রাসুলুল্লাহ (সা.) কোবায় চার দিন অবস্থান করে মদিনার উদ্দেশে বের হন এবং পথে জুমার নামাজ আদায় করে সন্ধ্যার সময় মদিনায় প্রবেশ করেন। নবীজি (সা.)-এর আগমনে মদিনার অলিগলিতে আনন্দের হিল্লোল বয়ে যায়। মানুষ তাঁকে দেখার জন্য রাস্তা-ঘাট ও বাড়ির ছাদে ভিড় করে। চারদিক তাকবির ধ্বনিতে মুখর হয়ে ওঠে। শিশুরা আবৃতি করে, ‘ওই দেখো, সানিয়্যাতুল ওদা আমাদের আকাশে থেকে উদিত হয়েছে পূর্ণিমার চাঁদ!/আল্লাহর পথে আহ্বানকারী যত দিন আহ্বান করবে, তত দিন কৃতজ্ঞতা আদায় করা আমাদের দায়িত্ব/আমাদের মধ্যে প্রেরিত হে মহান রাসুল!
আপনি এসেছেন এমন বিষয় নিয়ে, যা আমাদের অনুসরণ করতেই হবে।’ (মুসলিম উম্মাহর ইতিহাস : ২/২৪) মদিনার ধনী বা দরিদ্র—প্রত্যেক সাহাবি চাচ্ছিলেন রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর বাড়িতে অবস্থান করুন, অতিথি হোন। প্রত্যেকে তাঁর বাড়ি অতিক্রম করার সময় তাঁকে সেখানে অবস্থানের অনুরোধ করছিলেন। এমনকি তাঁরা আবেগতাড়িত হয়ে তাঁর উটনীর রশি ধরে গতি রোধ করতে চাচ্ছিলেন।
তখন মহানবী (সা.) বলেন, তোমরা উটের পথ ছেড়ে দাও। সে আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্দেশপ্রাপ্ত। উটনী বনু নাজ্জারের বসতিতে এসে থেমে যায়। তখন তিনি বলেন, ‘ইনশাআল্লাহ! এটাই হবে আমাদের মানজিল।’ এটা ছিল নবী (সা.)-এর নানাদের বসতি। তখন বনু নাজ্জারের কিশোর-কিশোরীরা তাঁর সম্মানে আবৃতি করে—
‘আমরা বনু নাজ্জার গোত্রের মেয়েরা, কত খুশি ও আনন্দের কথা যে মুহাম্মদ (সা.) আমাদের প্রতিবেশী হয়েছেন।’ তাদের জবাবে নবী করিম (সা.) বলেন, ‘আল্লাহ জানেন আমি তোমাদের ভালোবাসি।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস : ১৮৯৯) বনু নাজ্জারের লোকেরা মহানবী (সা.)-কে অতিথি হিসেবে পেতে আবেদন শুরু করল। তখন আবু আইয়ুব আনসারি ও আসআদ ইবনে জুরারাহ (রা.) উভয়ে নবীজির উটনীর লাগাম ধরেন।
কিন্তু আবু আইয়ুব আনসারি (রা.)-এর বাড়ি নিকটবর্তী হওয়ায় তাঁর আবেদন কবুল করা হলো। (আর-রাহিকুল মাখতুম, পৃষ্ঠা ১৮৩ ও ১৮৯) আবু আইয়ুব আনসারি (রা.)-এর বাড়িটি ছিল দোতলা। রাসুলুল্লাহ (সা.) নিচতলায় থাকতে মনস্থির করেন। কিন্তু নবীজি (সা.)-কে নিচতলায় রেখে তিনি দোতলায় থাকবেন—
এটা তাঁর মনে সায় দিচ্ছিল না। তিনি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে দোতলায় অবস্থানের অনুরোধ করেন। জবাবে নবী (সা.) বলেন, ‘আবু আইয়ুব, আমি আমার ও আমার সাক্ষাত্প্রার্থীদের জন্য নিচতলায় থাকাকেই সুবিধাজনক মনে করি।’ সাহাবি আবু আইয়ুব আনসারি (রা.) খুব বেশি সচ্ছল ছিলেন না। কিন্তু নবীজি (সা.)-এর আদর-আপ্যায়নে, সেবা-যত্নে কোনো ত্রুটি রাখেননি।
তিনি বলেন, “আমরা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জন্য রাতের খাবার প্রস্তুত করে পাঠাতাম। কোনো খাবার ‘অবশিষ্ট’ ফিরলে আমি ও আমার স্ত্রী তা যেখানে নবীজি (সা.) মুখ লাগিয়ে খেয়েছেন, সেখান থেকে খেয়ে নিতাম।” তিনি আরো বলেন, ‘একবার রাতে পানির পাত্র ভেঙে যায়, তখন আমি ও আমার স্ত্রী আমাদের পরিধেয় একমাত্র চাদর দিয়ে পানি মুছে নিলাম। যেন পানি গড়িয়ে নিচে পড়ে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কষ্টের কারণ না হয়।
’ নবীজি (সা.) আবু আইয়ুব আনসারি (রা.)-এর ঘরে সাত মাস অবস্থান করেন। (নবীয়ে রহমত, পৃষ্ঠা ২০২ ও ২০৪) মদিনায় আগমনের পর নবীজি (সা.) একটি মসজিদভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। তিনি একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। ইসলামের ইতিহাসে যা মসজিদে নববী নামে পরিচিত। তিনি মসজিদের স্থান হিসেবে সেই জায়গাটি বেছে নেন, যেখানে আল্লাহর নির্দেশে তাঁর উটনী বসে পড়েছিল। জায়গাটির মালিক ছিল সাহল ও সুহাইল নামক দুই এতিম বালক।
তারা ছিল নবীজি (সা.)-এর মাতৃকূলের আত্মীয়। তিনি মসজিদ নির্মাণ করবেন জানার পর বালকদ্বয় জায়গাটি দান করে দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। কিন্তু নবী (সা.) উপযুক্ত মূল্য পরিশোধ করেই তা গ্রহণ করেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) আবু বকর (রা.)-কে মূল্য পরিশোধের নির্দেশ দিলে তিনি তাদের জমির বিনিময়ে ১০ দিনার প্রদান করেন। মসজিদ নির্মাণের আগে জায়গাটিতে খেজুর শুকানো হতো। তবে সেখানে কিছু খেজুর ও অন্য গাছ ছিল, মুশরিকদের কয়েকটি কবরও ছিল।
মহানবী (সা.) গাছ কেটে, কবর ভেঙে স্থানটিকে সমতল করার নির্দেশ দেন। (সিরাতে মোস্তফা : ১/৪০৯) মসজিদ নির্মাণে কাঁচা ইট, পাথর, কাদা-মাটি, খেজুরগাছের ডাল ও পাতা ব্যবহার করা হয়। মসজিদের দরজার দুই বাহু ছিল পাথরের। দেয়ালগুলো কাঁচা ইট ও কাদা দিয়ে গাঁথা হয়েছিল। ছাদের ওপর খেজুরগাছের ডাল দিয়ে তার ওপর পাতা বিছিয়ে দেওয়া হয়। মসজিদে দরজা ছিল মোট তিনটি। লম্বায় মসজিদটি ছিল এক শ হাত এবং প্রস্থে তার চেয়ে কিছুটা কম।
নবীজি (সা.) নিজে মসজিদে নববীর নির্মাণকাজে অংশগ্রহণ করেন। ইট ও পাথর বহনের সময় তিনি ছন্দোবদ্ধ বাক্যে বলেন, ‘হে আল্লাহ, আখিরাতের জীবনই প্রকৃত জীবন। আপনি আনসার ও মুহাজিরদের ক্ষমা করে দিন। এই বোঝা খায়বারের বোঝা নয়, এই বোঝা আমাদের প্রতিপালকের এবং পবিত্র বোঝা।’ জবাবে সাহাবিরা বলেন, ‘যদি আমরা বসে থাকি আর নবী (সা.) কাজ করেন, তাহলে আমরা পথভ্রষ্টতার কাজ করার জন্য দায়ী হবো।’ (আর-রাহিকুল মাখতুম, পৃষ্ঠা ১৯৩) মসজিদের অদূরে নবীজি (সা.) তাঁর নিজের ও স্ত্রীদের জন্য কয়েকটি কাঁচা ঘর তৈরি করেন।
ঘরগুলো খেজুরগাছের ডাল ও পাতা দিয়েই তৈরি করা হয়। উচ্চতায় ছিল নিচু। হাসান বসরি (রহ.) বলেন, তিনি যখন শৈশবে তাঁর মা ‘খাইরাহ’-এর সঙ্গে উম্মে সালমা (রা.)-এর ঘরে ছিলেন। তখন তিনি ঘরের ছাদ হাত দিয়ে স্পর্শ করতে পারতেন। এমন অনাড়ম্বর ঘরেই তিনি তাঁর জীবন কাটিয়ে দেন। এই ঘরগুলো ছিল নবীজি (সা.)-এর সর্বোচ্চ বিনয় ও দুনিয়াবিমুখতার পরিচয়। কেননা, তখন মদিনা ‘দুর্গ ও আধুনিক বাড়ির শহর’ হিসেবে খ্যাত ছিল। মদিনার মধ্যবিত্ত বহু পরিবারেরও দোতলা বাড়ি ছিল।
মসজিদসংলগ্ন ছোট ঘরগুলো, যা হুজরা নামেই পরিচিত, তা তৈরির পর তিনি আবু আইয়ুব আনসারি (রা.)-এর বাড়ি থেকে স্থায়ীভাবে এখানে চলে আসেন। (আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যাহ, পৃষ্ঠা ৩০১) মসজিদে নববী নির্মাণের পর সেখানে দ্বিনি কাজে প্রাণচাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। আল্লামা সফিউর রহমান মোবারকপুরী বলেন, ‘নবনির্মিত মসজিদ শুধু নামাজ আদায়ের জন্য ছিল না; বরং এটা ছিল একটি বিশ্ববিদ্যালয়।
এতে মুসলিমরা ইসলামের মূলনীতি ও হিদায়াত সম্পর্কে শিক্ষা লাভ করত। এটি এমন এক মাহফিল ছিল যে এখানে গোত্রীয় দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও ঘৃণা-বিদ্বেষে জর্জরিত বিভিন্ন গোত্রের মানুষ পারস্পরিক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যের মধ্যে অবস্থান করত।
মসজিদটি ছিল এমন এক কেন্দ্র, যেখান থেকে নবগঠিত রাষ্ট্রের যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালিত হতো। এখানে থেকে বিভিন্ন যুদ্ধ ও অভিযানে লোক প্রেরণ করা হতো। এতে মজলিসে শুরা (পরামর্শ সভা) ও মজলিসে ইন্তেজামিয়া (ব্যবস্থাপনা সভা) অনুষ্ঠিত হতো।’ (আর-রাহিকুল মাখতুম, পৃষ্ঠা ১৯৪)
দৈনিক কলম কথা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।