বর্তমানে তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে তথ্যপাচারের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে মোবাইল কল, ইমেইল, এসএমএস। প্রতিনিয়ত তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে কোনো দেশের তথ্য হাতিয়ে নিচ্ছে হ্যাকাররা। আগে তথ্য পাচার বা গোয়েন্দগিরির জন্য ব্যবহৃত হতো শান্তির প্রতীক কবুতর। কবুতরকে অনেকদূর নিয়ে ছেড়ে দিলে সহজে পথ চিনে নিজ বাড়িতে ফিরে আসতে পারত এবং সব আবহাওয়ার সঙ্গে সহজে খাপ খাইয়ে নিতে পারত। বর্তমানকালেও তথ্যপ্রযুক্তির চোখ ফাঁকি দিয়ে তথ্য পাচারে কবুতরকে বার্তাবাহক হিসেবে ব্যবহারের অভিযোগ ওঠছে। এমনকি অন্য প্রাণীও ব্যবহার করার ঘটনা ঘটেছে। দেখা গেছে, গুপ্তচরবৃত্তিতে কাজে লাগানো হচ্ছে — এই সন্দেহে ২০০৭ সালে ইরান তাদের একটি পারমানবিক কেন্দ্রের বাইরে থেকে ১৪টি কাঠবিড়ালি আটক করেছিলো। ভিয়েতনামের থান নিয়েন নামে স্থানীয় একটি সংবাদ-ভিত্তিক ওয়েবসাইট লিখছে, ডানায় এবং পায়ে লাল-নীল কালির ছাপ নিয়ে উড়ে আসা কবুতরের ঝাঁক নিয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলো ভিয়েতনামের ডা নাং শহরের কিছু বাসিন্দা। শহরের কিছু লোক ভেবে নেয় নিশ্চয়ই চীন গুপ্তচরবৃত্তির জন্য কবুতরগুলোকে পাঠাচ্ছে। কিছু লোক কবুতরগুলোকে জাল পেতে ধরে পুলিশের কাছে দিতে শুরু করে। গত নভেম্বর থেকে এরকম ১৬টি কবুতর পুলিশের হাতে দেওয়া হয়। কিন্তু তদন্ত করে পুলিশ এখন বলছে কবুতরগুলো আসলে রেসিং পায়রা। পাশের একটি দেশ থেকে উড়ে এসেছে। যেসব রেসিং ক্লাব এগুলোর মালিক, তাদেরকেও সনাক্ত করতে পেরেছে পুলিশ।
যুদ্ধের ময়দানে কবুতর
সামরিক কাজে গোয়েন্দাগিরিতে কবুতর ব্যবহারের পদ্ধতি প্রথম চালু করেছিল পার্সিয়ানরা তারপর রোমানরা। খ্রিষ্টপূর্ব অষ্টম শতাব্দীতে গ্রিকরা অলিম্পিকে চ্যাম্পিয়ন কে হতো, সে খবর কবুতর দিয়ে পাঠাত। কবুতর দিয়ে সবচেয়ে বেশি যোগাযোগ হতো সামরিক ক্ষেত্রে। একাজে ব্যবহৃত কবুতরগুলো ছিল সেনাবাহিনী কর্তৃক বিশেষভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। এদেরও সেনাবাহিনীর মতো কর্নেল, কমান্ডো, ক্যাপ্টেন, মার্শাল প্রভৃতি র?্যাঙ্ক থাকত। সামরিক ক্ষেত্রে একেক কবুতর একেক কাজে ব্যবহার করা হতো। কবুতর পৃথিবীর সবচেয়ে পুরোনো, জনপ্রিয় ও বুদ্ধিমান গৃহপালিত পাখি। ৫ হাজার বছর আগে মেসোপোটেমিয়াম বা তৎকালীন ইরাকে ফলকে পোষা কবুতরের উল্লেখ দেখা যায়। এছাড়া প্রাচীন মিশরীয় চিত্রলিপিতেও কবুতর প্রথম গৃহপালিত পাখি এমন ইংগিত পাওয়া যায়। চীনারা যিশুখ্রিস্টের জন্মের আগে থেকেই বার্তাবাহক হিসেবে কবুতরকে ব্যবহার করত। অষ্টাদশ শতাব্দীতে আরবরা এই কবুতরের মাধ্যমে চিঠিপত্র আদান-প্রদানকে একটি উঁচু শ্রেণির বিদ্যায় পরিণত করেছিল।
গোয়েন্দাগিরি কাজে কবুতর কেন
রেসিং প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া কবুতরগুলো ঘরে ফেরার জন্য ম্যাপ সেন্স ও কম্পাস সেন্স ধরনের দিকনির্দেশনার কৌশল অবলম্বন করে। ম্যাপ সেন্সের ক্ষেত্রে তারা যেখানে বাস করে, সেখানকার ভূমির চিহ্ন ও গন্ধ কাজে লাগায়। কম্পাস সেন্সের ক্ষেত্রে সূর্যের অবস্থান ও গতিবিধির ওপর নির্ভর করে। ২০২০ সালে বেলজিয়ামে একটি নিলামে ১৯ লাখ ইউরো (যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১৬ কোটি টাকা) দিয়ে নিউকিম নামে একটি মাদি রেসিং কবুতর বিক্রি হয়। এর আগের বছর বেলজিয়াম নিলামে আর্মান্ডো নামে একটি নর রেসিং কবুতর ১২ কোটিতে বিক্রি হয়। কবুতরেরা স্বাভাবিকভাবেই তাদের বাসা চেনে এবং দূরে কোথাও গেলে আবার তাদের বাসায় ফিরে আসতে পারে। আর বিশেষ প্রজাতির সংবাদবাহক কবুতরগুলো এ কাজে ছিল আরো দক্ষ। এদেরকে বহু দূরে নিয়ে ছেড়ে দিলেও এরা নিজেদের বাসায় ফিরে আসতে সক্ষম হতো।
যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের প্রশিক্ষিত কবুতর
মানবজতির ইতিহাসে সর্বাধিক রক্তপাত ও ধ্বংসযজ্ঞের সাক্ষী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। মিত্রশক্তি ও অক্ষশক্তি মিলিয়ে এ মারা যায় সাড়ে ৮ কোটি মানুষ। এ যুদ্ধে মানুষের সাহায্যে প্রাণীও অংশ নিয়েছে। দিয়েছে প্রাণও। তেমনি এক প্রাণি কবুতর। যুদ্ধ চলাকালে বার্তা পাঠানো হতো প্রশিক্ষিত কবুতর দিয়ে। সংখ্যার হিসেবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে প্রায় এক লাখ ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রায় আড়াই লাখ কবুতর ব্যবহার করা হয়েছিল বলে কিছু পরিসংখ্যান থেকে ধারণা করা হয়। কাজেই কবুতরের অসাধারণ দক্ষতা আর বুদ্ধিমত্তার বিষয়টি কারো অজানা ছিল না। ‘চের আমি’ নামের এমনই এক কবুতর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সাহসিকতার সাথে খবর পাঠানোর জন্য ‘ক্রইক্স ডি গ্যুরে’ পুরষ্কার পায়। এই কবুতরটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় শত্রুপক্ষের গুলিতে অন্ধ ও একটি পা হারানোর পরও আমেরিকান সৈন্যদের কাছে অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি সংবাদ নিয়ে এসেছিলো। আমেরিকান হিস্টোরি মিউজিয়ামের কিউরেটর পেগি কিডওয়েল উল্লেখ করেন,“দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, ক্ষেপণাস্ত্রের সঠিক লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানার বিষয়ে মার্কিন বাহিনীর একটি গভীর উদ্বেগ ছিল, সেসময়টাতে সামরিক কর্তারা খুব করে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল যে কীভাবে লক্ষ্যগুলোতে নিখুঁতভাবে আঘাত হানা যায়।” সে প্রেক্ষাপটেই, ১৯৪১ সালের জুনে, কবুতরকে ব্যবহার করে কীভাবে একটি মিসাইলকে লক্ষ্যে পৌঁছানো যায়, সেটা নিয়ে স্কিনার আমেরিকার ন্যাশনাল ডিফেন্স রিসার্চ কমিটির কর্তাদের মনোযোগ আকর্ষণ করেন। বিএফ স্কিনার ছিলেন হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ও মনোবিজ্ঞানী।
কমান্ডো: প্রশিক্ষিত কবুতর
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশদের পক্ষে লড়া এক প্রশিক্ষিত বিখ্যাত দক্ষ কবুতর হচ্ছে ‘কমান্ডো’। যুক্তরাজ্যের পশ্চিম সাসেক্সের শহর হেওয়ার্ডস হিথে সিড মুনের- আদর যত্নে বেড়ে ওঠে কমান্ডো। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে মুন কাজ করে আর্মি পিজিয়ন সার্ভিসে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে নিজের কবুতরগুলো উৎসর্গ করেন তিনি। এভাবেই ১৯৩৯ সালে যুদ্ধের ময়দানে আগমন ঘটে কমান্ডোর। প্রায় ১০০ মিশনে অংশ নিয়ে পায়ের সাথে বেঁধে দেয়া ছোট্ট ক্যানিস্টারে বার্তা আনা নেয়া করেছে সে। সেসব মিশনে ছিল শত্রুর গুলিতে প্রাণ হারানো ও লেলিয়ে দেয়া শিকারী পাখির খাবারে পরিণত হওয়ার ভয়। বাজে আবহাওয়া ও অবসন্নতাও কাবু করে দিচ্ছিল অনেক কবুতরকে। তবুও অনেক বার যাতায়াত করেছে জার্মানির অধিকৃত ফ্রান্সে।
কমান্ডোর কৃতিত্বের স্বীকৃতি লাভ
কমান্ডোকে স্মরণীয় করে রেখেছে ১৯৪২ সালের ৩টি মিশন। এসব মিশনে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ফ্রান্সের এজেন্টদের থেকে ব্রিটিশ ইন্টেলিজেন্সদের জন্য দরকারি বার্তা বহন করে কমান্ডো। সেসব তথ্যের মধ্যে রয়েছে জার্মান বাহিনীর অবস্থান, কলকারখানা ও আহত ব্রিটিশ সৈন্যের অবস্থানের তথ্য। এই কৃতিত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ কমান্ডো পেয়েছে পিডিএসএ ডিকিন মেডেল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রাণী সমাজের অবদানকে সম্মান জানাতে ১৯৪৩ সালে এ পদকের যাত্রা। যুদ্ধ শেষে তারকাখ্যাতি লাভ করে বিভিন্ন প্রদর্শনীতে নিয়মিত অংশ নিতে থাকে কমান্ডো। ২০০৪ খ্রিস্টাব্দে কমান্ডোর সেই পদক নিলামে তোলেন মুনের নাতনি ভ্যালেরি থিওবোল্ড। যা বিক্রি হয় ৯২০০ পাউন্ড মূল্যে। (সাড়ে ১০ লক্ষাধিক টাকা)
দৈনিক কলম কথা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।