শেখ খায়রুল ইসলাম, পাইকগাছা (খুলনা) প্রতিনিধি॥ উত্তাল সমুদ্রের ভয়ংকর তরঙ্গের চোখ রাঙ্গানির তোয়াক্কা না করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গহীন সাগরে জাল ফেলে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে। কখনো কখনো ঝড় ঝাঞ্চা আর বনদস্যুদের সাথে লড়তে হয় জীবন বাজী রেখে, তারপরও থেমে নেই এ লড়াই।
কেননা সাগরে মাছ ধরা এদের প্রধান উপজীব্য, এরা সাগর যোদ্ধা। মাঝে মধ্যে এ যুদ্ধে হেরে সলিলসমাধী হয় সাগর বক্ষে। তবুও এতে নেই দুঃখ, নেই বেদনা। এসব নিয়েই সাগরের বুকে নিত্যদিনের পথ চলা তাদের।
এদের দুঃখ প্রাকৃতিক দুর্যোগে নিজেদের ভিটায় অনিরাপদ বসবাসের জন্য। পাইকগাছা উপজেলার কপিলমুনির অদূরে কপোতাক্ষ নদের পাড়ে মামুদকাটি গ্রামে গড়ে উঠা প্রায় পাঁচশ বছরের জেলে পল্লীর জেলেদের মর্মবেদনার কথা সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়। কপোতাক্ষীর পাড়ে এ পল্লীর প্রায় সহস্রাধিক মানুষের নিজ আবাসনে বসবাসের আরেক লড়াইয়ে এরা পরাজিত।
বৈশ্বিক জলবায়ুর পরিবর্তনে প্রকৃতির বৈরিতায় এরা ক্ষতবিক্ষত। ঝড় আর জ্বলোচ্ছাসে এরা বেশী ক্ষতিগ্রস্থ। দেখতে দেখতে বছর অতিবাহিত করলো ঘূর্ণিঝড় আম্ফান। গতবছর এ সময়ে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে আঘাত আনে এই ঘূর্ণিঝড় ।
যার প্রভাব আজও কাটিয়ে উঠতে পারিনি উপকূলবর্তী মানুষগুলো। আজও আঁতকে ওঠে তারা সেই ভয়াল রাতের কথা মনে করে। ঘরে খাবার নেই, মাথার উপরে খোলা আকাশ, পায়ের নিচে হাঁটু সমান লোনা জল সবই যেন এখন তাদের নিত্যদিনের সঙ্গী।
অবহেলিত জনগোষ্ঠীর মানুষগুলো গৃহপালিত পশু নিয়েও একই ঘরে পরিবার নিয়ে বসবাস করতে দেখা গেছে। বছরে জৈষ্ঠ্যের পরেই আসে আষাঢ়। আর এই আষাঢ়ই যেন উপকূলীয় অঞ্চলে এক আতংক সৃষ্টিকারী শব্দ।
তীব্র খাবার পানির সংকট, দু’বেলা খাবারের আহাজারি, ছেলে মেয়ে নিয়ে খোলা আকাশের নিচে বসবাস সকল সমস্যাই যেন সৃষ্টি হয়েছে উপকূলবর্তী মানুষের জন্য। ঘূর্ণিঝড় আম্ফান পরবর্তী সময়ে কথা বলার সুযোগ হয়েছিল দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বেশ কয়েকটি উপকূলীয় উপজেলার মানুষের সাথে। দেখেছি তাদের বুকফাটা কান্না। বুঝেছি তাদের অব্যক্ত কথাগুলো।
উপকূলবাসী ঝড়কে ভয় পাই না, ভয় পাই লাজুক বেড়িবাঁধকে। ঝড়ের থেকে বেশি ক্ষতি হবে যদি বাঁধ ভেঙে লোকালয় প্লাবিত হয়ে যায়। এ কথাগুলে ওই জনপদের একজন বা দু-জন মানুষের নয়। প্রতিটি মানুষই চেয়েছে বেঁচে থাকার লড়াইয়ে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ।
উপকূলীয় ভুক্তভোগী এই পরিবারগুলো যখন রাস্তায় নামে এই বেড়িবাঁধের জন্য তখন তাদের কষ্টের কথাগুলো আসলেই হৃদয় ছুঁয়ে যায়।কিন্তু আমার হৃদয় ছুঁয়ে লাভ কি বলেন ! হৃদয় ছোঁয়াতে হবে সংশ্লিষ্টদের। তাতেই হবে মঙ্গল। কিন্তু এ হৃদয় সবার মন ছুঁয়ে গেলেও তাদের যায় না।
কেন যায় না সে উত্তর কেবল তাদের কাছেই রয়েছে। তারা সময় আসলে প্রতিশ্রুতি দেয়। বাঁধ হবে, খাদ্য সহায়তা হবে, আশ্রয়ের ব্যবস্থা হবে কিন্তু বাস্তবায়নের এই প্রতিশ্রুতির সাথে কোন মিল খুজে পায়না তারা। কেন এই জনপদের মানুষগুলোর কাছে মিথ্যা আশ্বাস দেয়, স্বপ্ন দেখায় সেটা আসলে কারো কাছে বোধগম্য নয়। তাদের এই মিথ্যা আশ্বাস, মধুর বাণী এই অসহায় অবহেলিত মানুষগুলো এখন আর আমলে নেয় না।
তারা সেদিনই বিশ্বাস করবে যেদিন এ কথাগুলোর বাস্তবায়ন ঘটবে। যার কারণে ঘূর্নিঝড় ইয়াসের প্রভাবে কপোতাক্ষর বাড়তি পানি উগরে দিয়েছিল এখানে। দুর্বল ভেড়িবাঁধ ভেঙ্গে প্লাবিত হয় গ্রামটি।
এ জন্য এখানে মাত্র এক কিলোমিটার একটি টেকসই ভেড়িবাঁধ নির্মানের জোর দাবি উঠেছে এলাকার সর্ব মহলে। এদিকে নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে সুপারিশ তুলে ধরে বলা হয়, সুন্দরবনের তীরবর্তী দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলকে দূর্যোগ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা ঘোষণা করে ঝুঁকিতে থাকা বেড়িবাঁধগুলো সংস্কারের উদ্যোগ নিতে হবে।
বাঁধ রক্ষণাবেক্ষনের জন্য জরুরি তহবিল গঠন ও বাঁধ ব্যবস্থাপনায় স্থানীয় সরকারকে সম্পৃক্ত করতে হবে। উপকূলীয় জনগণের নিরাপদ খাবার পানির সমস্যার টেকসই ও স্থায়ী সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
এজন্য এ জনপদের মানুষদের বাঁচাতে জলবায়ু পরিবর্তন ও দুর্যোগকে মাথায় রেখে স্থায়ী, মজবুত ও টেকসই বেড়িবাঁধ পুনঃনির্মাণ করতে হবে। বাঁধের নদীর সাইডে পর্যাপ্ত জায়গা রাখে এবং সেখানে বৃক্ষরোপণ করতে হবে, যেসব স্থানে বারবার বাঁধ ভাঙছে সেইসব স্থান চিহ্নিত করে সেখানে ব্লকের মাধ্যমে কংক্রিটের বাঁধ নির্মাণ করতে হবে, বাঁধ নির্মাণের জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নিজস্ব জমি না থাকলে ক্ষতিপূরণ দিয়ে জমি অধিগ্রহণ করতে হবে, বাঁধ রক্ষণাবেক্ষণের জন্য জরুরী তহবিল গঠন ও বাঁধ ব্যবস্থাপনায় স্থানীয় সরকারকে সম্পৃক্ত করা ও বাঁধ নির্মাণ প্রকল্পে সবধরনের দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে।
জেলে পল্লীর বাসিন্দা শংকর বিশ্বাস বলেন, আমরা ত্রান চাইনা, নিরাপদ ভেড়িবাঁধ চাই, নদীর পাড় আঁকড়ে ধরে আমরা বাঁচতে চাই। ধীবর বধূ জয়ন্তী বিশ্বাস বলেন, আমরা আবাসন সুরক্ষা চাই, চাই পানি বন্দিহীন জীবন। কথা হয় ৬৫ বছরের বৃদ্ধা দিপালী বিশ্বাসের সাথে তিনি জানান, স্বামী সন্তানরা ৬ মাস সাগরের বুকে থাকলেও চিন্তিত নই, তবে এই জেলেপল্লীর অনিরাপদ ভেড়িবাঁধে আমরা আতংকিত।
আমরা খাদ্য চাইনা দীর্ঘ মেয়াদি টেকসই ভেড়িবাঁধ চাই। মামুদকাটি জেলে পল্লীকে আবাসন সুরক্ষা দিতে দেশের বিভিন্ন এনজিও ও সরকারকে এগিয়ে আসার আহবান জানিয়েছেন স্থানীয় সুধী মহল।
জেলেদের বসবাস সাধারণত নদীর কোল ঘেঁষেই তাই শুধু মামুদকাটি নয় দেশের সব জেলেপল্লীর আবাসন সুবিধা ও সুরক্ষা দেয়া অতিব প্রয়োজন বলে তাঁরা মনে করেন। কেননা এই সাগর যোদ্ধারা ঝড়ঝাঞ্চা তরঙ্গ বিক্ষুব্ধ ভয়াল সাগরের গভীর জল থেকে মাছ আহরণ করে একদিকে যেমন দেশের মানুষের আমিষের চাহিদা মেটায় অন্যদিকে সরকারের রাজস্ব আয়ে অবদান রাখে।
দৈনিক কলম কথা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।