বাগেরহাটের শরণখোলায় মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাইয়ের নামে বিপুল অঙ্কের অর্থ বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে। নতুন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ‘ক’ এবং ‘খ’ তালিকায় অন্তর্ভুক্তির জন্য একেক আবেদনকারীর কাছ থেকে ৫০ হাজার থেকে সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ টাকা নেওয়া হয়েছে। টাকার বিনিময়ে ‘ক’ তালিকায় নাম উঠেছে অমুক্তিযোদ্ধাদেরও। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে চরম অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে এলাকার বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে। প্রতিবাদে আন্দোলনে নেমেছেন তাঁরা। নতুন করে যাচাই-বাছাই করে তালিকা তৈরির দাবি তাঁদের।

দেড় শতাধিক আবেদনকারীর কাছ থেকে তিন কোটি থেকে সাড়ে তিন কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে বাছাই কমিটির সভাপতি এম আফজাল হোসাইন ও সদস্য এম এ খালেক খানের বিরুদ্ধে। তবে তাঁরা অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল ১১টার দিকে শরণখোলা প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন ও সমাবেশ করে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের একাংশ। এর আগে গত মঙ্গলবার মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের কাছে একটি লিখিত অভিযোগ দাখিল করেন তাঁরা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, তালিকা থেকে বাদ পড়া অনলাইনে আবেদন করা মুক্তিযোদ্ধাদের তথ্য যাচাই-বাছাই করতে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা) ১০২ নম্বর স্মারকে শরণখোলায় চিঠি পাঠায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে উপজেলা যাচাই-বাছাই কমিটির সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা এম আফজাল হোসাইন, সদস্যসচিব উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সরদার মোস্তফা শাহিন ও কমিটির সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা এম এ খালেক খান গত ৩০ ডিসেম্বর থেকে ২১ জানুয়ারি পর্যন্ত তালিকা বাছাই করেন।

বাছাই কমিটি ভারতীয় তালিকা, লাল মুক্তিবার্তা ও উপস্থিত সম্মুখযোদ্ধাদের সাক্ষীসহ সবার ঐকমত্যের ভিত্তিতে খসড়া তালিকা প্রস্তুত করে। তবে পরে সেটি বাদ দিয়ে বাছাই কমিটি গোপনে ৩৪ জন ‘অমুক্তিযোদ্ধা’কে অন্তর্ভুক্ত করে ৫৩ জনের নাম (‘ক’ তালিকায়) জামুকায় পাঠায় বলে ভুক্তভোগীদের অভিযোগ। আর এ সবই হয়েছে টাকার বিনিময়ে। ‘খ’ তালিকায় ১০৮ জনের নাম তুলতেও টাকা নেওয়া হয়েছে।

বীর মুক্তিযোদ্ধা হারুন অর রশিদ খান, আ. মালেক জমাদ্দার, আবু জাফর জব্বার ও ইউসুফ আলী হাওলাদার অভিযোগ করে বলেন, যাচাই-বাছাই কমিটির দুই সদস্য (এম আফজাল হোসাইন এবং এম এ খালেক খান) আবেদনকারী দেড় শতাধিক ব্যক্তির কাছ থেকে নাম তালিকাভুক্ত করার নামে সর্বনিম্ন ৫০ হাজার থেকে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত নিয়েছেন। এমনকি যুদ্ধকালীন ভারতে প্রশিক্ষণের সনদের ফটোকপি ৩০-৩৫ হাজার টাকায় বিক্রি করা হয়েছে বলেও অভিযোগ তাঁদের।

বীর মুক্তিযোদ্ধা আ. মালেক মীর, আ. হালিম হাওলাদার, আ. খালেক হাওলাদার, রুহুল আমিন হাওলাদার ও ইউসুফ মুন্সি জানান, প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের বাদ দিয়ে অর্থের বিনিময়ে যে ৫৩ জনের নাম তালিকাভুক্ত করা হয়েছে তাঁদের ৩৪ জনই ‘অমুক্তিযোদ্ধা’ এবং এর মধ্যে অনেকে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী পরিবারের সদস্যও রয়েছেন। এমনকি ১ নম্বর গেজেটের যাচাই-বাছাই করতেও ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে বলে তাঁরা অভিযোগ করেন।

তালিকায় নাম ওঠা দুজন নাম গোপন রাখার শর্তে কালের কণ্ঠকে জানান, তাঁদের একজন তিন লাখ, অন্যজন পাঁচ লাখ টাকা দিয়েছেন।

গতকাল মানববন্ধনে উপস্থিত অনলাইনে আবেদনকারী সুনীল শিকারী বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্তির কথা বলে এক লাখ টাকা নিয়েও আমার নাম বাদ দেওয়া হয়েছে।’

যুদ্ধকালীন সুন্দরবন সাব-সেক্টরের স্টুডেন্ট ক্যাম্প কমান্ডার হেমায়েত উদ্দিন বাদশা মানববন্ধনে বলেন, ‘শরণখোলায় মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাইয়ে চরম দুর্নীতি ও অনিয়ম হয়েছে। যাচাই-বাছাই কমিটির দুই সদস্য বঙ্গবন্ধুর আদর্শ এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের গৌরব ভূলুণ্ঠিত করেছেন। কোটি কোটি টাকার বিনিময়ে স্বাধীনতাবিরোধী চক্রকে প্রতিষ্ঠিত করতে তাঁরা প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এতে আমাদের মাথা হেঁট হয়ে আসে।’ নতুনভাবে যাচাই-বাছাই করে তালিকা তৈরির দাবি জানান তিনি।

জানতে চাইলে উপজেলা যাচাই-বাছাই কমিটির সদস্যসচিব উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সরদার মোস্তফা শাহিন বলেন, কমিটিতে থাকা বীর মুক্তিযোদ্ধা ও উপস্থিত সাক্ষীদের মতামতের ভিত্তিতে তালিকা করে জামুকায় পাঠানো হয়েছে। অনিয়মের বিষয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি অভিযোগ পাওয়া গেছে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা অনুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলে জানান তিনি।

বাছাই কমিটির সভাপতি এম আফজাল হোসাইন ও সদস্য এম এ খালেক খান অর্থ বাণিজ্যের কথা অস্বীকার করে বলেন, অভিযোগকারীদের নিয়ে ৫৩ জনের তালিকা করা হয়েছে। তাঁদের (অভিযোগকারীরা) স্বার্থহানি ঘটায় এখন তাঁদের নামে অপপ্রচার চালাচ্ছেন।

সুত্র- কালের কন্ঠ