দুই বছরে ২০ জন পাচ্ছেন জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার। ২০২১ ও ২০২২ সালে ১০ জন করে ক্রীড়াবিদ ও ক্রীড়াব্যক্তিত্ব এই পুরস্কার পাচ্ছেন। ২০ জনের চূড়ান্ত তালিকা রোববার যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় থেকে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হয়েছে। জাতীয় পুরস্কারের জন্য গঠিত মন্ত্রিপরিষদ কমিটির অনুমোদনের পরেই এই সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি হবে।

বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় ২০২১ সালের জন্য যে ১০ জনের নাম চূড়ান্ত করেছে, তারা হলেন-প্রয়াত ফুটবলার একেএম নওশেরুজ্জামান, ভলিবল ফেডারেশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক মহাসচিব গোলাম কুদ্দুস চৌধুরী বাবু, জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক ফারুক আহমেদ, সাবেক টেবিল টেনিস তারকা আবু মমতাজ সাদ উদ্দিন আহমেদ কিসলু, ভলিবল তারকা ইয়াদ আলী, ব্যাডমিন্টন তারকা রাসেল কবির সুমন, অ্যাথলেটিক্স কুইন নাজমুন নাহার বিউটি, তারকা সাঁতারু জুয়েল আহম্মেদ, জাতীয় ফুটবল দলের সাবেক কোচ একেএম মারুফুল হক এবং জাতীয় নারী কাবাডি দলের সাবেক অধিনায়ক শাহনাজ পারভীন মালেকা।

২০২২ সালের জন্য মনোনীতরা হলেন-সাবেক অ্যাথলেট ও জাতীয় সংসদের হুইপ এবং বাংলাদেশ মহিলা ক্রীড়া সংস্থার সভানেত্রী মাহবুব আরা বেগম গিনি এমপি, পৃষ্ঠপোষক ও ক্রিকেট সংগঠক মির্জা সালমান ইস্পাহানী, সাবেক তারকা ফুটবলার সৈয়দ রুম্মান বিন ওয়ালী সাব্বির ও আলফাজ আহমেদ, সাবেক অ্যাথলেট মেরিনা খানম মেরি, সাবেক ক্রিকেটার জিএস হাসান তামিম, হকি তারকা রফিকুল ইসলাম কামাল, সাফ গেমসে জোড়া স্বর্ণজয়ী সাঁতারু মাহফুজা খাতুন শিলা, সাবেক জাতীয় চ্যাম্পিয়ন শাটলার এনায়েত উল্লাহ খান এবং সাবেক জাতীয় আরচার ইমদাদুল হক মিলন।

দেশের ক্রীড়াঙ্গনে বিশেষ অবদান রাখার জন্য ১৯৭৬ সালে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কারের প্রবর্তন করেন। ওই বছর আটজনকে দেওয়া হয়েছিল ক্রীড়া পুরস্কার। ছয় বছর নিয়মিত দেওয়ার পর ১৯৮২ সালে বন্ধ হয়ে যায় জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার। ১৯৯৬ সালে আবার শুরু হয় পুরস্কার প্রদান। ২০২০ সাল পর্যন্ত ৩১৪ জন ক্রীড়াবিদ ও ক্রীড়া সংগঠক
পান এই পুরস্কার। তবে ২০০৮ সালে তৎকালীন সেনাপ্রধান ও অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি জেনারেল (অব.) মঈন ইউ আহমেদকে পুরস্কারের জন্য চূড়ান্ত মনোনয়ন দেওয়া হয়েছিল। তার অনুপস্থিতির কারণে ওই পুরস্কারটি দেওয়া হয়নি। পুরস্কার পাওয়াদের একটি করে স্বর্ণপদক, সনদপত্র, নগদ এক লাখ টাকা ও একটি ব্লেজার দেওয়া হয়।

অতীতে কীর্তিমানদের সঙ্গে ক্রীড়া পুরস্কার বাগিয়ে নিতেন অখ্যাতরাও। মিথ্যা তথ্য ও প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে ক্রীড়া পুরস্কারের তালিকায় নিজেদের নাম যুক্ত করেছিলেন কয়েকজন। তাই অনেকে ক্রীড়া পুরস্কারকে ‘তদবির পুরস্কার’ নামে আখ্যায়িত করতেন। কিন্তু এবার তেমনটি ঘটেনি। যোগ্যরাই পাচ্ছেন জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার।

তারপরও অনেক প্রথিতযশা ক্রীড়াবিদ ও সংগঠক উপেক্ষিত হয়েছেন এবারও। এ দেশের যে ক’জন ফুটবলার দর্শকদের নজর কেড়েছিলেন, তাদের মধ্যে অন্যতম ঝাঁকড়া চুলের সুদর্শন চেহারার স্টাইলিশ ফরোয়ার্ড রুমি রিজভী করিম। গোল করানো ও করার অসাধারণ ক্ষমতা ছিল। কলকাতা লিগে ইস্টবেঙ্গলের হয়ে অসাধারণ নৈপুণ্য প্রদর্শনকারী রুমি ১৯৯৮ সালে অবসর নেন। দেশের অন্যতম সেরা এই ফরোয়ার্ডের গলায় ঝোলেনি ক্রীড়া পুরস্কারের পদক। একসময়ের মাঠ কাঁপানো ফরোয়ার্ড মামুন জোয়ার্দার। ১৯৯৭ পর্যন্ত টানা আট বছর জাতীয় দলের অপরিহার্য খেলোয়াড় ছিলেন। ফুটবল মাঠের এ শিল্পীকে মূল্যায়ন করা হয়নি। সত্তর, আশি ও নব্বই দশকে সংগঠক হিসাবে মনিরুল হক চৌধুরী ছিলেন উজ্জ্বল নক্ষত্র। বাফুফের সদস্য ও সহ-সভাপতি ছিলেন। পাইওনিয়ার ফুটবল লিগের প্রতিষ্ঠাতা তিনি। এদেশের ক্রীড়াঙ্গনকে বছরের পর বছর সেবা দিয়ে যাওয়া মনিরুল হক চৌধুরীও পাননি ক্রীড়া পুরস্কার। ক্রিকেটে বাংলাদেশের সাংগঠনিক সাফল্যের সঙ্গে

অবিচ্ছিন্নভাবে জড়িয়ে রয়েছে সাবের হোসেন চৌধুরীর নাম। আবাহনী পরিচালক হিসাবে ক্রীড়াঙ্গনে দীর্ঘদিন ধরে অবদান রেখে চলেছেন আ হ ম মুস্তাফা কামাল। এদেশের ক্রিকেটকে জনপ্রিয় করে তুলতে তিনি অবদান রেখেছেন। অর্থমন্ত্রী হলেও তিনি পরিচিত একজন ক্রীড়া সংগঠক হিসাবে। তিনিও পাননি স্বীকৃতি। প্রয়াত ক্রিকেটার শেখ দৌলতুউজ্জামান জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কারে ভূষিত-এটা দেখে যেতে পারেননি। একই দশা আসাফউদ্দৌলারও। ছিলেন সেরা সাঁতারু। হয়েছিলেন সেরা সংগঠক। কিন্তু সেরা সংগঠকের পুরস্কার আজও পাননি।

জলকন্যা মনিরা বেগম ডালিয়া ’৮৩তে তিনি প্রথম জাতীয় প্রতিযোগিতায় অংশ নেন। ওই বছর বালিকাদের গ্রুপে ৫০ মিটার ফ্রিস্টাইল ও ব্যাকস্ট্রোকে স্বর্ণপদক জেতেন তিনি। ১৯৮৪ সালেও দুটি এবং ১৯৮৭ সালে তিনটি স্বর্ণ জেতেন তিনি। ১৯৯০ সালে রেকর্ডসহ চারটি স্বর্ণপদক জয় করেন ডালিয়া। ১৯৯২তে তিনটি এবং ’৯৪ সালে চারটি স্বর্ণপদক গলায় ঝুলান। অর্জন করেন দেশের দ্রুততম সাঁতারুর খেতাব। ’৯২ সালে বাংলাদেশ গেমসে ছয়টি স্বর্ণ ও দুটি রুপা জিতে গেমসের সেরা মহিলা সাঁতারু নির্বাচিত হন। জাতীয় প্রতিযোগিতায় ডালিয়া ২৬টি রেকর্ড গড়েছেন। ১৯৯১ সালে কলম্বো সাফ গেমসে দুটি ব্রোঞ্চ জেতেন। দেশসেরা এই সাঁতারুর ভাগ্যেও জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার জোটেনি।
ক্রীড়া পুরস্কার পাননি একসময়ের কৃতী ফুটবলার ও তুখোড় ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড় বজলুর রহমান। যিনি জীবনের শেষ ৫০ বছর কাটিয়েছেন ফুটবলার গড়ার কারিগর হিসাবে। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের তুখোড় ফুটবলার আনজাম হোসেন কিংবা ফুটবলার বড় নাজিরের ভাগ্যেও জোটেনি পুরস্কার। জীবদ্দশায় ক্রীড়া পুরস্কার দেখে যেতে পারেননি জাতীয় ফুটবল দলের প্রয়াত কোচ ওয়াজেদ গাজীও।

বীর মুক্তিযোদ্ধা বাস্কেটবলের কাজী কামাল, বিসিবির সাবেক সাধারণ সম্পাদক আমিনুল হক মণি, যুগ্ম সম্পাদক মাহমুদুল হক মানু, মোহামেডান ও বিসিবির ডাকসাইটে সংগঠক তানভীর হায়দার, বাফুফের সাবেক সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী শেখ আকমল হোসেন, প্রথিতযশা ক্রীড়া সংগঠক সিরাজুল ইসলাম বাচ্চুর নাম বিবেচনায় আনেনি ক্রীড়া পুরস্কার কমিটি। প্রয়াত এসব সংগঠকদের মূল্যায়ন হয় না।
জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার নিয়ে যখন তদবির-লবিং চলে, তখন নিভৃতচারী ক্রীড়া সংগঠকরা আড়ালেই থেকে যান। বাংলাদেশের খ্যাতিমান ও আলোকিত ক্রীড়াব্যক্তিরা নিজেদের জীবনবৃত্তান্ত কখনই জমা দেন না ক্রীড়া পুরস্কার পাওয়ার আশায়। যারা পুরস্কার দেন তারাও বিবেচনায় আনেন না উজ্জ্বল নক্ষত্রদের। তাদেরই একজন চট্টগ্রামের মরহুম ইউসুফ গনি চৌধুরী। ক্রীড়া পুরস্কারের তালিকায় ওঠেনি তার নাম। ক্রীড়াঙ্গনে সফল সংগঠক হিসাবে পরিচিত মুখ মনজুর হোসেন মালু। প্রথিতযশা এই সংগঠকের নাম ক্রীড়া পুরস্কার বাছাই কমিটি ধর্তব্যেই আনেনি।

অধ্যাপক মো. আবদুর রহমান ক্রিকেট, ফুটবল, কাবাডি, ব্যাডমিন্টন, সাইক্লিং ও শুটিংয়ের মতো অনেক খেলাতেই সংগঠক হিসাবে যুক্ত ছিলেন। কিন্তু জীবনের শেষ দিনেও জাতীয় পুরস্কার পাওয়া হয়নি খুলনার এই ক্রীড়া সংগঠকের। ফুটবল মাঠে ছিলেন ত্রাস। দুর্ধর্ষ সেন্টার হাফ কামরুজ্জামান। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান দলে অপরিহার্য কামরুজ্জামান খেলেছেন ইস্ট পাকিস্তান সফটবল লিগে। ঢাকা ওয়ান্ডারার্সের যুগ্ম সম্পাদক ও কোষাধ্যক্ষ ছিলেন। ছিলেন সোনালী অতীত ক্লাবের সহ-সভাপতি। কিন্তু জাতীয় পুরস্কার পাননি তিনি। ফুটবল খেলেছেন কলকাতা মোহামেডানেও।

ব্যাডমিন্টনে চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন এশিয়ান জুনিয়র চ্যাম্পিয়নশিপে। কালের বিবর্তনে এই অসাধারণ কীর্তি চাপা পড়ে গেছে নূর আহমেদের। ছিলেন ধারাভাষ্যকার। বর্ণময় জীবনের অধিকারী নুর আহমেদ ক্রীড়া পুরস্কার না পাওয়ার আক্ষেপ নিয়েই ইহলোক ত্যাগ করেন। অ্যাথলেটিক্সে দূরপাল্লার দৌড়ে কাজী আলমগীর ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। ষাটের দশকজুড়ে ছিল তার আধিপত্য। পেয়েছেন রাজশাহী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ব্লু। কিন্তু পাননি জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার।
২০২১ সালের জন্য মনোনীতরা

প্রয়াত একেএম নওশেরুজ্জামান (ফুটবল)
গোলাম কুদ্দুস চৌধুরী বাবু (ক্রীড়া সংগঠক)
ফারুক আহমেদ (ক্রিকেট)
আবু মমতাজ সাদ উদ্দিন আহমেদ কিসলু (টেবিল টেনিস)
ইয়াদ আলী (ভলিবল)
রাসেল কবির সুমন (ব্যাডমিন্টন)
নাজমুন নাহার বিউটি (অ্যাথলেটিক্স)
জুয়েল আহম্মেদ (সাঁতার)
একেএম মারুফুল হক (ফুটবল কোচ)
শাহনাজ পারভীন মালেকা (কাবাডি)
২০২২ সালের জন্য মনোনীতরা
মাহবুব আরা বেগম গিনি (অ্যাথলেটিক্স)
মির্জা সালমান ইস্পাহানী (ক্রিকেট সংগঠক)
সৈয়দ রুম্মান বিন ওয়ালী সাব্বির (ফুটবলার)
মেরিনা খানম মেরি (অ্যাথলেটিক্স)
আলফাজ আহমেদ (ফুটবল)
জিএস হাসান তামিম (ক্রিকেট)
রফিকুল ইসলাম কামাল (হকি)
মাহফুজা খাতুন শিলা (সাঁতার)
এনায়েত উল্লাহ খান (ব্যাডমিন্টন)
ইমদাদুল হক মিলন (আরচারি)