প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৬তম অধিবেশনে প্রদত্ত ভাষণে করোনামুক্ত বিশ্ব গড়তে সার্বজনীন ও সাশ্রয়ী মূল্যে টিকা প্রাপ্যতায় যথাযথ বৈশ্বিক পদক্ষেপ দাবি করেছেন। তিনি হুশিয়ার করে দিয়ে বলেন, বর্তমান ‘টিকা-বিভাজন’ প্রবণতা শুধুমাত্র মহামারিকেই দীর্ঘস্থায়ী করবে।

তিনি বলেন, ‘কোভিডমুক্ত বিশ্বের জন্য, আমাদের অবশ্যই বিশ্বব্যাপী সব মানুষের জন্য সার্বজনীন ও সাশ্রয়ী মূল্যে টিকার প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে হবে।’

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শুক্রবার বাংলাদেশ সময় রাতে নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পদাঙ্ক অনুসরণ করে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার দেওয়া ১৭তম বাংলা ভাষণে এসব কথা বলেন।

শেখ হাসিনা ধনী ও দরিদ্র দেশগুলোর মধ্যে টিকা বৈষম্য বৃদ্ধিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, এ যাবৎ উৎপাদিত টিকার ৮৪ শতাংশ উচ্চ ও উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশগুলোর মানুষের কাছে পৌঁছেছে। অন্যদিকে, নিম্নআয়ের দেশগুলো এক শতাংশেরও কম টিকা পেয়েছে।

তিনি বলেন, জরুরিভিত্তিতে এ টিকা বৈষম্য দূর করতে হবে। লাখ লাখ মানুষকে টিকা থেকে দূরে রেখে কখনোই টেকসই পুনরুদ্ধার সম্ভব নয়। আমরা পুরোপুরি নিরাপদও থাকতে পারব না।

শেখ হাসিনা বলেন, অবিলম্বে টিকা প্রযুক্তি হস্তান্তর টিকার সমতা নিশ্চিত করার একটি উপায় হতে পারে। প্রযুক্তি সহায়তা ও মেধাস্বত্ত্বে ছাড় পেলে বাংলাদেশও বিপুল পরিমাণে টিকা তৈরি করতে সক্ষম।

প্রধানমন্ত্রী বর্তমান সময়কে ‘ক্রান্তিলগ্ন’ উল্লেখ করে জাতিসংঘকে ‘ভরসার সর্বোত্তম কেন্দ্রস্থল’ হিসেবে উল্লেখ করেন এবং বিশ্ব নেতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, আসুন সেই ভরসাকে বাঁচিয়ে রাখার প্রত্যয়ে আমরা সবাই হাতে হাত মিলিয়ে একযোগে কাজ করি। বহুপাক্ষিকতাবাদ ও জাতিসংঘ ব্যবস্থার দৃঢ় সমর্থক হিসেবে বাংলাদেশ এই সংকটকালে জাতিসংঘকে আশা ও আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হিসেবে দেখে। সব ধরনের মতভেদ ভুলে গিয়ে আমাদের অবশ্যই ‘অভিন্ন মানবজাতি’ হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়াতে হবে, সম্মিলিত শক্তিকে কাজে লাগিয়ে সবার জন্য আবারও এক সমৃদ্ধ বিশ্ব গড়ে তুলতে হবে।

মহামারি করোনা মোকাবিলার পাশাপাশি, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি মোকাবিলা ও রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনসহ বিভিন্ন ইস্যুতে সুনির্দিষ্ট ৬ দফা প্রস্তাব উত্থাপন করেন তিনি। ফিলিস্তিন ও আফগান সমস্যাও তাঁর আলোচনায় উঠে আসে। এ সময় তিনি রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন ইস্যুতে পুনরায় বিশ্বনেতাদের জোরালো ভূমিকা ও অব্যাহত সহযোগিতা প্রত্যাশা করেন।

দুঃখজনক হলেও এই মহামারি আরও বেশ কিছুদিন স্থায়ী হবে বলে আশঙ্কা ব্যক্ত করে প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে বলেন, এই অভিন্ন শত্রুকে মোকাবিলার জন্য অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন আমাদের অনেক বেশি নতুন, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও বৈশ্বিক পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। এ বিষয়ে তার দেওয়া সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবগুলো হচ্ছে-

প্রথমত, কোভিডমুক্ত একটি বিশ্ব গড়ে তোলার লক্ষ্যে টিকার সর্বজনীন ও সাশ্রয়ী মূল্যে প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে হবে। গত বছর এ মহতী অধিবেশনে আমি কোভিড-১৯ টিকাকে ‘বৈশ্বিক সম্পদ’ হিসেবে বিবেচনা করার আহ্বান জানিয়েছিলাম। বিশ্বনেতাদের অনেকে তখন এ বিষয়ে সহমত পোষণ করেছিলেন।

তিনি বলেন, সে আবেদনে তেমন সাড়া পাওয়া যায়নি। জরুরিভিত্তিতে এ টিকা বৈষম্য দূর করতে হবে। লাখ লাখ মানুষকে টিকা থেকে দূরে রেখে কখনই টেকসই পুনরুদ্ধার সম্ভব নয়। আমরা পুরোপুরি নিরাপদও থাকতে পারব না।
তিনি তাই, সবার জন্য সার্বজনীন ও সাশ্রয়ী মূল্যে টিকার প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে আবারও আহ্বান জানান।

দ্বিতীয় প্রস্তাবে তিনি বলেন, এ মহামারি জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোকে অধিকমাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক ‘ইন্টারগর্ভানমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ’-এর ওয়ার্কিং গ্রুপ-১ এর প্রতিবেদনে আমাদের এ গ্রহের ভবিষ্যতের এক ভয়াল চিত্র ফুটে উঠেছে।

দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে জলবায়ু পরিবর্তনের ধ্বংসাত্মক প্রভাব কাটিয়ে উঠা কঠিন হবে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ধনী অথবা দরিদ্র কোনো দেশই এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া থেকে নিরাপদ নয়। তিনি ধনী ও শিল্পোন্নত দেশগুলোকে কার্বন নিঃসরণ হ্রাস, নিঃসরণের জন্য ক্ষতিপূরণ প্রদান এবং টেকসই অভিযোজনের জন্য অর্থায়ন ও প্রযুক্তির অবাধ হস্তান্তরের আহ্বান জানান।

তিনি বলেন, ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরাম ও ভালনারেবল-২০ গ্রুপ অব মিনিস্টারস অব ফাইন্যান্সের সভাপতি হিসেবে আমরা ‘মুজিব জলবায়ু সমৃদ্ধি পরিকল্পনা- দশক ২০৩০’ এর কার্যক্রম শুরু করেছি। এ পরিকল্পনায় বাংলাদেশের জন্য জলবায়ুকে ঝুঁকির কারণ নয়, বরং সমৃদ্ধির নিয়ামক হিসেবে পরিণত করার কর্মসূচি গৃহীত হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, গ্লাসগোতে অনুষ্ঠিতব্য ‘কনফারেন্স অব পার্টিজ’ (কপ) এর ২৬তম শীর্ষ সম্মেলন আমাদের নতুন নতুন অন্তর্ভুক্তিমূলক পরিকল্পনার পক্ষে সমর্থন আদায়ের অপার সুযোগ করে দিতে পারে। এ সুযোগ কাজে লাগানোর জন্য তিনি সবাইকে আহ্বান জানান।

তৃতীয়ত প্রধানমন্ত্রী বলেন, মহামারির প্রকোপে শিক্ষাব্যবস্থা চরমভাবে বিপর্যস্ত। জাতিসংঘ শিশু তহবিলের তথ্য অনুযায়ী, করোনাকালে আংশিক বা পুরোপুরি বিদ্যালয় বন্ধের কারণে বিশ্বের প্রায় অর্ধেক শিক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নিম্ন আয়ের দেশগুলোর লাখ লাখ ছাত্রছাত্রীর দূরশিক্ষণে অংশগ্রহণের সক্ষমতা ও প্রযুক্তি না থাকায় ভর্তি, স্বাক্ষরতার হার ইত্যাদি অর্জনগুলো হুমকির মুখে পড়েছে।

তিনি বলেন, ডিজিটাল সরঞ্জামাদি ও সেবা, ইন্টারনেটের সুযোগ-সুবিধার সহজলভ্যতা ও শিক্ষকদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে বিনিয়োগ করতে হবে। এ জন্য তিনি জাতিসংঘকে অংশীদারিত্ব ও প্রয়োজনীয় সম্পদ নিশ্চিত করার জন্য আহ্বান জানান।

চতুর্থত তিনি বলেন, কোভিড-১৯ অতিমারির নজিরবিহীন প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে তার দেশ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উত্তরণের পথে রয়েছে। তবে, এ মহামারি অনেক দেশের উত্তরণের আকাঙ্ক্ষাকে বিপন্ন করেছে। স্বল্পোন্নত দেশের টেকসই উত্তরণ ত্বরান্বিত করার জন্য উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে প্রণোদনাভিত্তিক উত্তরণ কাঠামো প্রণয়নে আরও সহায়তা প্রত্যাশা করে। এলডিসি-৫ সম্মেলনের প্রস্তুতিমূলক কমিটির অন্যতম সভাপতি হিসেবে, আমরা আশা করি যে দোহা সম্মেলনের সুনির্দিষ্ট ফলাফল আরও বেশি সংখ্যক দেশকে সক্ষমতা দান করবে, যেন তারা স্বল্পোন্নত দেশের কাতার থেকে টেকসইভাবে উত্তরণ করতে পারে।

তিনি পঞ্চম প্রস্তাবে বলেন, মহামারিকালে প্রবাসীরা অপরিহার্য কর্মী হিসেবে স্বাস্থ্য ও অন্যান্য জরুরি সেবাখাতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন। তারাও সম্মুখসারির যোদ্ধা। তবুও তাদের অনেকে চাকুরিচ্যুতি, বেতন কর্তন, স্বাস্থ্য ও অন্যান্য সামাজিক সেবার সহজলভ্যতার অভাব ও বাধ্যতামূলক প্রত্যাবর্তনের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এই সঙ্কটকালে অভিবাসীগ্রহণকারী দেশগুলোকে অভিবাসীদের সঙ্গে ন্যায়সঙ্গত আচরণ করার এবং তাদের কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্য ও কল্যাণকে নিশ্চিত করার জন্য তিনি আহ্বান জানান।

ষষ্ঠ প্রস্তাবে তিনি রোহিঙ্গা সঙ্কট এবার পঞ্চম বছরে পড়লো উল্লেখ করে বলেন, এখন পর্যন্ত বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমার নাগরিকদের একজনকেও মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি। মিয়ানমারে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে অনিশ্চয়তা তৈরি হলেও এ সমস্যার একটি স্থায়ী সমাধান খুঁজে বের করতে আমরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জোরালো ভূমিকা ও অব্যাহত সহযোগিতা আশা করি। মিয়ানমারকে অবশ্যই তার নাগরিকদের প্রত্যাবর্তনের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে হবে। এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আমরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সহযোগিতা করতে সদা প্রস্তুত।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশে তাদের সাময়িক অবস্থানকে নিরাপদ ও সুরক্ষিত রাখতে বলপূর্বক কিছু সংখ্যক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমার নাগরিককে আমরা ‘ভাষানচর’-এ স্থানান্তর করেছি। আশ্রয় শিবিরে কোভিড-১৯ মহামারির বিস্তাররোধে টিকা লাভের যোগ্য সবাইকে জাতীয় টিকাদান কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

সরকার প্রধান এ সময় দৃঢ় কণ্ঠে বলেন, আগেও বলেছি, আবারও বলছি- রোহিঙ্গা সঙ্কটের সৃষ্টি মিয়ানমারে, সমাধানও রয়েছে মিয়ানমারে। রাখাইন রাজ্যে তাদের মাতৃভূমিতে নিরাপদ, টেকসই ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমেই কেবল এ সঙ্কটের স্থায়ী সমাধান হতে পারে। এ জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অবশ্যই গঠনমূলক উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

শেখ হাসিনা বলেন, আমরা আশা করি আসিয়ানের নেতারা বাস্তুচ্যুত মিয়ানমার নাগরিক ইস্যুতে গৃহীত প্রচেষ্টাকে আরও বেগবান করবেন। অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য দায়ীদের জবাবদিহি নিশ্চিতকরণে গৃহীত সকল কর্মকণ্ডে সহযোগিতা করতে হবে।

প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে বলেন, তার আজীবন নিঃস্বার্থ সংগ্রাম ও দূরদর্শী নেতৃত্ব আমাদের এনে দিয়েছে স্বপ্নের স্বাধীনতা। যাদের অসীম বীরত্ব ও আত্মত্যাগে আমাদের মাতৃভূমি স্বাধীন হয়েছে সেই বীর মুক্তিযোদ্ধাদেরকেও শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন তিনি।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের জাতির পিতা ছিলেন বহুপাক্ষিকতাবাদের একজন দৃঢ় সমর্থক। তিনি জাতিসংঘকে জনগণের ‘আশা-আকাঙ্ক্ষার কেন্দ্র’ মনে করতেন।

আমাদের জাতিসংঘ অভিযাত্রার প্রথম দিনে ১৯৭৪ সালের ২৫-এ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘে প্রদত্ত তার ঐতিহাসিক একমাত্র ভাষণে তিনি এমন একটি বিশ্ব গঠনের আহ্বান জানিয়েছিলেন যেখানে অর্থনৈতিক বৈষম্য, সামাজিক অবিচার, আগ্রাসন ও পারমাণবিক যুদ্ধের হুমকি থাকবে না। ৪৭ বছর আগের তার সে আহ্বান আজও সমভাবে প্রযোজ্য। এ জন্য আমরা অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সমতাভিত্তিক সমাজ গঠনের যেকোনো উদ্যোগে সমর্থন ও নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছি।

তিনি বলেন, করোনাভাইরাসের টিকার ন্যায্য হিস্যা দাবি, ফিলিস্তিনিদের প্রতি যেকোনো ধরনের অবিচারের বিরুদ্ধে আমাদের দৃঢ় অবস্থান, রোহিঙ্গা সঙ্কটের সমাধান, জলবায়ু ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা- এসব আমাদের বৈশ্বিক অঙ্গীকারের কতিপয় উদাহরণ মাত্র।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা একটি শান্তিপূর্ণ, স্থিতিশীল ও সমৃদ্ধ দক্ষিণ এশিয়ার স্বপ্ন দেখি। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, আফগানিস্তানের বিনির্মাণ ও ভবিষ্যতের গতিপথ নির্ধারণ আফগানিস্তানের জনগণের ওপরই নির্ভর করে। আফগানিস্তানের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য দেশটির জনগণ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাথে কাজ করে যেতে বাংলাদেশ সদা প্রস্তুত।

তিনি বলেন, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে শান্তি। ‘শান্তির সংস্কৃতি’ প্রস্তাবনার প্রধান প্রবক্তা হিসেবে আমরা শান্তিময় সমাজ বিনির্মাণে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সন্ত্রাসবাদ ও সহিংস উগ্রবাদের করাল থাবায় বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে শান্তি ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে। তাই আমরা সন্ত্রাসবাদ ও সহিংসতার বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স নীতি’ বজায় রেখেছি। শীর্ষস্থানীয় শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী দেশ হিসেবে বৈশ্বিক শান্তিরক্ষায় অবদানের জন্য আজ আমরা গর্ববোধ করি। মহামারির নজিরবিহীন প্রতিকূলতা সত্ত্বেও আমাদের শান্তিরক্ষীরা বিশ্বজুড়ে কঠিনতম পরিবেশে নিষ্ঠা ও পেশাদারিত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন।

সংবিধানের আলোকে বাংলাদেশ সর্বদা সম্পূর্ণ নিরস্ত্রীকরণের অবিচল সমর্থক উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, পারমাণবিক ও অন্যান্য গণবিধ্বংসী অস্ত্রের সম্পূর্ণ নির্মূলের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব। এই প্রত্যয় থেকেই আমরা ‘পারমাণবিক অস্ত্র নিষিদ্ধকরণ চুক্তি’ অনুস্বাক্ষর করেছি। এ বছরের শুরুতে চুক্তিটি কার্যকর হয়েছে।

এ বছরটিকে বাংলাদেশের জন্য ‘একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বছর’ আখ্যায়িত করে বঙ্গবন্ধু কন্যা বলেন, এ বছর আমরা স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করছি। একইসঙ্গে আমরা আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী ‘মুজিববর্ষ’ উদযাপন করছি।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের অপূর্ণ স্বপ্ন বাস্তবায়নে তার সরকার নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে উল্লেখ করে দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের কিছু চিত্রও তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী।

তিনি বলেন, বাংলাদেশ এখন বিশ্বের দ্রুত বর্ধনশীল পাঁচটি অর্থনীতির মধ্যে অন্যতম। জিডিপি-তে আমরা বিশ্বের ৪১তম। গত এক দশকে আমরা দারিদ্র্যের হার ৩১ দশমিক ৫ থেকে ২০ দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়ে এনেছি। এ সময়ে আমাদের মাথাপিছু আয় তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়ে ২ হাজার ২২৭ মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে। আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ সর্বকালের সর্বোচ্চ ৪৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অতিক্রম করেছি।

তিনি বলেন, গত এক দশকে আর্থসামাজিক খাতে ও নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছে। শিশুমৃত্যু হার প্রতি হাজারে ২৩ দশমিক ৬৭-এ কমে এসেছে। প্রতি লাখ জীবিত জন্মে মাতৃ মৃত্যুর হার ১৭৩-এ হ্রাস পেয়েছে। মানুষের গড় আয়ু বেড়ে হয়েছে ৭৩ বছর।

বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের তথ্য মতে, নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। ২০১৪ সাল থেকে এ সূচকে বাংলাদেশ আঞ্চলিক প্রতিবেশী দেশগুলোর চাইতে এগিয়ে আছে, বলেন তিনি।

তিনি বলেন, ‘টেকসই উন্নয়ন প্রতিবেদন ২০২১’ অনুযায়ী ২০১৫ সাল থেকে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট লক্ষ্যমাত্রার সূচকে বাংলাদেশ অনেক ক্ষেত্রেই এগিয়ে আছে। এ সাফল্যের মূলে রয়েছে নারীর উন্নতি ও ক্ষমতায়নে বিপুল বিনিয়োগ। এ বিনিয়োগ আমাদের রূপান্তর সক্ষম উন্নয়নে বিপুল অবদান রেখেছে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ বছর আমরা স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উত্তরণের মাইলফলক অর্জন করেছি। এখন আমাদের স্বপ্ন বাংলাদেশকে ২০৪১ সালের মধ্যে একটি জ্ঞানভিত্তিক উন্নত দেশ ও ২১০০ সালের মধ্যে সমৃদ্ধ ও টেকসই বদ্বীপে রূপান্তর করা।

বাংলাদেশে কোভিড-১৯ মহামারির প্রকোপ আশঙ্কার চেয়ে অনেক কম হয়েছে, উল্লেখ করে তিনি বলেন, তৃণমূল পর্যায় থেকে আমাদের শক্তিশালী স্বাস্থ্য ব্যবস্থার কারণে এটা সম্ভব হয়েছে। এছাড়া মহামারি মোকাবিলায় আমাদের সময়োচিত, সমন্বিত ও বহুমুখী উদ্যোগ কার্যকর ভূমিকা রেখেছে। জীবন ও জীবিকার ভারসাম্য রক্ষা করতে শুরুতে আমাদের বেশ কিছু কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল। অর্থনীতিকে সচল রাখতে বিভিন্ন সময়ে আমরা ২৮টি প্রণোদনা প্যাকেজের মাধ্যমে প্রায় ১ হাজার ৪৬০ কোটি মার্কিন ডলার বরাদ্দ দিয়েছি, যা মোট দেশজ উৎপাদনের ৪ দশমিক ৪৪ শতাংশ। করোনাভাইরাসের টিকা সংগ্রহের জন্য চলতি অর্থবছরে বাজেটে ১৬১ কোটি মার্কিন ডলারের সংস্থান রাখা হয়েছে।

পাশাপাশি অতি দরিদ্র, বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন, বিদেশফেরত প্রবাসী ও অসহায় নারীদের মতো সমাজের দুর্বলতর জনগোষ্ঠীর জন্যে পর্যাপ্ত উদ্যোগ গ্রহণ করেছে তার সরকার।

তিনি বলেন, গত বছর মহামারির প্রাদুর্ভাবের শুরু থেকে আমরা প্রায় ৪ কোটি মানুষকে নগদ অর্থসহ অন্যান্য সহায়তা দিয়েছি। সময়োচিত পদক্ষেপ ও আমাদের জনগণের বিরূপ পরিস্থিতি মোকাবিলার সক্ষমতার কারণে ২০২০ সালেও আমরা ৫ শতাংশের বেশি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছি।

শেষ করার আগে প্রধানমন্ত্রী সারা বিশ্বে শান্তি ও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার এই মহান সংস্থার সামনে বিগত প্রায় ৪৬ বছর আগে তার পরিবারের সদস্যদের নির্মমভাবে হত্যার বিয়োগান্তক অধ্যায় তুলে ধরেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে একদল বিপথগামী ঘাতক আমার পিতা, বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, আমার স্নেহময়ী মা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, তিন ভাই মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন শেখ কামাল, মুক্তিযোদ্ধা লে. শেখ জামাল, ১০ বছরের শেখ রাসেল, চাচা মুক্তিযোদ্ধা শেখ আবু নাসেরসহ পরিবারের ১৮ জন সদস্য ও নিকটাত্মীয়কে নির্মমভাবে হত্যা করে।

আমি ও আমার ছোটবোন শেখ রেহানা সে সময় বিদেশে অবস্থান করায় বেঁচে যাই। আমাদের ৬ বছর দেশে ফিরতে দেওয়া হয়নি। স্বজন হারানোর বেদনা বুকে নিয়ে বিদেশের মাটিতে নির্বাসিত জীবন কাটিয়েছি।

প্রধানমন্ত্রী ১৯৮১ সালে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর একরকম জোর করেই দেশে ফিরে আসার কথা স্মরণ করে বলেন, দেশে ফিরে আমি মানুষের ভোট ও ভাতের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম শুরু করি। জাতির পিতার স্বপ্ন সুখী-সমৃদ্ধ সোনার বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্যে আজও আমি কাজ করে যাচ্ছি। যতদিন বেঁচে থাকব, মানুষের কল্যাণের জন্য কাজ করে যাব, ইনশাআল্লাহ।

সূত্র : বাসস