বর্তমান সময়ের ব্যাংকিং ব্যবস্থায় ব্যাবসায়িক লেনদেনের অন্যতম মাধ্যম হলো চেক যার ব্যবহার আমারা প্রাত্যহিক জীবনেও সচরাচর করে থাকি। বর্তমানে চেকের ব্যবহার যেরূপ বৃদ্ধি পেয়েছে অনুরূপভাবে প্রায়সই আমরা শুনে থাকি যে চেক ডিসঅনার হয়েছে। চেক ডিসঅনার সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয় নিস্পত্তি হয় হস্তান্তরযোগ্য দলিল আইন-১৮৮১ [The Negotiable Instruments Act-1881], ফৌজদারি কার্যবিধি-১৮৯৮ ও তামাদি আইন-১৯০৮ এর প্রদত্ত বিধান অনুযায়ী। চেক ডিসঅনার সংক্রান্ত সকল বিষয় আমরা এই আর্টিকেলের মাধ্যমে জানার চেষ্টা করব।
চেক বলতে কি বুঝায়ঃ
হস্তান্তরযোগ্য দলিল আইন-১৮৮১ এর ৬ ধারা অনুযায়ী “চেক হলো নির্দিষ্ট ব্যাংকের উপর নির্দেশিত একটি বিনিময় বিল যা পরিশোধের জন্য উপস্থাপিত হলেই কেবল পরিশোধযোগ্য হবে” অর্থাৎ চেক হল এমন একটি হস্তান্তরযোগ্য দলিল যার মাধ্যমে ব্যাংকের আমানতকারি লিখিত ও শর্তহীনভাবে ব্যাংক-কে চেকের বাহককে নির্দিষ্ট পরিমান অর্থ প্রদানের নির্দেশ প্রদান করে থাকে এবং তা উপস্থাপিত হলে ব্যাংক আইনত অর্থ পরিশোধে বাধ্য থাকে।
চেকের প্রকারভেদঃ
চেক প্রধাণত দুই প্রকারের হয়ে থাকে-
ক. বাহক চেক বা Bearer Cheque: বাহক চেক ব্যাংকে উপস্থাপনের মাধ্যমে যেকোন লোক টাকা সংগ্রহ করতে পারে।
খ. আদেশ চেক বা Order Cheque: আদেশ চেকের মাধ্যমে কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে বা আদেশ অনুসারে অপর কোন ব্যক্তিকে অর্থ প্রদানের জন্য ব্যাংকের প্রতি নির্দেশ দেয়া হয়।
বাহক ও আদেশ চেক-কে আবার দুই ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে-
১. খোলা চেক বা Open Cheque
২. দাগকাটা চেক বা Crossed Cheque। সাধারণত এধরণের চেকের উপরে আড়াআড়ি দু’টো দাগ কাটা থাকে এবং এধরণের চেকের পেমেন্ট সরাসরি কাউণ্টারে না হয়ে কোন ব্যাংকের একাউন্টে প্রদানের মাধ্যমে হয়ে থাকে।
চেক যখন ডিসঅনার হয়ঃ
একটি চেক বিভিন্ন কারণে ডিসঅনার হতে পারে। যেমনঃ একাউন্টে চেক উল্লেখিত পরিমাণ টাকা না থাকা, স্বাক্ষরের গরমিল, চেকে উল্লেখিত অর্থের অংক ও কথার মিল না থাকা, চেকের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে, চেক পোস্টডেটেড হলে, চেকদাতা কর্তৃক অর্থ পরিশোষধে নিষেধ করা হলে, চেকে কাটাকাটি বা ঘষামাজা থাকলে বা একাউন্ট বন্ধ থাকলে ইত্যাদি কারণে চেক ডিসঅনার হয়ে থাকে।
সহজ ভাষায় বলতে গেলে, চেকের সংজ্ঞা অনুযায়ী চেক ব্যাংকে উপস্থাপিত হওয়ার পর যেখানে অর্থ পরিশোধ করার কথা সেখানে ব্যাংক যখন কোন চেক অনার না করে অর্থাৎ অর্থ পরিশোধ না করেই ফেরত দেয় তখন তাকে চেক ডিসঅনার বলে। তবে আমদের দেশের ব্যাংক গুলো প্রধাণতঃ দু’টি কারণে রিটার্ণ মেমো প্রদানের মাধ্যমে চেক ডিসঅনার করে থাকেন। যথাঃ
১. অপর্যাপ্ত তহবিল ও
২. স্বাক্ষরের ভিন্নতা।
একটি চেক নগদায়নের জন্য ব্যাংকে উপস্থাপনের সময়সীমাঃ হস্তান্তরযোগ্য দলিল আইন-১৮৮১ এর ১৩৮ ধারা অনুযায়ী, চেক ইস্যু হওয়ার তারিখ হতে ৬ মাসের মধ্যে অথবা চেকের বৈধতা বিদ্যমান থাকাকালীন সময়ের মাঝে যেটা আগে ঘটে সে-সময়ের মধ্যে চেক নগদায়নের জন্য ব্যাংকে উপস্থাপন করতে হবে।
চেক ডিসঅনার হলে করণীয়ঃ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে চেক ব্যাংকে উপস্থাপনের পরে যদি চেকটি ডিসঅনার হয় তখন ব্যাংক চেক ডিসঅনারের একটি রিটার্ণ মেমো প্রদান করে থাকে। চেক ডিসঅনার হলেই সরাসরি মামলা দায়ের করা যায় না। চেক ডিসঅনার হওয়ার পরবর্তী ধাপগুলো নিম্নরূপঃ
নোটিশ প্রদানঃ চেক ডিসঅনার হওয়ার তারিখ হতে ৩০ দিনের মধ্যে উল্লেখিত টাকা ফেরত দেয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বরাবর লিগ্যাল নোটিশ প্রদান করতে হবে। উল্লেখ্য যে, কোন চেক যদি একাধিকবার উপস্থাপনে পর ডিসঅনার হয় তাহলে সর্বশেষ ডিসঅনার হওয়ার তারিখ হতে ৩০ দিনের মধ্যে নোটিশ দিতে হবে। তবে চেক ডিসঅনারের জন্য কোন চেক ব্যাংকে একাধিকবার উপস্থাপনের কোন বাধ্যবাধ্যকত নেই। নোটিশে উল্লেখিত টাকা প্রদানের জন্য নোটিশ-গ্রহীতা ৩০ দিন সময় পাবেন (হস্তান্তরযোগ্য দলিল আইন-১৮৮১ এর ১৩৮ ধারা)।
নোটিশে যে সকল বিষয় উল্লেখ থাকা বাঞ্চনীয়ঃ নোটিশে মুসাবিদাকারী অ্যাডভোকেট, চেক গ্রহীতা তথা বাদী ও চেক দাতার তথা বিবাদীর নাম ও ঠিকানা, পাওনা টাকার পরিমাণ, চেক নাম্বার ও প্রদানের তারিখ, চেক নগদায়নের জন্য ব্যাংকে জমা দেয়ার তারিখ ও ব্যাংকের নাম, চেক ডিসঅনার হওয়ার তারিখ ও কারণ, ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিবরণ, আইনজীবীর স্বাক্ষর, তারিখ ও সীলমোহর থাকবে।
হস্তান্তরযোগ্য দলিল আইন ১৮৮১ এর ১৩৮ ধারা অনুযায়ী নোটিশ ৩টি উপায়ে জারি করা যেতে পারে। যথাঃ
ক. ব্যাক্তিগতভাবে যার বরাবর নোটিশ প্রদান করা হয় তার উপর জারি করে।
খ. নোটিশ গ্রহীতা যেখানে নিয়মিত বসবাস বা ব্যবসা করেন সেই ঠিকানায় প্রাপ্তিস্বীকার পত্রসহ রেজিস্ট্রি ডাকযোগে প্রেরণ করে।
গ. বহুল প্রচারিত একটি জাতীয় বাংলা দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশের মাধ্যমে।
কখন চেক ডিসঅনারের মামলার কারণ উদ্ভব হয়ঃ
যেকোন মামলা দায়েরের প্রধাণ শর্ত হলো মামলার কারণ তথা Cause of Action থাকা। চেক ডিসঅনারের মামলার কারণ কখন উদ্ভব হয় তা হস্তান্তরযোগ্য দলিল আইন-১৮৮১ এর ১৩৮(১)সি ও ১৪১বি ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে- চেক দাতা নোটিশ প্রাপ্তির ৩০ দিনের মধ্যে চেকে উল্লেখিত পাওনা টাকা চেক গ্রহীতাকে পরিশোধ করতে ব্যর্থ হলে পরবর্তী ১ মাসের মধ্যে মামলা দায়েরের কারণ উদ্ভব হয়েছে বলে গণ্য হবে। অর্থাৎ একটি চেক ডিসঅনার হওয়ার সাথে মামলা করা যায় না এক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট সময় অপেক্ষা করতে হয়। সুতরাং ১৩৮(১)বি, ১৩৮(১)সি ও ১৪১বি ধারা অনুযায়ী চেক ডিসঅনারের মামলা দায়ের করার জন্য মামলার বাদী বা চেক গ্রহীতা চেক ডিসঅনার হওয়ার পর থেকে সর্বোচ্চ ৯০দিন পর্যন্ত সময় পেয়ে থাকেন।
চেক ডিসঅনারের মামলা কোথায় করতে হয়ঃ চেক ডিসঅনারের মামলা আধা দেওয়ানী ও আধা ফৌজদারি (Quasi Criminal & Quasi Civil) প্রকৃতির হলেও এধরণের মামলা হস্তান্তরযোগ্য দলিল আইন-১৮৮১ এর ১৩৮ ধারার অধীনে বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ফৌজদারি কার্যবিধি-১৮৯৮ অনুযায়ী সি.আর (Complaint Case) মামলার অনুরূপভাবে দায়ের করতে হয় তবে এধরণের মামলা থানায় করা যায় না। ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯০ ধারার অধীনে বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট চেক ডিসঅনারের মামলা আমলে নিয়ে থাকেন।
আঞ্চলিক এখতিয়ার নির্ধারণঃ চেক যে আদালতের আঞ্চলিক এখতিয়ারভুক্ত ব্যাংকের শাখায় ডিসঅনার হয়ে থাকে সেই এখতিয়ারভুক্ত আদালতে মামলা দায়ের করতে হবে।
চেক ডিসঅনারের মামলায় যেসকল ডকুমেন্টস প্রদান বাঞ্চনীয়ঃ ডিসঅনারকৃত চেকটি, ডিসঅনার সংক্রান্ত ব্যাংক কর্তৃক প্রদত্ত রিটার্ণ স্লিপ, নোটিশের কপি ও ডাক রশিদ প্রাপ্তি রশিদ বা পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তির কপি, অন্যান্য কাগজপত্র যা আদালত কর্তৃক পরিদর্শনের জন্য প্রয়োজন।
চেক ডিসঅনার মামলার বিচারিক আদালতঃ এধরণের মামলা আমলে নেয়ার ক্ষমতা বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেটের থাকলেও বর্তমানে চেক ডিসঅনারের মামলার বিচার করার ক্ষমতা শুধুমাত্র যুগ্ন দায়রা জজ আদালতের।
উল্লেখ্য চেক ডিসঅনারের মামলা জামিনযোগ্য বা আপোষযোগ্য কিনা এ-ব্যাপারে হস্তান্তরযোগ্য দলিলি আইন-১৮৮১ এ সরাসরি কোন কথা বলা নাই। তবে উচ্চ আদালত বিভিন্ন মামলায় আপোষে নিস্পত্তি করার পক্ষে মত দিয়েছেন [Ferozuddin Vs. Ehsan Re-Rolling Mill Ltd. (Criminal) 15 BLC (HCD) Page-384]। অন্যদিকে ফৌজদারি কার্যবিধির ২য় তফসিলের শেষ অধ্যায়ে দণ্ডবিধি ব্যতিত অন্যান্য আইনবিরোধী অপরাধের ক্ষেত্রে শাস্তির পরিমাণ ৩ বছরের কম কারদণ্ডে দণ্ডনীয় হলে সেক্ষেত্রে উক্ত অপরাধ-কে জামিনযোগ্য বলা হয়েছে বিধায় এধরণের মামলা-কে আদালত জামিনযোগ্য হিসেবে জামিন মঞ্জুর করে থাকেন।
চেক ডিসঅনার মামলার শাস্তিঃ হস্তান্তরযোগ্য দলিল আইন-১৮৮১ এর ১৩৮ ধারা অনুযায়ী আদালত চেক ডিসঅনারের মামলায় সর্বোচ্চ ১ বছরের কারাদণ্ড বা চেকে বর্ণিত টাকার ৩ গুণ জরিমানা বা উভয় দণ্ড প্রদান করতে পারেন।
আপীলঃ চেক ডিসঅনারের মামলায় আপীল দায়ের করতে হবে দায়রা জজ আদালতে এবং সেক্ষেত্রে আপীল দায়েরের পুর্বে রায়প্রদানকারী আদালতে আসামী চেকে বর্ণিত টাকার ৫০% টাকা জমা দিবেন।
লেখক- Md. Arif HossainLL.B.(Hons.)[UU] LL.M.[JnU] BTIS [IAU] PGD in VICM (Cont.)
Lecturer, Gazipur Central Law College, Tongi
দৈনিক কলম কথা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।