চলচ্চিত্র অভিনেত্রী রাইমা ইসলাম শিমুকে হত্যার জন্য তার স্বামী সাখাওয়াত আলী নোবেল আরও একজনকে সঙ্গে রেখেছিলেন। তবে নোবেলের সহযোগী সেই হত্যাকারী কে তা এখনো স্পষ্ট করেনি পুলিশ। এদিকে শিমু ও নোবেলের গ্রিন রোডের বাসার সিসিটিভি ফুটেজ যাচাই করে দেখেছে পুলিশ।
রবিবার সকাল ১০টা ০৩ মিনিট থেকে ১০টা ১৭ মিনিট পর্যন্ত ১৪ মিনিটের ফুটেজ পাওয়া যায়নি। পুলিশের ভাষ্য, রবিবার সকালের ওই ১৪ মিনিটের ভিডিও পুরোপুরি অন্ধকার পাওয়া গেছে। বাসার লোকজন সে সময় বিদ্যুৎ না থাকার কথা জানায়। তবে পুলিশ আশপাশের বাসা ও বিদ্যুৎ অফিসে খোঁজ নিয়ে জানতে পারে, ওই দিন এলাকায় বিদ্যুৎ যায়নি।
পুলিশের সন্দেহ, ওই দিন পরিকল্পিতভাবেই ওই ভবনের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। প্রাথমিক তদন্তে পুলিশ জানতে পেরেছে, গ্রিন রোডের বাসায় শিমুকে শ্বাসরোধ করে হত্যার পর রবিবার বন্ধু ফরহাদকে সঙ্গে নিয়ে কেরানীগঞ্জে লাশ ফেলে আসেন নোবেল। ফিরে এসে কলাবাগান থানায় নিখোঁজের জিডি করেন তিনি। সোমবার সকালে শিমুর লাশ উদ্ধারের ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই স্বামী নোবেল ও তার বন্ধু ফরহাদকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
মঙ্গলবার তাদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তিন দিনের জন্য রিমান্ডে পায় পুলিশ। গতকাল রিমান্ডের দ্বিতীয় দিনই হত্যার দায় স্বীকার করে আসামিরা আদালতে জবানবন্দি দিয়েছে তদন্ত-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান। ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) মারুফ হোসেন সরদার জানান,
গতকাল হত্যার দায় স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন শিমুর স্বামী নোবেল ও তার বন্ধু ফরহাদ। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও কেরানীগঞ্জ মডেল থানার এসআই চুন্নু মিয়া বলেন, ‘নোবেল ও ফরহাদকে আমরা জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। গতকাল রিমান্ডের দ্বিতীয় দিনই তারা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। শিমুকে হত্যায় নোবেলের সঙ্গে তার আরেক সহযোগী ছিল বলে আমরা জানতে পেরেছি। তবে তদন্তের স্বার্থে এখনই তার নাম বলতে পারছি না।’
এদিকে শিমুর গ্রিন রোডের বাসার ১৪ মিনিটের ভিডিওর ব্যাপারে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে শিমুর স্বামী নোবেল জানিয়েছেন, রবিবার ভোরে তাদের মধ্যে ঝগড়া হয়। একপর্যায়ে তাদের মধ্যে হাতাহাতি হয়। এর পরই রাগের মাথায় স্ত্রীকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেন। তাদের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে পারিবারিক কলহ চলছিল। ভোরে শিমুকে হত্যার পর বন্ধু ফরহাদকে ফোন করেন নোবেল। পরে তারা দুজন মিলে লাশটি গুম করার চেষ্টা করেন।
রবিবার সকাল ৭টা থেকে ৮টার দিকে শিমুকে গলা টিপে হত্যার পর ফোনে বন্ধু ফরহাদকে ডেকে নেন নোবেল। শিমু ও নোবেলের গ্রিন রোডের বাসার নিরাপত্তারক্ষী মো. তারিক জানান, নোবেলের বন্ধু ফরহাদ প্রায়ই তাদের বাসায় আসতেন। শনিবার রাত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত ফরহাদ ও নোবেলকে তিনি বাসার নিচে গ্যারেজে বিলিয়ার্ড খেলতে দেখেছেন।
রাত ১১টার দিকে তিনি গেটে তালা দিয়ে ঘুমাতে চলে যান। রবিবার সকাল ১০টায় লিফটের সামনে দাঁড়িয়ে তাকে ডেকে পাশের দোকান থেকে নাস্তা নিয়ে আসতে বলেন নোবেল। তখন ফরহাদকে সেখানে দেখা যায়নি। কিন্তু ১০ মিনিটের মধ্যে নাস্তা নিয়ে ফেরার পর গ্যারেজে ফরহাদকে দেখতে পান তারিক। নোবেল নিজেই গাড়িটি চালিয়ে বের হয়ে যান।
সে সময় পাশের সিটে ছিলেন ফরহাদ। বেলা ৩টার দিকে তারা দুজনই গাড়ি নিয়ে আবার বাসায় আসেন। সন্ধ্যার দিকে আবার বের হন। পুলিশ জানিয়েছে, সাভার, আশুলিয়া ও মিরপুর বেড়িবাঁধের দিকে লাশ ফেলার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। পরে কেরানীগঞ্জে লাশ ফেলে আসেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শিমুর এক আত্মীয় বলেন, রবিবার সকাল ৮টা থেকে বিকাল পর্যন্ত তারা সব সিসিটিভি ফুটেজ দেখেছেন।
ফুটেজে তারা ফরহাদকে ঢুকতে দেখেননি। কিন্তু বের হতে দেখেছেন। তিনি জানান, সে রাতে শিমুর বাসায় দুই বেডরুমের একটিতে তার ১৬ বছর বয়সী মেয়ে ঘুমিয়ে ছিল। অন্য কক্ষে ছিল তাদের সাত বছরের ছেলে, শিমু ও নোবেল। ওই কক্ষেই শিমুর সঙ্গে ঝগড়া ও তাকে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছে বলে দাবি করেছেন নোবেল। তবে দুই সন্তানই বলছে তারা কিছুই টের পায়নি। শিমুর ওই আত্মীয়ের ভাষ্য, নোবেল মাদকাসক্ত ছিলেন। বাসার ভিতরেই ইয়াবা, ফেনসিডিল সেবন করতেন।
রবিবার সকালে নোবেল ও ফরহাদ গাড়িতে লাশ নিয়ে মিরপুরে আরেক বন্ধু গনির কাছে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে ফিরে কলাবাগান থানায় নিখোঁজের জিডি করেন নোবেল। পরে তারা তিন বন্ধু মিলেই সবাইকে ফোন করেন। তবে গনিকে এখন পর্যন্ত আটক করা হয়নি।
শিমুর ভাই শহীদুল ইসলাম খোকন বলেন, ‘আমরা শুনেছি নোবেল মেরেছে। কিন্তু সেটা তো এখনো সেভাবে নিশ্চিত না।’ শিমুর সঙ্গে শ্বশুরবাড়ির লোকের সম্পর্ক কেমন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সম্পর্ক ভালো। নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া আছে। শিমু-নোবেলের দুই সন্তানের দায়িত্ব নেওয়ার বিষয়েও দুই পরিবারের লোকজন মিলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’ তবে পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে শিমুর আরেক আত্মীয় জানান,
দুই পরিবারের মধ্যে সম্পর্ক তেমন ভালো নয়। তিনি জানান, অনেক বছর আগে গ্রিন রোডে একটি একতলা ভবনে ভাড়া বাসায় থাকত শিমুর পরিবার। সে সময় বাড়ির মালিকের ছেলে নোবেলের সঙ্গে সম্পর্কে জড়ান শিমু। ২০০৪ সালে তারা বিয়ে করেন। পারিবারিক কলহের বিষয়ে শিমুর ওই আত্মীয়ের ভাষ্য, আট বছর ধরে বেকার ছিলেন নোবেল। আগে তার বাংলামোটরে মোটর পার্টসের ব্যবসা ছিল।
পরে লোকসানের মুখে ব্যবসা গুটিয়ে নেন। শিমুর আয় ও বাসা ভাড়ার টাকায় তাদের সংসার চলত। এ নিয়ে তাদের মধ্যে কলহ ছিল। পুলিশ জানায়, শিমুর লাশ দুটি বস্তায় ভরা ছিল। একটি চটের বস্তা পায়ের দিক থেকে ও আরেকটি বস্তা মাথার দিক থেকে ঢুকিয়ে মাঝ বরাবর প্লাস্টিকের সুতা দিয়ে সেলাই করা হয়েছিল।
তদন্তে নেমে নোবেলের গাড়িতে এক বান্ডিল সুতা পায় পুলিশ। মিলিয়ে দেখা যায়, শিমুর লাশ থাকা বস্তা যে সুতা দিয়ে সেলাই করা হয়েছিল, সেই সুতা আর গাড়িতে পাওয়া সুতা একই রকম। গাড়িটি পুলিশ ধোয়া অবস্থায় পায়। ভিতরের দুর্গন্ধ দূর করতে ব্লিচিং পাউডার ছিটানো হয়েছিল।
দৈনিক কলম কথা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।