ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার পর গত ১৩ দিনে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে টালমাটাল অবস্থায় পড়েছে বিশ্ব। রাশিয়ার তেলের ওপর পশ্চিমা বিশ্বের নিষেধাজ্ঞা আরোপ হলে পুরো ইউরোপে গ্যাস বন্ধের হুমকি দিয়েছে রাশিয়া। এরই মধ্যে বিশ্ববাজারে ব্যারেলপ্রতি অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম ১৩০ ডলারে পৌঁছেছে, তা দ্বিগুণের বেশি বেড়ে প্রতি ব্যারেল ৩০০ ডলারে পৌঁছাতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
কিন্তু পরিস্থিতি ক্রমেই জটিল হচ্ছে, তৃতীয় দফার আলোচনাও শেষ হয়েছে সিদ্ধান্ত ছাড়াই। এরই মধ্যে ইউক্রেনের ২০ লাখ নাগরিক বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। পরিস্থিতি উদ্বেগজনক উল্লেখ করে সবকিছু নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার আগেই সবাইকে সংযম দেখাতে বলেছে চীন। বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়- ইউক্রেনে আগ্রাসনের জেরে রাশিয়াকে আরও চাপে ফেলার জন্য যুক্তরাষ্ট্র তার মিত্রদের সঙ্গে নিয়ে মস্কোর তেলের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের সম্ভাবনা মেপে দেখছে।
তবে জার্মানি ও নেদারল্যান্ডস এ ধরনের পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান করেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন তাদের গ্যাসের ৪০ শতাংশ এবং তেলের ৩০ শতাংশের জোগান পায় রাশিয়া থেকে। এ সরবরাহ হঠাৎ বন্ধ করা হলে সহসাই কোনো বিকল্প উৎস থেকে জোগান দেওয়া সম্ভব নয়। রুশ উপপ্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে এক বক্তৃতায় বলেন, ইউরোপের বাজারে রাশিয়ার তেলের একটি বিকল্প দ্রুত খুঁজে বের করা অসম্ভব। এটা করতে অনেক সময় দরকার এবং ইউরোপের ভোক্তাদের জন্য এটা অনেক বেশি ব্যয়সাপেক্ষ হবে। শেষ পর্যন্ত এর ফলাফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে তারাই।
পশ্চিমারা মস্কোর তেলের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলে জার্মানিতে মূল পাইপলাইনে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দিয়েছে রাশিয়া। দেশটির উপপ্রধানমন্ত্রী আলেকজান্ডার নোভাক বলেছেন, ‘রাশিয়ার তেলের ওপর অবরোধ আরোপ করা হলে আন্তর্জাতিক বাজারে এর ধ্বংসাত্মক প্রভাব পড়বে। তেলের ওপর অবরোধ আরোপ করা হলে এর জবাব দেওয়া হবে। কারণ একই ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সমঅধিকার আমাদেরও আছে এবং বিদ্যমান নর্ড স্ট্রিম ১ গ্যাসপাইপ দিয়ে গ্যাস সরবরাহে নিষেধাজ্ঞা দেব আমরা।’
রাশিয়া বিশ্বের শীর্ষ প্রাকৃতিক গ্যাস উৎপাদনকারী দেশ, ক্রুড অয়েল বা অপরিশোধিত তেল উৎপাদনে তাদের অবস্থান দ্বিতীয়। জ্বালানি খাতে কোনো ধরনের অবরোধ আরোপ করা হলে তা সে দেশের অর্থনীতিকে দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। অবরোধ আরোপের জন্য পশ্চিমা বিশ্বের প্রতি দাবি জানিয়ে আসছে ইউক্রেন, কিন্তু বিষয়টি নিয়ে বিশ্বের অনেক দেশেই উদ্বেগ রয়েছে, কারণ সে রকম পদক্ষেপ নেওয়া হলে আন্তর্জাতিক বাজারে তার প্রভাব হবে ব্যাপক। এমন অবরোধ আরোপের শঙ্কায় সোমবার এক পর্যায়ে ব্রেন্ট ক্রুড অয়েলের দাম ব্যারেলপ্রতি ১৩৯ ডলারে পৌঁছায়, যা গত ১৪ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। যুক্তরাজ্যেও পেট্রোলের গড় দাম লিটারপ্রতি ১৫৫ পেনিতে পৌঁছেছে, যা রেকর্ড।
রয়টার্স জানিয়েছে, মিত্রদের ছাড়াই যুক্তরাষ্ট্র এককভাবে রাশিয়ার তেলের ওপর অবরোধ আরোপ করতে পারে। যদিও সে দেশে রাশিয়া থেকে মাত্র ৩ শতাংশ তেল আমদানি করা হয়। জার্মানির চ্যান্সেলর ওলাফ শুলজ বিস্তৃত পরিসরে অবরোধ আরোপের ধারণা নাকচ করে বলেছেন, ইউরোপ অবরোধের তালিকা থেকে সংগত কারণেই রাশিয়ার জ্বালানি খাতকে ছাড় দিয়েছে, কারণ এ মুহূর্তে অন্য কোনো উপায়ে ওই সরবরাহের ঘাটতি মেটানো সম্ভব নয়। তবে ইউরোপের দেশগুলো ধীরে ধীরে রাশিয়ার জ্বালানি খাতের ওপর এ নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনতে চায়। আলেকজান্ডার নোভাক বলছেন, ‘তেল ও পেট্রোকেমিক্যালের ওপর সম্ভাব্য অবরোধ আরোপ নিয়ে যেসব বিবৃতি ও আলোচনা শুনতে পাচ্ছি তাতে আমরা উদ্বিগ্ন। আমরা দেখছি আমাদের অংশীদাররা, জাহাজ কোম্পানি, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যাপক চাপের মুখে পড়েছে।’
তৃতীয় দফার আলোচনা অগ্রগতি ছাড়াই শেষ : বেলারুশে সোমবার সন্ধ্যায় রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে অনুষ্ঠিত তৃতীয় দফার আলোচনা থেকে প্রত্যাশিত ফল পাওয়া যায়নি। আলোচনা অনেকটা ব্যর্থ হয়েছে বলেই মনে করা হচ্ছে। মস্কো ও কিয়েভ উভয় পক্ষের প্রতিনিধি দল এ কথা জানিয়েছে। রুশ প্রধান আলোচক ও প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের সহযোগী ভøাদিমির মেডেনস্কি বলেন, ‘আলোচনায় প্রত্যাশিত ফল আসেনি।’ ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট কার্যালয়ের উপদেষ্টা মিখাইল পডোলিয়াকও স্বীকার করেছেন, পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটানোর মতো কোনো ফল পাওয়া যায়নি। তবে উভয় পক্ষ আলোচনা চালিয়ে যেতে সম্মত হয়েছে। শিগগিরই চতুর্থ দফার আলোচনা হবে বলেও জানা গেছে। তবে কোনো পক্ষই দিনক্ষণের কথা উল্লেখ করেনি। আলোচনায় রাশিয়ার মূল শর্তসমূহের মধ্যে রয়েছে দোনেৎস্ক ও লুগানস্ক প্রজাতন্ত্র এবং ক্রিমিয়ার ওপর রাশিয়ার সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি। এসব শর্ত মানা হলেই কেবল ইউক্রেনে সামরিক অভিযান বন্ধ করবে রাশিয়া।
সর্বোচ্চ সংযম দেখাতে বললেন চীনের প্রেসিডেন্ট : ইউক্রেন পরিস্থিতি খুবই উদ্বেগজনক বর্ণনা করে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং সব পক্ষকে ‘সর্বোচ্চ সংযম’ প্রদর্শনের আহ্বান জানিয়েছেন। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ ও জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শুলজের ?সঙ্গে গতকাল এক ভার্চুয়াল বৈঠকে শি এ আহ্বান জানান বলে জানায় বিবিসি। শি বলেন, ইউক্রেন পরিস্থিতি যাতে নিয়ন্ত্রণের বাইর চলে না যায় সবার অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সেদিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত। তিনি বৈঠকে অংশ নেওয়া তিন দেশকে একজোট হয়ে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে শান্তি আলোচনায় সমর্থন দেওয়ার কথাও বলেন। চীন ও রাশিয়ার মধ্যে ঘনিষ্ঠ কূটনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। যে কারণে ইউক্রেনে আগ্রাসনের পরও রাশিয়ার কোনো ধরনের নিন্দা বা সমালোচনা করেনি বেজিং। ইউক্রেনে ?হামলার কারণে জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যে নিন্দা প্রস্তাব তোলা হয় তাতেও ভোটদান থেকে বিরত ছিল চীন।
২০ লাখ মানুষ ইউক্রেন ছেড়েছে, যুদ্ধ চলছেই : ইউক্রেনে যুদ্ধের হাত থেকে বাঁচতে সে দেশ ছেড়ে পালানো লোকের সংখ্যা এখন ২ মিলিয়ন বা ২০ লাখ ছাড়িয়ে গেছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা। এর মধ্যে রাজধানী কিয়েভের পশ্চিম দিকের শহর ইরপিন থেকে আরও বেসামরিক মানুষ বেরিয়ে যেতে শুরু করেছে। ইউক্রেনের শহরগুলোয় ভারী গোলাবর্ষণ চালিয়ে যাচ্ছে রাশিয়ার বাহিনী। ফলে বেসামরিক বাসিন্দারা যুদ্ধ ক্ষেত্র ছাড়তে পারছে না। কিয়েভ, চেরনিহিভ, সুমি, খারকিভ ও মারিউপোলের বেসামরিক বাসিন্দাদের সরে যেতে ‘মানবিক করিডোর’ ঘোষণা করেছে রাশিয়া। এর আগেও এ রকম করিডোর ঘোষণা করা হয়েছিল, কিন্তু যুদ্ধ বন্ধ না হওয়ায় তা কার্যকর হয়নি। বেসামরিক বাসিন্দাদের যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে নিরাপদে সরে যেতে দেওয়ার জন্য ইউক্রেন ও রাশিয়ার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসংঘ মানবিক কার্যক্রমের প্রধান মার্টিন গ্রিফিথস। ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের গোয়েন্দা শাখা জানাচ্ছে, খারকিভের কাছাকাছি লড়াইয়ে রাশিয়ার একজন জেনারেল নিহত হয়েছেন। ভিতালি গেরাসিমভ রাশিয়ান বাহিনীর একজন মেজর জেনারেল পদমর্যাদার কর্মকর্তা। জাতিসংঘের সবশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী ইউক্রেনে ২৪ ফেব্রুয়ারি রুশ অভিযান শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত ১ হাজার ২০৭ জন বেসামরিক লোক হতাহত হয়েছেন। জাতিসংঘ মানবাধিকারবিষয়ক কমিশনার লিজ থ্রোসেল বলেন, এর মধ্যে ৪০৬ জন নিহত এবং ৮০১ জন আহত হয়েছেন, তবে প্রকৃত সংখ্যা অনেক বেশি হতে পারে।
রাশিয়া থেকে তেল আমদানিতে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা : রাশিয়া থেকে তেল আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে যুক্তরাষ্ট্র। গতকাল মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এ নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা দেন। প্রতিবেদনে বলা হয়, ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের প্রতিশোধ হিসেবে মস্কোর ওপর চাপ বাড়াতে রাশিয়ার তেল ও অন্যান্য জ্বালানি আমদানির ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা দিয়েছেন। রয়টার্সের আরেক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২২ সালের শেষ নাগাদ পর্যায়ক্রমে রাশিয়া থেকে তেল এবং জ্বালানি পণ্য আমদানি বন্ধ করবে যুক্তরাজ্য। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন বলেছেন, রাশিয়ার ওপর তাদের তেল এবং জ্বালানি পণ্যের নির্ভরতা কমাতে যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য দেশগুলোর সঙ্গে যোগ দিচ্ছে তাঁর দেশ।
আলোচনায় সমাধান দেখছেন জেলেনস্কি : রাশিয়া-ইউক্রেন চলমান সংকটে ক্রিমিয়া, দোনেস্কো ও লুগানস্ককে ইউক্রেনের স্বীকৃতি দেওয়া এবং ন্যাটোতে যোগ না দেওয়াকেই একমাত্র সমাধান বলে জানিয়েছে মস্কো। তবে এমন দাবি নাকচ করে দিয়ে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছেন, পুতিনের সঙ্গে আলোচনাতেই কেবল সমাধানের পথ খুলতে পারে। গতকাল মার্কিন সংবাদমাধ্যম এবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এ মন্তব্য করেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট। মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটোতে যোগাদানে অস্বীকৃতি এবং ক্রিমিয়া, দোনেস্কো ও লুগানস্ককে ইউক্রেনের স্বীকৃতি দেওয়ার রুশ দাবির বিষয়ে করা এক প্রশ্নের জবাবে ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেন, আমরা আল্টিমেটাম শুনতে রাজি নই? তবে এই মুহূর্তে আমাদের কাছে সম্ভব্য কিছু সমাধান রয়েছে। তিনি আরও বলেন, আমাদের এমন উদ্যোগ নিতে হবে যাতে করে প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে আলোচনায় বসা যায়।
দৈনিক কলম কথা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।