সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকের বিরুদ্ধে বিভাজন সৃষ্টি, শিশুদের ক্ষতি করা, নিরাপত্তার চেয়ে লাভের দিকে বেশি নজর দেওয়া ও গণতন্ত্র দুর্বল করাসহ নানা ধরনের অভিযোগ উঠেছে। এসবের মধ্যেই একটি প্রচ্ছদ প্রকাশ করল টাইম ম্যাগাজিন। টাইম ম্যাগাজিনের সাম্প্রতিক সংখ্যার প্রচ্ছদে মার্ক জাকারবার্গের একটি ছবি প্রকাশ করা হয়েছে। সেই ছবির ওপর একটি অ্যাপের চিত্রকে বেশি প্রাধান্য দিয়েছে টাইম ম্যাগাজিন।
সেখানে দেখা যায়, মার্ক জাকারবার্গের মুখের ওপর ‘ডিলিট ফেসবুক’ লেখা আইকন। আর সেখানেই দুটি অপশন রয়েছে। এর একটি ‘ক্যান্সেল’ আরেকটি ‘ডিলিট’। গতকাল শুক্রবার ভারতীয় গণমাধ্যম এনডিটিভি এ সংক্রান্ত একটি খবর প্রকাশ করেছে। জানা গেছে, শুক্রবার টাইম ম্যাগাজিন তাদের ভ্যারিফায়েড টুইটার অ্যাকাউন্টে ওই ছবি পোস্ট করেছে।
এদিকে গত ৭ অক্টোবর টাইম ম্যাগাজিন ‘ফেসবুক ইজ হরিবল, নো গুড, ভেরি ব্যাড উইক- অ্যান্ড হোয়াট ইট মিন্স ফর অ্যান্টিট্রাস্ট রিফর্ম’ শিরোনামে একটি লেখা প্রকাশ করে। আর্টিকেলটি লিখেছেন আবি ভিসোউলিস। সেই আর্টিকেলে বলা হয়, সোশ্যাল মিডিয়া জায়ান্ট ফেসবুকের সিভিক মিসইনফরমেশন টিমের সাবেক প্রডাক্ট ম্যানেজার ফ্রান্সেস হিউগেন বলেছেন, ব্যবহারকারীদের নিরাপত্তার চেয়ে কম্পানির মুনাফাকে বেশি গুরুত্ব দেয় ফেসবুক। এছাড়া ফেসবুক তার প্ল্যাটফর্মকে সহিংসতার পরিকল্পনাকারীদের ব্যবহার করা থেকে বিরত রাখতে খুব কম কাজ করেছে।
টাইম ম্যাগাজিনের কাভার ফটোতে বলা হয়েছে, ফেসবুকের যে টিম মুনাফার ওপরে মানুষের স্বার্থকে স্থান দিত, তাদের নিষ্ক্রিয় করে ফেলা হয়েছে। এক সময় ফেসবুক, সিভিক ইন্টিগ্রিটি টিম নিয়োগ করেছিল। কিন্তু কম্পানির বেশ কয়েকটি সিদ্ধান্তে ওই টিমের কর্মীরা খুশি হতে পারেনি। ফলে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে ওই টিম ভেঙে দেওয়া হয়। চলতি সপ্তাহের শুরুতে জাকারবার্গ অবশ্য ফ্রান্সিস হিউগেনের এসব তথ্য ‘একদম সত্য নয়’ বলে দাবি করেছেন।
ফেসবুকে কর্মরত কর্মীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, কেউ কেউ বলছেন- ফেসবুকে এমন বিষয় পোস্ট করা হয় যাতে মানুষের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। এ অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা। পরে তিনি লেখেন, আমার মনে হয় না কোনো সংস্থা এমন কিছু প্রচার করবে যাতে মানুষ ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে। এদিকে ফ্রান্সিস হিউগেন মঙ্গলবার সিনেটরদের সামনে সাক্ষ্য দিয়েছেন যে, ফেসবুক সামাজিক বিভাজনকে বাড়িয়ে তুলেছে এবং কিশোর-কিশোরীদের খাবারের সমস্যাকে বাড়িয়ে দিয়েছে।
ফেসবুক ও সংশ্লিষ্ট অ্যাপগুলো গণতন্ত্রকে দুর্বল করে দিচ্ছে বলেও মন্তব্য করেছেন ফ্রান্সিস হিউগেন। যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটের একটি কমিটির কাছে দেওয়া বক্তব্যে গত মঙ্গলবার ফেসবুকের নানা অসংগতির কথাও তুলে ধরেছেন তিনি। তিনি বলেছেন, ফেসবুকের সিইও মার্ক জাকারবার্গ শুধু মুনাফার দিকেই নজর দিচ্ছেন। ফলে প্ল্যাটফর্মটি শিশুদের ভয়ানক ক্ষতি করার পাশাপাশি বিভাজনকেও উসকে দিচ্ছে। ছড়াচ্ছে ভুল তথ্য। মার্কিন আইন প্রণেতাদের ফেসবুকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আরজি জানান তিনি।
নিজের অভিযোগ পোক্ত করতে হিউগেন কয়েক হাজার পৃষ্ঠার অভ্যন্তরীণ গবেষণার দলিলপত্র তুলে ধরেন। ফেসবুকের সিভিক ইন্টিগ্রিটি ইউনিটের চাকরি ছাড়ার আগে তিনি সেগুলো গোপনে কপি করেছিলেন। সিনেট কমিটির ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান উভয় পক্ষের আইন প্রণেতারা ফেসবুকের বিভিন্ন বিষয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। ডেমোক্র্যাট সিনেটর এবং শুনানির আয়োজনকারী উপকমিটির সভাপতি রিচার্ড ব্লুমেন্টাল বলেন, ‘ফেসবুক জানে তাদের পণ্যগুলো সিগারেটের মতো আসক্তি সৃষ্টি করে। আমাদের শিশুরাই এর শিকার হচ্ছে।’
তিনি জাকারবার্গকে কমিটির সামনে এবং সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন ও ফেডারেল ট্রেড কমিশনের কাছে কম্পানির তদন্তের আহ্বান জানান। অনেক আগে থেকেই ফেসবুকের বিরুদ্ধে ব্যবহারকারীদের গোপনীয়তা রক্ষা করতে না পারা এবং ভুয়া, উসকানি ও বিভেদমূলক তথ্য ও বক্তব্য ছড়ানো বন্ধে যথেষ্ট ব্যবস্থা না নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের উভয় প্রধান রাজনৈতিক দলের সিনেটররা বলছেন,
ফেসবুকের পরিবর্তন দরকার। যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী সংবাদপত্র ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের এক খবরে সম্প্রতি বলা হয়, ইনস্টাগ্রামের নিজেদেরই এক গবেষণায় উঠে এসেছে যে এই মাধ্যমটি শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষতি করতে পারে। সিবিএস নিউজকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ফ্রান্সিস হিউগেন বলেছেন, সম্প্রতি তিনি ফেসবুকের বেশ কিছু অভ্যন্তরীণ নথিপত্র ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের কাছে হস্তান্তর করেছেন। হিউগেন বলেন, ‘ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামের কর্মকর্তারা জানেন, কিভাবে মাধ্যমগুলোকে নিরাপদ করা যায়। কিন্তু তাঁরা কোনো পদক্ষেপ নেবেন না।
কারণ তাঁরা জনগণের ভালোর চেয়ে নিজেদের মুনাফার প্রতি বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন।’ মার্ক জাকারবার্গের সমালোচনা করে হাউগেন বলেছেন, ‘তিনি নিজে ছাড়া সেখানে তাঁকে জবাবদিহি করানোর মতো আর কেউ নেই।’ ফেসবুকের একজন মুখপাত্র, কেভিন ম্যাক এলিস্টার বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে ই-মেইলে বলেন, কম্পানি তার ব্যবহারকারীদের মুনাফা বাড়ানোর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে।
এটা বলা ঠিক নয় যে ফাঁস হওয়া অভ্যন্তরীণ গবেষণায় দেখা গেছে যে, কিশোরীদের জন্য ইনস্টাগ্রাম ‘বিষাক্ত’। প্রসঙ্গত, আইওয়া অঙ্গরাজ্যের বাসিন্দা ফ্রান্সিস হিউগেন কম্পিউটার প্রকৌশলে ডিগ্রি ও হার্ভার্ড থেকে ব্যবসা বিষয়ে স্নাতকোত্তর করা ডাটা বিশেষজ্ঞ। ২০১৯ সালে ফেসবুকে যোগ দেওয়ার আগে তিনি ১৫ বছর ধরে গুগল, পিন্টারেস্ট, ইয়েলপসহ বিভিন্ন প্রযুক্তি কম্পানিতে কাজ করেছেন।
সূত্র: টাইম।
দৈনিক কলম কথা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।