথা হতে পারে। বাতের হাঁটুব্যথা আর সাধারণ হাঁটুব্যথার পার্থক্য আছে। বাতের হাঁটুব্যথায় ইনফ্ল্যামেশনের কিছু চিহ্ন ফুটে ওঠে। যেমন, হাঁটু লাল হয়ে যায়, ব্যথায় ফুলে যায়, যখন বিশ্রাম করা হয় তখন ব্যথা বেশি হয়।

হাঁটু ব্যথায় করণীয়

ব্যায়াম:
হাঁটু ব্যথায় ব্যায়াম অত্যন্ত কার্যকরী। ব্যায়ামের মাধ্যমে জয়েন্টে রক্ত চলাচল বাড়ে এবং জয়েন্ট নিয়ন্ত্রণকারী মাংস পেশী, লিগামেন্টস, স্নায়ু নিউট্রিশন পায় ও কর্মক্ষমতা বাড়ে। যে কারণে ব্যথা কমে যায়। ব্যায়ামের মাধ্যমে জয়েন্টসের মুভমেন্টের ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় ও আমরা স্বাচ্ছন্দে সব কাজ করতে পারি। ব্যায়ামের মাধ্যমে শরীরের মধ্যে এনডরফিন নামক পদার্থ নিঃসরণ বাড়ে যা আমাদের ব্যথা কমাতে সক্রিয় থাকে। তবে খেয়াল রাখতে হবে, ব্যথা অবস্থায় ব্যায়াম করা যাবে না। আর ভালোভাবে না জেনে এমন ধরনের ব্যায়াম করা যাবে না, যাতে আমাদের হাঁটু ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

ওজন কমানো:
স্থূলত্বের কারণে সমস্যা হলে শরীরের ওজন কমালে হাঁটুর ব্যাথা কমতে তা সাহায্য করতে পারে। ওজন কমানোর ক্ষেত্রে আপনি কম কার্বোহাইড্রেট এবং বেশি প্রোটিন সমৃদ্ধ খাদ্য তালিকা অনুসরণ করতে পারেন। সেই সঙ্গে সপ্তাহে অন্তত পাঁচদিন ৩০ মিনিট ব্যায়াম করে ৮-১০ গ্লাস পানি খাওয়া।

জীবনশৈলীর ব্যবস্থাপনা (লাইফস্টাইল ম্যানেজমেন্ট):
হাঁটুর ব্যাথা রোধে জীবনশৈলীর পরিবর্তন সাহায্য করতে পারে, কিন্তু কিছু বিষয় আছে যেমন বয়স, যা পরিবর্তন সম্ভব নয়। কাজেই, এ সব ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উপকারী হতে পারে। যা খাচ্ছেন তার প্রভাব সরাসরি দেহে প্রভাব ফেলে। পুষ্টিকর খাবার শক্তিশালী হাঁটু তৈরি করে। তাই পুষ্টিকর খাবার খান। যেকোনো বয়সে ক্যালসিয়ামের সঙ্গে ভিটামিন ডি দারুণ শক্তিশালী হাড় গঠন করে। ভিটামিন ডি এর অভাবের সঙ্গে অস্টেয়োপরোসিসের সম্পর্ক রয়েছে। সূর্যের আলোতে ভিটামিন মেলে। অনেকেই খাদ্য গ্রহণে নিয়ন্ত্রণ এনে এক সময় তা মেনে চলেন না। কিন্তু একটি ডায়েটে অভ্যস্ত হয়ে উঠুন। এ কাজে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে পারেন।

হাঁটু ব্যথার চিকিৎসা:
হাঁটু ব্যথায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্যথানাশক ঔষধ হিসাবে এনএসএইড ব্যবহার করা হয়। দীর্ঘ মেয়াদি এসকল ওষুধ সেবনে কিডনি সমস্যাগ্রস্ত হতে পারে। প্রেশার বেড়ে যেতে পারে। রক্তক্ষরণজনিত সমস্যা ও আলসারের মতো সমস্যাও হতে পারে। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে এনএসএইড এর বিকল্পও থাকে না। তবে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে খেতে হবে।

উপরোক্ত সমস্যাগুলোর কারণে এখন হাঁটু ব্যথায় “ইন্টারভেনশন” চিকিৎসা খুবই কার্যকারী। এতে গুরুতর কোন সাইড ইফেক্ট নেই আবার দীর্ঘ মেয়াদে এনএসএইড এর ব্যবহার কমে যায়। এতে মূলত ব্যথার চক্র ভেঙে দেয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে একবারই যথেষ্ঠ হয়। তবে কিছু ক্ষেত্রে একাধিক প্রয়োজন হতে পারে।

বিশ্রাম:
আপনার চিকিৎসক ওষুধ প্রয়োগের সঙ্গে আপনাকে বিশ্রাম নেওয়ার পরামর্শ দেবেন। যদি কোনও সংক্রমণ হয়ে থাকে বা আঘাত লেগে থাকে তাহলে হাঁটুর সন্ধিস্থলকে বিশ্রম দিলে আরাম বোধ হবে এবং দ্রুত আরোগ্যলাভ হবে।

ফিজিওথেরাপি:
কোনও ফিজিওথেরাপিস্ট চিকিৎসকের নির্দেশমত ফিজিক্যাল থেরাপি হলে হাঁটুর ব্যথা কমতে পারে। আবার নিয়মিত থেরাপি করা হলে অধিকাংশ সময়ে ব্যথা সম্পূর্ণ নিরাময় হতে পারে। একবারই যথেষ্ঠ হয়। তবে কিছু ক্ষেত্রে একাধিক প্রয়োজন হতে পারে।

হাঁটুর ব্যথা প্রতিরোধে আকুপাংচার এর ভূমিকা:
হাঁটুর ব্যথা প্রতিরোধ এবং নিয়ন্ত্রণে বিকল্প চিকিৎসা ব্যবস্থা হিসাবে আকুপাংচার বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। মানব শরীরের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ইমপালস কে বিভিন্নভাবে অবহিত করার মাধ্যমে আকুপাংচার হাঁটুর ব্যথা এবং অন্যান্য ব্যথা নিবারণে যথেষ্ট কার্যকর বলে গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে। আকুপাংচার এর মাধ্যমে ফুসফুসের কার্যক্ষমতা অনেকাংশে বৃদ্ধি পায় এবং শরীর অধিক কার্যক্ষম হয়।

এছাড়া এক গবেষণায় দেখা গিয়েছে, আকুপাংচার শরীরের বিভিন্ন অংশের মধ্যে এক ধরণের উদ্দীপনা তৈরী করে। যার কারণে ব্যথাযুক্ত স্থান গুলির মধ্যে নতুন করে উদ্দীপনা তৈরী হয় এবং ব্যথা ধীরে ধীরে প্রশমিত হতে থাকে। সুতরাং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ামুক্ত আকুপাংচার বিকল্প চিকিৎসা ব্যবস্থা হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে বহু বছর ধরে। আকুপাংচার চিকিৎসার মূল ভিত্তি হলো শরীরের মাংসপেশি, ব্লাড ভেসেল, রক্তনালী, ইত্যাদি। আকুপাংচার পদ্ধতিতে রোগীর কশেরুকার যে লেভেলে সমস্যা আছে, আকুপাংচার পদ্ধতিটি সেই স্থানের আশেপাশে অবস্থিত চ্যানেলগুলোকে এর মাধ্যমে ইলেকট্রিক শক দিয়ে উদ্দীপিত করে। এতে সেই স্থানে রক্ত চলাচল বাড়ে এবং বিভিন্ন রকম হরমোন নিঃসরণ হয়। এর ফলে উক্ত স্থানের ব্যথা উপশম হতে থাকে।

আকুপাংচার পদ্ধতি প্রায় তিন হাজার বছরের পুরনো একটি চিকিৎসা ব্যবস্থা। যার মাধ্যমে ব্যথা জাতীয় বিভিন্ন রোগের উপশম পাওয়া যায়। বর্তমান বিশ্বে আকুপাংচার একটি নিদারুণ চিকিৎসা পদ্ধতি হিসাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এই চিকিৎসা পদ্ধতির সবথেকে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হলো এটা পুরোপুরি ঔষধ ছাড়া একটি চিকিৎসা ব্যবস্থা। যেখানে রোগীকে কিছুসংখ্যক থেরাপি এবং আকুপাংচার ছাড়া অন্য কোন ঔষধ দেওয়া হয় না। এক্ষেত্রে ঔষধ না গ্রহণের ফলে রোগীর শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা আগের তুলনায় বৃদ্ধি পায়। আকুপাংচার এর ফলে শরীরের ব্যক্তিগত স্থানগুলোর মধ্যে উদ্দীপনা তৈরী হয় এবং শরীরের ব্যথা উপশম হতে থাকে, রোগী সুস্থ হয়ে যায়।

বাংলাদেশের আকুপাংচার চিকিৎসার জন্য যতগুলি বিশেষায়িত সেন্টার রয়েছে তার মধ্যে দক্ষ এবং প্রসিদ্ধ হলো শশী হাসপাতাল। শান্তিনগর চৌরাস্তা অবস্থিত শশী হাসপাতালে বর্তমানে আকুপাংচার এর সব থেকে ভালো এবং উপযুক্ত চিকিৎসা দেওয়া হয়।

লেখক: ডা. এস. এম. শহীদুল ইসলাম,
আকুপাংচার বিশেষজ্ঞ (ভিজিটিং কনসালটেন্ট, শশী হাসপাতাল)