আজকের শিশুই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। ভবিষ্যতের বাংলাদেশ এদের হাত দিয়েই সমৃদ্ধ ও উন্নত দেশ হিসেবে গড়ে উঠবে। বর্তমানে শিশুদের কাজকে ঝুঁকিপূর্ণ বলে চিহ্নিত করার একটি চেষ্টা চলছে বিশ্বব্যাপী। বিষয়টি অনেকের কাছে হাস্যকর মনে হয়। বস্তুত একমাত্র শিক্ষা ও খেলাধুলা ছাড়া আর কোনো কাজই শিশুর জন্য নিরাপদ বা স্বস্তিকর হতে পারে না। হওয়া উচিতও নয়।
কিন্তু তারপরও প্রতিদিন লাখ লাখ শিশুকে বাঁচার তাগিদে অবতীর্ণ হতে হচ্ছে জীবিকার কঠিন যুদ্ধে। এটি দরিদ্র দেশগুলোর ললাটলিখন হলেও এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশেও ছিন্নমূল অভুক্ত শিশুর মিছিল দীর্ঘতর হচ্ছে। তফাৎ এটুকুই যে, ওরা অভুক্ত-অসহায় শিশুদের জন্য নিয়মিত খাবার ও আশ্রয়ের ব্যবস্থা করছে আর আমরা করতে পারছি না। ওদের সে সামর্থ্য আছে, যা আমাদের নেই। আবার যতটুকু সামর্থ্য আমাদের আছে, তারও সদ্ব্যবহার হচ্ছে না। বছরের পর বছর ধরে অঢেল অর্থ অপচয় হচ্ছে বহু অপ্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে। দেশে ধনী ও সামর্থ্যবান মানুষের সংখ্যা কিন্তু কম নয়। তারাও এসব ব্যাপারে নির্লিপ্তই বলা যায়। মুখে যতই দারিদ্র্য বিমোচনের কথা বলুক, দাতানির্ভরতার কারণে এনজিওরা পারতপক্ষে তাদের প্রকল্পের বাইরে পা ফেলে না। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেদনাদায়ক ভূমিকাটি হলো ধনী দেশগুলোর। তারা শুধু অস্ত্র ও সমরসজ্জার পেছনে প্রতি বছর যে অর্থ ব্যয় করে, তার একটি ক্ষুদ্র অংশ শিশুদের জন্য ব্যয় করলে পৃথিবীর বর্তমান দৃশ্যপটই বদলে যেতো। কিন্তু তাদের ভূমিকাও মুখ্যত কিছু উপদেশ বিতরণ আর দৃষ্টিনন্দন প্রতিবেদন প্রকাশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। দেখতে হবে প্রতি বছর একটি বিশেষ দিনে পালিত হয় ‘বিশ্ব শিশুশ্রম’ দিবস। এ দিবস পালনের লক্ষ্যমাত্রা ও স্লোগান আন্তর্জাতিকভাবে ঠিক করে দেয়া হয়। যারা করেন, তারাও ভালো করেই জানেন বেশিরভাগ দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশের পক্ষে এর ধারেকাছেও পৌঁছানো সম্ভব নয়। শিশুদের ক্ষেত্রে এ অভিজ্ঞতা আরো নির্মম। তাদের শরীর-মন কোনোটাই ক্ষুধা সহ্য করার উপযোগী নয়। যুক্তি বলুন আর সান্ত্বনাই বলুন, ক্ষুধার একচ্ছত্র দাপটের কাছে সবই অচল, অকার্যকর। ক্ষুধার্ত শিশু খাদ্য চায়। তার মা-বাবার দায়িত্ব হলো তাকে খাদ্য দেয়া। তারা কোথা থেকে আনবে, কীভাবে আনবে— অতশত সে বোঝে না। বোঝার কথাও নয়।
বাবা-মা যখন খাদ্য দিতে পারেন না, তখন প্রকৃতির নিয়মেই বাড়ন্ত শিশুটি খাদ্যের সন্ধানে পা বাড়ায় অনিশ্চিত পথে। সেই পথ যত ঝুঁকিপূর্ণই হোক, ক্ষুধার যন্ত্রণার কাছে সবই তুচ্ছ। শুধু দু’বেলা খাদ্যের বিনিময়ে যে কোনো ধরনের কাজই করতে রাজি হয়ে যায় তারা। এটা হলো মুদ্রার এক পিঠ। অন্য পিঠের চিত্রটিও তেমন ভিন্ন নয়। ক্ষুধার্ত সন্তানের মুখে খাদ্য তুলে দিতে না পেরে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অনন্যোপায় ও অসহায় মা-বাবাই তাদের আদরের সন্তানকে ঠেলে দেন অর্থোপার্জনের বিপদসংকুল অবস্থার দিকে। তাদের কোমল পিঠে তুলে দেন সংসারের বিশাল বোঝা। যখন তাদের ঘাসফড়িংয়ের পেছনে ছুটে বেড়ানোর কথা কিংবা বইখাতা হাতে টলমল পায়ে ছুটে যাওয়ার কথা স্কুলে, তখন বাধ্য হয়ে বিরাটসংখ্যক শিশুকে নামতে হয় কঠিন জীবনযুদ্ধে। এসব শিশুকে শুধু যে নিজের অন্ন জোগাড় করতে হয় তা-ই নয়, নানা কারণে পুরো পরিবারের গুরুভারও বইতে হয় এদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশকে। দেখা যায়, কারো বাবা-মা দুজনই অসুস্থ। কেউবা জন্মের আগেই হয়তো পরিত্যক্ত হয়েছে। গর্ভবতী মাকে ফেলে উধাও হয়ে গেছে জন্মদাতা অপারগ পিতা। আবার মা-বাবার গুরুভার কিছুটা লাঘব করার জন্যও বহু শিশুকে বিসর্জন দিতে হয় তাদের শৈশব। এটা কোনো অতিশয়োক্তি নয়। এ ভয়াবহ বাস্তবতার মধ্যেই অসহায় শিশুগুলোকে নিজের বা পরিবারের জীবন ধারণের জন্য একটি কিছু অবলম্বন বা উপায় খুঁজে নিতে হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেটা তাদের জন্য স্বস্তিকর, স্বচ্ছন্দ ও ঝুঁকিমুক্ত হয় না। কিন্তু তারপরও পেছনে ফেরার কথা কেউ ভাবে না। কারণ, ফেরার পথ যে নেই— সেটা শিশু বয়সেই তাদের জানা হয়ে যায়। সর্বোপরি ক্ষুধার যন্ত্রণা কতটা ভয়াবহ হতে পারে, তা ওইসব হতভাগ্য শিশুর চেয়ে ভালো আর কে জানে! অতএব, আমরা যত কথাই বলি না কেন আর যত নীতিমালাই তৈরি করি না কেন, সেগুলো তাদের জীবনে তেমন কোনো প্রভাব ফেলে না। নীতি কিংবা সুবচন নয়, বাস্তবতাই নির্ধারণ করে দেয় তাদের জীবনের গতিপথ। অপ্রিয় হলেও এ সত্য অস্বীকার করার উপায় নেই।
ভাগ্যবিড়ম্বিত এসব শিশু কী কী কাজ করে— এ প্রশ্ন অবান্তর। বরং তারা কী করে না, সে প্রশ্নই অধিক যুক্তিযুক্ত বলে মনে হয়। বেঁচে থাকার জন্য তাদের কাজ দরকার। যে কোনো কাজ। এ ক্ষেত্রে কোনো বাছবিচার কিংবা মজুরি নিয়ে দরকষাকষির প্রশ্নই আসে না। সে সুযোগে বহু শিশু পাচার হয়ে যায় দেশের বাইরে। একটি অংশ নিয়োজিত হয় ভিক্ষাবৃত্তি, মাদক পাচার, ছিনতাইসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজে। ব্যাপকভাবে যৌন হয়রানির শিকারও হয় অনেকে। আর কাজের কথা যদি বলা যায়, জাহাজ কাটা থেকে শুরু করে ঢালাই বা ওয়েল্ডিং কারখানা, ইটভাঙা থেকে শুরু করে বিড়ি কারখানা, বর্জ্য অপসারণ, গাড়ির হেলপার-ড্রাইভার থেকে শুরু করে মোটর গ্যারেজ পর্যন্ত— কোথায় তারা নেই! এদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ দীর্ঘকাল ধরে কর্মরত কৃষি, গার্মেন্ট, গৃহকর্ম ও হোটেল-রেস্টুরেন্টে। শেষোক্ত কয়েকটি পেশাকে শিশুদের জন্য তুলনামূলক নিরাপদ মনে করা হলেও গৃহকর্মে নিয়োজিত শিশুদের দুর্ভোগের যে সব খবর প্রায়ই পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছে— তা মোটেই স্বস্তিকর নয়। আমাদের মনে রাখতে হবে, ক্ষুধা ও দারিদ্র্য থাকলে শিশুশ্রমও থাকবে। আর শিশুশ্রম থাকলে তাতে কম-বেশি ঝুঁকি থাকবে, থাকবে নানা ধরনের বঞ্চনাও। আইন বা নীতিমালা তৈরি করে কিংবা শাস্তির ভয় দেখিয়ে এটা পুরোপুরি বন্ধ করা যাবে না। জনসচেতনতা সৃষ্টির কথা বলেছেন অনেকে। এটা দরকার। এতে শিশুদের প্রতি সমাজের দায়িত্ব ও মমত্ববোধ কিছুটা হয়তো বাড়তেও পারে। তবে দারিদ্র্যের ভয়াবহতা কমানো না গেলে জনসচেতনতাও খুব একটা কাজে আসবে না। শিশুর জন্য স্কুলে সাময়িকভাবে খাবারের ব্যবস্থা করলেই যে সমস্যা মিটে যাবে তাও নয়। কারণ, আগেই বলা হয়েছে, বহু শিশুকে পরিবারের ভরণ-পোষণের কঠিন দায়িত্বও পালন করতে হয়। মূল কথা, শিক্ষার লক্ষ্য অর্জনই হোক আর শিশুশ্রম নিরসনই হোক, এর সফলতা নির্ভর করছে দারিদ্র্য দূরীকরণের সফলতার ওপর। সেজন্য সেখানেই সর্বমুক্তি নিয়োগ করা উচিত। দারিদ্র্য দূরীকরণ কর্মসূচির অংশ হিসেবে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত শিশুদের জন্য বিশেষ কিছু কার্যক্রমও গ্রহণ করা যেতে পারে। দায়িত্বটি যে সরকারের, তাতে সন্দেহ নেই। তবে সমাজ তথা সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী, শিল্পপতি ও এনজিও এবং আন্তর্জাতিক মহল, বিশেষ করে জাতিসংঘের মতো সংস্থাগুলোরও এ দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। তারপরও বলতে হয়— ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়। পূর্ণিমার মোহনীয় চাঁদও তখন ঝলসানো রুটির মতো মনে হয়। এটা সবার জন্যই সত্য। পেটে ভাত না থাকলে সুস্থ-সবল পরিণত বয়স্ক মানুষও চোখে অন্ধকার দেখে। তখন আর হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। আইন-কানুন-নীতি সব তুচ্ছ হয়ে যায়। লোপ পায় পাপ-পুণ্যের বোধ। তাই ক্ষুধার্ত মানুষের পক্ষে কোনোকিছুই অসম্ভব নয়। ভয়াবহ সব কাণ্ড ঘটিয়ে বসতে পারে তারা, যা স্বাভাবিক মানুষের পক্ষে কল্পনা করাও কঠিন। এমন উদাহরণ আমাদের চারপাশে একেবারে কম নয়। সচরাচর দেখা যায় মা নিজে না-খেয়ে সন্তানের মুখে অন্ন তুলে দেন এবং নিজের জীবনের বিনিময়ে হলেও রক্ষা করেন সন্তানের জীবন। ক্ষুধার জ্বালা সইতে না পেরে সেই মা-ই তার প্রাণপ্রিয় সন্তানকে হত্যা করে নিজেও আত্মহত্যা করছেন— এমন লোমহর্ষক খবরও মাঝেমধ্যে আমাদের শুনতে হয়। এ দেশকে একটি সুখী-সমৃদ্ধশালী দেশ হিসেবে গড়ে তুলে ভাষা, ধর্ম, বর্ণ, নির্বিশেষে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করে জাতীয় অর্জনের সুফল ভোগ করতে হবে। সত্যিকার অর্থে সোনার বাংলা গড়ে তুলতে হবে। পারস্পরিক ভালোবাসা, শ্রদ্ধাবোধ আর পরমতসহিষ্ণুতা দেশপ্রেমেরই অংশ। সহপাঠীদের সাথে উত্তম ব্যবহার, তাদের প্রতি আন্তরিকতা, অপরের দুঃখে পাশে দাঁড়ানো— এসব শিশুদের শেখাতে হবে এবং অভ্যস্ত করতে হবে। দেশের স্বাধীনতা সুরক্ষিত করতে দেশপ্রেম অতিব জরুরি। দেশপ্রেম, মমত্ববোধ, মাতৃত্ববোধ ও ভ্রাতৃত্ববোধের মহান শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ হয়ে স্বীয় দেশের উন্নয়ন, সমৃদ্ধি এবং সুশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় নিয়োজিত হওয়ার মাধ্যমে দেশপ্রেম ফুটে ওঠে। স্বীয় মাতৃভূমিকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কর্মকৌশল উদ্ভাবনে আত্মনিয়োগ করার প্রকৃত শিক্ষা পায়। দারিদ্র্য, নিরক্ষরতা ও অজ্ঞতার অন্ধকার থেকে মুক্ত হয়ে একটি সুখী-সমৃদ্ধশালী শিক্ষিত ও দুর্নীতিমুক্ত দেশ গড়ার ক্ষেত্রে শিশুকাল থেকে দেশপ্রেম গড়ে ওঠা আবশ্যক।
লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট
দৈনিক কলম কথা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।