নাম তার সিদ্ধার্থ। ভারতজুড়ে নামি কফি বার সিসিডি তথা ক্যাফে কফি ডে- এর কর্ণধার। ঋণের ভারে ব্যবসা সামলাতে ব্যর্থ হয়ে আত্মহত্যা করেন তিনি। অতঃপর তার কোম্পানির দায়িত্ব নেন স্ত্রী মালবিকা। তার অসাধারণ মেধা ও প্রজ্ঞায় মাত্র দুই বছরের মাথায় ঘুরে দাঁড়িয়েছে কোম্পানিটি। আসুন জেনে নিই বাকি গল্প-
করোনা মহামারীর ধাক্কায় ঝাঁপ ফেলতে বাধ্য হয়েছে দেশ-বিদেশের বহু সংস্থা। তবে কোটি কোটি টাকার ঋণের বোঝা সত্ত্বেও সে সময় ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়িয়েছে ভারতের ‘ক্যাফে কফি ডে’। শুধু ঘুরে দাঁড়ানোই নয়। বাড়িয়ে নিয়েছে মুনাফাও। অথচ মহামারীর আগে থেকেই বিপুল অঙ্কের ঋণের ভারে নুয়ে পড়েছিল নতুন প্রজন্মের অনেকের পছন্দের সিসিডি বা ক্যাফে কফি ডে। কীভাবে হাল ফিরল ভারতের বৃহত্তম কফি বার চেইনের?
‘এ লট ক্যান হ্যাপেন ওভার এ কাপ অব কফি’! সংস্থার প্রতিটি আউটলেটেই এই ট্যাগলাইন চোখে পড়ে। অনেকের মতে, ট্যাগলাইনের মতোই আকর্ষণীয় সংস্থার ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প। বাস্তবে সেটাই সম্ভব করেছেন মালবিকা হেগড়ে। সিসিডি’র প্রয়াত কর্ণধার ভি জি সিদ্ধার্থের স্ত্রী!
২০১৯ সালের জুলাইয়ে সিদ্ধার্থের আত্মহত্যার খবরে চমকে উঠেছিল গোটা ভারত। অনিশ্চিত হয়ে পড়েছিল সিসিডি’র ভবিষ্যৎ। একে প্রতিষ্ঠাতা-কর্ণধারের অকালপ্রয়াণ। তার ওপর হাজার ২০০ কোটির ঋণের বোঝা। অর্থনৈতিক দৈন্যদশা কাটিয়ে নিজেকে বাঁচানোই দায় হয়েছিল সংস্থার। সে সময়ই সংস্থার হাল ধরেন মালবিকা।
সিদ্ধার্থের মৃত্যু ছিল রহস্যে ঘেরা। ৩১ জুলাই কর্নাটকের মেঙ্গালুরুর কাছে নেত্রাবতী নদী থেকে উদ্ধার হয়েছিল সিদ্ধার্থের মরদেহ। তার দিন দুয়েক আগেই বেঙ্গালুরু থেকে সকলেশপুরের দিকে গাড়িতে করে রওনা হয়েছিলেন তিনি। মাঝপথে মেঙ্গালুরুর দিকে গাড়ি নিয়ে যেতে বলেছিলেন চালক বাসবরাজ পাটিলকে। নেত্রাবতী নদীর উপরে একটি সেতুতে গাড়ি থামানোর পর চালককে বলেছিলেন, ‘‘একটু হেঁটে আসছি।’’ আর কখনও ফেরেননি সিদ্ধার্থ!
রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হওয়ার পর ভারতজুড়ে তোলপাড় শুরু হয়েছিল। দেশটির প্রাক্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রী তথা কর্নাটকের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী এস এম কৃষ্ণের জামাই সিদ্ধার্থের খোঁজে নেত্রাবতী নদীতে চিরুনিতল্লাশি চালানো হয়েছিল। অবশেষে উদ্ধার হয় তার মরদেহ। তার আগেই পাওয়া গিয়েছিল একটি টাইপ করা চিঠি। তাতে ছিল সিদ্ধার্থের স্বাক্ষর।
তদন্তকারীরা ওই চিঠি থেকে জানতে পারেন, ২০১৯ সালের মার্চ পর্যন্ত সংস্থার ঋণ সাত হাজার ২০০ কোটি রুপি। সংস্থায় বিনিয়োগকারী একটি প্রাইভেট ইকুইটি পার্টনার-সহ অন্যান্যরা যে সিদ্ধার্থের ওপর প্রবল চাপ সৃষ্টি করছেন, তা-ও লেখা ছিল চিঠিতে। পাশাপাশি আয়কর দফতরের বিরুদ্ধেও একাধিক অভিযোগ ছিল তাতে।
সিদ্ধার্থের স্বাক্ষরিত চিঠিতে সিসিডি’র পরিচালন পর্ষদ ও কর্মীদের উদ্দেশে লেখা, “৩৭ বছর ধরে আমি কঠিন পরিশ্রম করেছি। সিসিডি’র মাধ্যমে ৩০ হাজার এবং একটি তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার মাধ্যমে প্রায় ২০ হাজার কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছি। কিন্তু লাভজনক ব্যবসার উপযুক্ত মডেল তৈরি করতে পারিনি।”
ওই চিঠিতে আরও লেখা ছিল, “একটি প্রাইভেট ইক্যুইটি পার্টনারের প্রবল চাপের ফলে মাস ছয়েক আগে এক বন্ধুর কাছ থেকে বিপুল অর্থ ঋণ নিয়ে বাজার থেকে শেয়ার ফেরাতে হয়েছিল। এই চাপ আর সহ্য করতে পারছি না। অন্য ঋণদাতারাও প্রবল চাপ দিচ্ছেন। আয়কর দফতরও আমাকে অন্যায়ভাবে হেনস্থা করেছে। তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা মাইন্ডট্রি’র সঙ্গে আমাদের চুক্তি আটকানোর জন্য আয়কর দফতরের প্রাক্তন ডিজি দু’বার আমাদের শেয়ার বাজেয়াপ্ত করেছিলেন। তারপরে সিসিডি’র শেয়ারেরও দখল নিয়েছিলেন। কিন্তু আমরা নিয়ম মেনেই সংশোধিত আয়কর রিটার্ন পেশ করেছিলাম। আয়করের এই পদক্ষেপের ফলে প্রবল আর্থিক সঙ্কট তৈরি হয়েছিল।”
ব্যক্তিগত জীবনের শোকের আবহেই সিসিডি’র হাল ধরেছিলেন মালবিকা। ২০২০ সালে সিসিডি’র মূল সংস্থা কফি ডে এন্টারপ্রাইজেস লিমিটেড (সিডিইএল)-এর সিইও হন তিনি। যদিও ঋণগ্রস্ত সংস্থার ভবিষ্যৎ নিয়ে সন্দিহান ছিল ব্যবসায়িক মহল। সিইও হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার আগে সংস্থার কর্মীদের উদ্দেশে একটি চিঠি লেখেন তিনি।
চিঠিতে মালবিকা লিখেছিলেন, “সংস্থার ভবিষ্যৎ নিয়ে আমি আশাবাদী। বেশ কয়েকটি বিনিয়োগ করা অংশ বিক্রি করে ঋণের বোঝা নিয়ন্ত্রণযোগ্য স্তরে নামিয়ে আনতে আমরা কাজ করব।”
দু’বছরের মধ্যে সংস্থার ঋণ কমানোর পাশাপাশি ব্যবসাও বাড়িয়েছেন মালবিকা। কাকতালীয়ভাবে, এই চিঠি লেখার কয়েক ঘণ্টা আগেই সিসিডি’র অন্তর্বর্তী তদন্তে জানা গিয়েছিল, সিদ্ধার্থের অ্যাকাউন্ট থেকে গায়েব হয়ে গিয়েছে ২ হাজার ৬৯৩ কোটি রুপি!
মালবিকার জন্ম ১৯৬৯ সালে। রাজনৈতিক পরিবেশে বেড়ে ওঠা। ২০২০ সালে সিইও হওয়ার আগে থেকেই সিডিইএল-এর নন-এগজিকিউটিভ বোর্ড সদস্য হিসেবে কাজ করছিলেন তিনি। বেঙ্গালুরু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি লাভের পর ১৯৯১ সালে সিদ্ধার্থকে বিয়ে করেছিলেন তিনি। দুই ছেলে ঈশান এবং অমর্ত্যকে সামলে কফি ব্যবসার খুঁটিনাটি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকতেন।
লকডাউন চলাকালীন ঋণদাতাদের বিপুল অঙ্কের রুপি ফিরিয়ে দিয়েছেন মালবিকা। সিইও হিসেবে প্রথম বছরেই সাফল্য! ২০১৯ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত সংস্থার ঋণ ছিল সাত হাজার ২০০ কোটি রুপি। পরের আর্থিক বর্ষে অর্থাৎ ২০২০ সালের ৩১ মার্চের মধ্যে তা তিন হাজার ১০০ কোটি রুপিতে নামিয়ে আনা হয়।
২০২১ সালের ৩১ মার্চে সিডিইএল-এর প্রকাশিত রিপোর্টে দাবি করা হয়, এক হাজার ৭৩১ কোটি রুপির ঋণ মেটানো বাকি রয়েছে সংস্থার। ওই রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে, এই মুহূর্তে মোট ঋণের তহবিলে এক হাজার ৭৭৯ কোটি রুপি হয়েছে। তার মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ এক হাজার ২৬৩ কোটি রুপি। ৫১৬ কোটি রুপির স্বল্পমেয়াদী ঋণ রয়েছে।
ঋণদাতাদের টাকা মেটানোর ফাঁকেই ব্যবসা সম্প্রসারণে মন দিয়েছে সিসিডি। এই মুহূর্তে ভারতজুড়ে ৩৩৩টি সিসিডি ভ্যালু এক্সপ্রেস কিয়স্ক-সহ ৫৭২টি ক্যাফের মালিকানা রয়েছে সংস্থাটির। সব মিলিয়ে ৩৬ হাজার ভেন্ডিং মেশিনের মাধ্যমে কফিপ্রেমীদের টানছে সিসিডি।
আপাত অসম্ভবকে সম্ভব করার পথে প্রয়াত স্বামী সিদ্ধার্থের স্বপ্ন সফল করতে চেয়েছেন বলে জানিয়েছেন মালবিকা। তিনি বলেন, “গত ১২ মাস ধরে আমার লক্ষ্যই ছিল সিদ্ধার্থের উত্তরাধিকার বজায় রাখা। আমার জন্য একটা কাজ বাকি রেখে গিয়েছে সিদ্ধার্থ। প্রত্যেক ঋণদাতার প্রতিটি পাইপয়সা ফেরত দেওয়া। নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী তা-ই করতে চেয়েছি। সেই সঙ্গে ব্যবসা বাড়ানো এবং আমাদের কর্মীদের স্বার্থরক্ষাও করার চেষ্টা করেছি।”
কর্মীদের দেওয়া কথা রেখেছেন ৫১ বছরের মালবিকা। সিইও হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার মাত্র দু’বছরের মধ্যেই সিসিডি’র ৭৫ শতাংশ ঋণ মিটিয়ে দিয়েছেন।
সূত্র: আনন্দবাজার
দৈনিক কলম কথা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।