ডা.মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ :
আজ ৩০ এপ্রিল পবিত্র মাহে রমজানের  ১৭ তম দিবস। অন্যদিকে মাসের তৃতীয় জুম্মাও। স্বাভাবিকভাবে আজকের দিনটি মুমিনদের কাছে আরও বেশী গুরুত্বপূর্ণ।আজ এ কথাটিও বিশেষভাবে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, এবার ফিতরা সর্বনিম্ন ধরা হয়েছে ৭০ টাকা। সকল মসজিদে আজ রমজানের আরকান আহকাম, ইত্তেকাফ, ইফতারী, সাহারী, তারাবীহ নামাজ, যাকাত-ফিতরা ও দান-সাদকার ফজিলত সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা পেশ করা হবে। ঈমানদার রোজাদারগণ চোখের পানি ফেলে বিনীতভাবে রাব্বুল আলামীনের দরবারে ক্ষমা প্রার্থনা করবেন।
সারাজীবন সিরাতুল মুস্তাকিমের পথে অবিচল থাকার জন্য শপথ গ্রহণ করবেন। এই রমজানে যেমনভাবে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ, তারাবীহ ও অন্যান্য নফল ইবাদতের প্রতি আমরা যত্নবান রয়েছি তেমনভাবে রোজার পরেও এই আমল ধরে রাখা একান্ত জরুরি। নামাজের প্রশিক্ষণ নেয়ার উৎকৃষ্ট সময় এই রমজান মাস।
এ ব্যাপারে তাকিদ দিয়ে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, “(মু`মিন তারাই) যারা অদৃশ্য বিষয়ের ওপর বিশ্বাস করে, নামাজ প্রতিষ্ঠা করে এবং তাদেরকে যে রিজিক দেয়া হয়েছে তা থেকে ব্যয় করে”(সূরা বাকারা-৩)।রসূলুল্লাহ (স.) বলেছেন, হে সাহাবিগণ! যদি তোমাদের কারো দরজার পাশ দিয়ে একটি নদী প্রবাহিত হয়, সেই নদীতে দৈনিক পাঁচবার গোসল করো, তাহলে কি তার শরীরে কোন ময়লা থাকে?তারা জবাব দিলো, না কখনো থাকবে না। রসূলুল্লাহ (স.) বলেন, এরূপই উদাহরণ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের বিনিময়ে আল্লাহ অপরাধসমূহ মুছে দেন (বুখারী, মুসলিম)।
★আজকের জুম্মায় যেই ৪ টি  বিষয়ের আলোচনা হবেঃ-
* ইতিকাফঃ-আল্লাহ্ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘ওয়া আনতুম আকিফুনা ফিল মাসজিদ’ তোমরা মসজিদে ইতিকাফ করো। ইতিকাফ শব্দের অর্থ নিজেকে আবদ্ধ রাখা। শরিয়তের পরিভাষায় ইতিকাফ হলো, মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভের আশায় শর্ত সাপেক্ষে নিয়তসহকারে পুরুষেরা মসজিদে ও নারীরা ঘরের নির্দিষ্ট স্থানে অবস্থান করা। রমজানের শেষ দশক (২০ রমজান থেকে সূর্যাস্তের পূর্ব থেকে শাওয়াল মাসের চাঁদ দেখা পর্যন্ত) ইতিকাফ করা সুন্নতে মুয়াক্কাদায়ে কিফায়া। বিনা প্রয়োজনে অর্থাৎ গোসল, খাবার, প্রস্রাব–পায়খানা ব্যতীত অন্য কোনো অজুহাতে ইতিকাফের স্থান ত্যাগ করতে পারবে না। ইতিকাফ অবস্থায় কোরআন তিলাওয়াত, জিকির, নফল নামাজ ইত্যাদিতে মশগুল থাকবে।*লাইলাতুল কদরঃ-লাইলাতুল কদর হচ্ছে একমনে একটি রাত যে রাতে জেগে ইবাদত–বন্দেগি করলে এক হাজার মাসের ইবাদতের চেয়েও উত্তম বলে পবিত্র কোরআনে উল্লেখ রয়েছে।
এক হাজার মাসের হিসাব করলে কদরের এক রাতের ইবাদত ৮৬ বছর ৪ মাসের সমান। কিন্তু আল্লাহ্ তাআলা তার চেয়েও বেশি বা উত্তম বলেছেন। যে ব্যক্তি কদরের রাতে সওয়ারের আশায় ইবাদত করবে, তার অতীতের গুনাহসমূহ মাফ করে দেওয়া হবে।উম্মুল মুমিনিন হজরত আ​য়েশা সিদ্দিকা (রা.) বলেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ (সা.) আমি যদি কদরের রাত্রি পাই, তাহলে আমি কী দোয়া পড়ব? ‘আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুওউন তুহিব্বুল আফওয়া ফাফু আন্নি’ এই দোয়া পড়বে। হাদিসে আছে, তোমরা রমজানের শেষ দশকের বিজোড় রাত্রিতে (২১, ২৩, ২৫, ২৭ ও ২৯ তারিখ) শবে কদর তালাশ করবে।
★সাদাকাতুল ফিতরঃ-‘সাদাকাহ্’ মানে দান এবং ‘আল-ফিতর’ মানে রোজা ভেঙে পানাহারের বৈধতা। অর্থাৎ পানাহারের বৈধতার সুযোগ প্রাপ্তিতে কিছু দান করা এবং ‘ঈদুল ফিতর’ মানে পানাহারের বৈধতা দানের আনন্দে খুশি। (সূত্র: কাওয়াঈদুল ফিকহ্)
সাদাকাতুল ফিতর মানে নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিকের উপর ঈদুল ফিতরের দিন সুবহে সাদেকের সময় থেকে যে ‘দান’ ওয়াজিব হয়। অন্যভাবে বলা যায়, ঈদুল ফিতরের দিন সুবহে সাদেকের সময় যার নিকট জাকাত ওয়াজিব হওয়া পরিমাণ অর্থ-সম্পদ থাকে শুধু তার উপরই সাদকাতুল ফিতর ওয়াজিব।মূলত মাহে রমজানের রোজা পালনের মাধ্যমে আল্লাহ্ তায়ালার বান্দার প্রতি যে অফুরন্ত নিয়ামত দান করেছেন, তার শোকর হিসেবে এবং রোজা পালনের ত্রুটি বিচ্যুতির ক্ষতিপূরণ বিবেচনায় সাদাকাতুল ফিতর ওয়াজিব করা হয়েছে।* ফিতরা নির্ধারণের রহস্যঃ-সম্প্রীতি ও সহমর্মিতার শিক্ষা প্রদান করে। ধনী-গরিব সকলে যেন ঈদ উৎসবে সমানভাবে আনন্দ উপভোগ করতে পারে সেজন্য এই সাদাকাতুল ফিতরা নির্ধারণ করা হয়েছে।
ফিতরা মূলত রোজার জাকাত। জাকাত যেমন মালকে পবিত্র করে, ঠিক তেমনি ফিতরাও রোজাকে পবিত্র করে।এ প্রসঙ্গে ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, রাসূল (সা.) সদকায়ে ফিতর নির্ধারণ করেছেন রোজাকে অনর্থক কথা ও অশ্লীল ব্যবহার হতে পবিত্র করার এবং গরিবের মুখে অন্ন দেওয়ার জন্য। (সূত্র : মেশকাত: আবু দাউদ)
ওয়াকি ইবনুল জাররাহরা বলেন, সিজদায়ে সাহু যেমন নামাজের ক্ষতিপূরণ, তেমনি সাদাকাতুল ফিতর রোজার ক্ষতিপূরণ।
* ফিতরা কার উপর ওয়াজিবঃ-
নিসাব পরিমাণ তথা সম্পদশালী ব্যক্তির নিজের পক্ষ থেকে, নাবালক সন্তানদের পক্ষ থেকে সাদাকাতুল ফিতর ওয়াজিব হয়। পরিবারস্থ স্ত্রী, কন্যা ও রোজগার বিহীন সাবালক সন্তানের পক্ষ থেকে সাদাকাতুল ফিতর প্রদান করা উত্তম। তবে ওয়াজিব নয়। (সূত্র: হিদায়া, আলমগীরী-১)
*ফিতরার পরিমাণঃ-এর পরিমাণ ছোট-বড়, নারী-পুরুষ প্রত্যেকের পক্ষ থেকে আধা সা’ গম-আটা বা এক সা’ যব, কিশমিশ, খেজুর, চাল, বাজরা, ভুট্টা ইত্যাদি বা তার মূল্য। (সূত্র: শামি-২)নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক বলতে জীবিকা নির্বাহের আবশ্যকীয় উপকরণ যথা আবাস গৃহ, পরিধেয় বস্ত্র, খাদ্য দ্রব্য, ঘরের ব্যবহার্য সরঞ্জামাদি ব্যতীত সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ (৮৮ গ্রাম সোনা) বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপা (৬১৩ গ্রাম) অথবা সম পরিমাণ নগদ অর্থ বা সম্পদ থাকাকে বোঝায়। ( সূত্র: আলমগীরী-১, শামি-২)বর্তমান হিসাব মতে, এক সা মানে (৩.৩০০ কেজি) তিন কেজি ৩০০ গ্রাম এবং আধা সা মানে (১.৬৫০ গ্রাম) এক কেজি ৬৫০ গ্রাম। জাকাতের অনুরূপ সাদাকাতুল ফিতরের ক্ষেত্রে পুরো বছর নিসাবের মালিক থাকা আবশ্যক নয়। কেবল ঈদুল ফিতরের দিন সুবহে সাদেকের পূর্বে মুহূর্তে নিসাব পরিমাণ মাল থাকা বিবেচ্য।
★যাকাতঃ-ধন-সম্পদের সঙ্গে আল্লাহপাক যেসব বিধি-বিধান রেখেছেন তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল যাকাত। দেহের সঙ্গে সম্পর্কিত ইবাদতের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল নামাজ, আর সম্পদের সঙ্গে সম্পর্কিত ইবাদতের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল যাকাত। এই নামাজ আর যাকাত এতই গুরুত্বপূর্ণ যে, এ দুটোকে মুসলমান হওয়ার আলামত হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।রাসূল (সা.) এর যুগে সাহাবায়ে কেরামকে জেহাদের জন্য বিভিন্ন জায়গায় পাঠানো হত। তাদেরকে বলে দেয়া হত যে, তোমরা যুদ্ধ করতে থাকবে, যতক্ষণ পর্যন্ত তারা ঈমান না আনে এবং নামাজ না পড়ে আর যাকাত না দেয়। এতে বোঝা যায় যে, কাফেরদের বিরুদ্ধে জেহাদ চলতে থাকবে, যতক্ষণ পর্যন্ত তারা ঈমান না আনবে, নামাজ না পড়বে এবং যাকাত না দিবে। অর্থাৎ এই তিনটা কাজ যতক্ষণ না করবে, ততক্ষণ তাদেরকে মুসলমান বলে গণ্য করা হবে না।
যদি শুধু মুখে বলে আমি মুসলমান, কিন্তু দেখা গেল নামাযেরও ধারে-কাছে নেই, যাকাতেরও ধারে-কাছে নেই, তাহলে সঠিক মুসলমান হিসেবে বিবেচনা করা হবে না এদেরকে। কেউ যদি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত নামাজ ও যাকাতের ধারে-কাছে না থাকে, তাহলে তাকে কীভাবে মুসলমান হিসেবে বিবেচনা করা যাবে? সারকথা হল যে নামাজ পড়বে না, যাকাত দিবে না সে যেন মুসলমানই না।নামাজ ও যাকাতের গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি হওয়ার কারণে কোরআন শরীফে এ দুটো ইবাদতের কথা সবচেয়ে বেশি সংখ্যক বার উল্লেখ করা হয়েছে। কোরআনের প্রায় ৮০ জায়গায় নামাজের কথা এবং ৩২ জায়গায় যাকাতের কথা বলা হয়েছে। এ দু’টো আমল তরক করার শাস্তি অনেক কঠিন।যাকাত না দেয়ার শাস্তি সম্পর্কে কোরআন শরীফে বলা হয়েছে : ‘যারা স্বর্ণ-রূপা বা টাকা-পয়সা সঞ্চয় করে রাখে, আল্লাহর রাস্তায় তা ব্যয় করে না, তাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সুসংবাদ দিয়ে দাও।’ এই যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি কী তা বয়ান করে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন : ‘ওই স্বর্ণ-রূপা জাহান্নামের আগুনে দগ্ধ করা হবে এবং তা দ্বারা তাদের কপালে, পাঁজরে পিঠে (অর্থাৎ শরীরের বিভিন্ন স্থানে) দাগ দেয়া হবে এবং বলা হবে যে, নিজেদের জন্য এটা সঞ্চয় করে রেখেছিলে এটাতো তাই। এখন তার স্বাদ চেখে দেখ, কত মজা!’
যাকাত আদায় না করার আরও অনেক রকম শাস্তি রয়েছে। এক হাদীছে রাসূল (সা.) বলেছেন: ‘যে ব্যক্তি সম্পদের যাকাত না দেয়, কেয়ামতের দিন তার সম্পদ বিষাক্ত সাপে রূপ নিয়ে তার গলায় পেঁচিয়ে থাকবে এবং দুই গালে দংশন করতে থাকবে, আর বলতে থাকবে আমি তোমার মাল, আমি তোমার সঞ্চয় করে রাখা সম্পদ।’আমরা যদি যাকাত না দেই, সম্পদের হক আদায় না করি, তাহলে আমাদের শাস্তি হবে। সন্তানের জন্য রেখে যাব, এটা সন্তানের উপকারে আসবে কি না তা নিশ্চিত নয়, কিন্তু সম্পদের হক আদায় না করলে আমার শাস্তি হবে এটা নিশ্চিত। যদি আল্লাহর হুকুম পালন করার পর যা থাকল তা রেখে গেলাম, তাহলে আশা করা যায় আল্লাহপাকের রহমতে আমাদের সেই রেখে যাওয়া সম্পদ সন্তানের উপকারে আসবে। তাই যাকাত আদায় না করে সন্তানের জন্য রেখে যাওয়ার চিন্তা করলে নিজের সঙ্গে প্রতারণা করা হবে।আল্লাহপাক মালের (সম্পদ) ৪০ ভাগের ১ ভাগ যাকাত হিসেবে দিতে বলেছেন। অর্থাৎ, শতকরা আড়াই টাকা যাকাত হিসেবে দেয়া ফরজ। অনেকে শতকরা আড়াই টাকা হিসেবে দিতে দিয়ে অনেক টাকা চলে গেল বলে কষ্ট বোধ করেন। কিন্তু ধন-সম্পদের যাকাত দিতে কষ্ট বোধ করা বোকামী। কারণ ধন-সম্পদের আসল মালিক হলেন আল্লাহ তা’আলা। আমরা শুধু এটা নাড়াচাড়া (ব্যবহার) করার মালিক।
মনে রাখতে হবে- সম্পদ আল্লাহর অনুগ্রহে অর্জিত হয়ে থাকে, মানুষ নিজের বাহুবলে, মেধাবলে, জ্ঞানবলে সম্পদ উপার্জন করতে পারে না।  তাই সম্পদ আল্লাহর মেহেরবানী, সম্পদ আল্লাহর অনুগ্রহ এ কথাটা ভোলা উচিত নয়। সকাল বেলার বাদশাহকে আল্লাহ বিকেল বেলায় ফকির করে দিতে পারেন- এ কথাটাও মনে রাখা দরকার।কাজেই আল্লাহ যেভাবে সম্পদ ব্যয় করতে বলেছেন, সেভাবেই ব্যয় করা উচিত। তাহলেই আল্লাহ সম্পদে বরকত দিবেন। তাহলেই সম্পদ টিকে থাকবে। অতএব, যাকাত দিলে, আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করলে আখেরাতেও ফায়দা, দুনিয়ায়ও ফায়দা।
পরিশেষে, আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে রমজানের ফজিলত ও বিশেষ বেশিষ্ট্যগুলো যথাযথভাবে পালনের তাওফিক দান করুন। রমজানের রহমত বরকত মাগফেরাত ও নাজাত লাভে তাওফিক দান করুন। আমিন।
লেখক, এম এ কামিল হাদিস ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকা
কো-চেয়ারম্যান, হোমিও বিজ্ঞান গবেষণা ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র।