পুত্রশোকে পাথর হয়েছিলেন কিশোরগঞ্জের জয়ন্তী রানী। ঘোলাটে হয়ে গিয়েছিল চোখের মণি। হারিয়েছিলেন চোখের আলো। ২৪ বছর পর আবার এই পৃথিবীর আলো-ছায়ার খেলা দেখছেন তিনি। কিভাবে? তাঁর বড় ছেলে বিজয় কুমার ঘোষের কাছে সেটাই শুনেছেন পিন্টু রঞ্জন অর্ক

১৯৯৮ সালে আমার এক ভাই হলো। দুর্জয়। কিন্তু মাস তিনেকের মাথায় নিউমোনিয়ার কাছে হার মানল সে। পুত্র হারানোর এই শোক কিছুতেই কাটিয়ে উঠতে পারেননি মা। সারাক্ষণ শুধু কাঁদতেন। এক পর্যায়ে চোখের জলও শুকিয়ে এলো। বুঝতে বুঝতেই সপ্তাহ পার

কাঁদতে কাঁদতে অবস্থা এমন—চোখেও কম দেখছিলেন; কিন্তু আমরা তখন বিষয়টাকে অত গুরুত্ব দিইনি। দৃষ্টিশক্তি কমতে কমতে একসময় দেখতেই পাচ্ছিলেন না। এটা বুঝতে সপ্তাহখানেক সময় লেগেছিল। বড় বোনটা তখন কলেজে পড়ে। মাকে সংসারের সব সামলাতে হতো। বাড়িতে টিউবওয়েল ছিল না। পুকুর থেকে জল এনে প্রস্রাব-পায়খানা করতে হয়। গরুর খাবার দিতে হয়। এক দিন রাত সাড়ে ১১টার দিকে বাবা বাজার থেকে ফিরলেন। আমরা খেতে বসলাম। ভাতের পর পাতে মা তরকারি দিচ্ছিলেন। কিন্তু তরকারির সঙ্গে বাবার পাতে হাঁড়ি ধরার ন্যাকড়া দিয়ে বসলেন। বাবা প্রথমে রেগে গেলেন—‘কী ব্যাপার। এত রাতে ইয়ার্কি করছ কেন? কী দিছো এসব?’ মা বললেন, ‘কী দিছি? তরকারি দিছি। ’ দেখলাম, মা সত্যি সত্যিই কিছু দেখছেন না। পরে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘আমি তো সাত দিন যাবৎ ঠিকঠাক কিছু দেখি না!’ আমরা সবাই হাউমাউ করে কান্নাজুড়ে দিলাম।

ভোর ৫টায় মাকে নিয়ে আমরা ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে গেলাম। অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ডাক্তার বললেন, ‘কর্নিয়া ঘোলাটে হয়ে গেছে। চোখের আলো ফেরার সম্ভাবনা ক্ষীণ। ’ ডাক্তার কিছু ওষুধ লিখে দিলেন। পরে আসতে বললেন। এর পর থেকে মায়ের জগত্টা বদলে গেল। অনুমানের ওপর ভর করে চলতেন। রান্নাসহ যেকোনো কাজে দিদি সাহায্য করত। টয়লেট বা অন্য কোথাও যেতে হলে আমরা হাত ধরে নিয়ে যেতাম। এরই মধ্যে ২০০৪ সালে দিদির বিয়ে হয়ে গেল। আমাদের পরিবারে আর্থিক টানাপড়েন বাড়ল। ফলে মায়ের চিকিৎসা ঠিকঠাক হচ্ছিল না। এক পর্যায়ে চোখ দিয়ে পুঁজ পড়তে লাগল। পরে হোমিওপ্যাথির চিকিৎসা শুরু করলেন বাবা। বেশ কিছুদিন পর পুঁজ পড়া বন্ধ হলো।

বোনটা শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার পর মা যেন চলার সঙ্গীও হারালেন। প্রায়ই বাইরে বের হতে গেলে পড়ে যেতেন। ঘরের দরজা বা জানালার সঙ্গে ধাক্কা খেতেন। এভাবে হাতে-পায়ে, মাথায় অনেকবার ব্যথা পেয়েছেন। একবার বর্ষায় বাসায় কেউ ছিল না। বাইরে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল। ঘরের একটু দূরে টয়লেট। একা একা সেখানে যাওয়ার সময় পিছলে পড়ে ডান হাত ভাঙল মায়ের। আরেকবার ভাত রান্নার সময় চুলায় লাকড়ির সঙ্গে নিজের হাত ঢুকিয়ে দিলেন। ডান হাতে আগুন ধরে গিয়েছিল সেইবার।

kalerkanthoওর মুখটা যদি একবার দেখতাম

পরে আরেকটা ভাই এসেছিল মায়ের কোলে। আমাকে তো তাও দেখেছিলেন; কিন্তু জন্মের পর থেকে পল্লব নামের সেই ভাইকে মা দেখেননি। আমি বাইরে থেকে বাসায় গেলে মা চুলে-মুখে হাত দিয়ে অনুভব করার চেষ্টা করতেন। ভাইটাকে বুকে টেনে নিতেন। গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন। চোখের জল সম্বল ছিল মায়ের। শুধু কাঁদতেন। বলতেন, ‘তোরারে যদি একবার দেখে মারা যাইতাম, তাইলে আমার অনেক শান্তি অইতো। ছোট ছেলের মুখটা যদি একবার দেখতাম।

তুইও বা এত দিন পরে কেমন অইছোস। ’ দিদির সন্তানদের শব্দ শুনলেও ডুকরে কাঁদতেন—‘আহারে, এমন পোড়াকপাল আমার। নাতি-নাতনিগুলারে একবার দেখতে পারি না। ওরা কেমন অইছে-সুন্দর না কালা। ’ প্রায়ই ভগবানের কাছে বলতেন, ‘ভগবান, আমার ছেলেমেয়েগুলারে একটু দেখতে দাও। অন্তত একবারের জন্য হলেও ওদের যেন দেখতে পাই। জীবনে আর কিছুই চাই না। ’

এরই মধ্যে আবার মায়ের চিকিৎসার চেষ্টা চালিয়ে যেতে লাগলাম। কোথাও চক্ষুশিবির আয়োজনের খবর পেলে মাকে নিয়ে যেতাম। তখন টিউশনি করতাম। সেই টাকায় মাকে ডাক্তার দেখাতাম। কেউ একজন যদি বলত ওমুক জায়গায় নিয়ে যাও। অনেকে ভালো হইছে। নিয়ে যেতাম। এভাবে গাজীপুর, রংপুর, দিনাজপুর, কিশোরগঞ্জ, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁওসহ নানা জায়গায় নিয়ে গেছি। শুরুতে অনেক টেস্ট দিত। নানা পরীক্ষার পর বলত, অপারেশন সম্ভব না। এই চোখ ঠিক হবে না। একরাশ হতাশা সঙ্গী করে বাড়ি ফিরতে হতো।

জীবনে সৃষ্টিকর্তার কাছে একটাই প্রার্থনা ছিল, মা যাতে আমাকে একটু দেখতে পান। করোনার পর ভাবলাম আরেকবার চেষ্টা করি দেখি। ময়মনসিংহে একজন স্বনামধন্য চক্ষু বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে গেলাম। অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর তিনি বললেন, ‘আপনার মায়ের হার্টেও সমস্যা আছে। অপারেশন করা ঝুঁকিপূর্ণ। ’ সেখান থেকে ফেরার পথে এক পরিচিতজন বললেন, ‘ময়মনসিংহের চরপাড়া মোড়ে পারমিতা চক্ষু হাসপাতাল আছে। হরিশংকর দাশ নামের একজন ডাক্তার আছেন। সত্তরের বেশি বয়স। উনি হয়তো কিছু করলেও করতে পারেন। ’ যথারীতি তাঁর কাছে নিয়ে গেলাম। সব কিছু দেখার পর তিনি কিছু ওষুধ দিয়ে এক সপ্তাহ পরে নিয়ে যেতে বললেন। এটা গেল ফেব্রুয়ারির কথা।

সপ্তাহখানেক পর আবার নিয়ে গেলাম। তখন ডাক্তার হরিশংকর বললেন, ‘সবাই তো অনেক চেষ্টা করছে। আপনারা যদি বলেন আমি একটা চোখ নিয়ে শেষবারের মতো চেষ্টা করে দেখতে পারি। সেটা ভালো হলে বাকিটার অপারেশন করব। না হলে আমার কিছু করার থাকবে না। ’ যাহোক, তিনি একটা চোখে অপারেশন করলেন। তিন দিন পর ব্যান্ডেজ খোলা হলো। মা জানালেন, সেই চোখে কিছুটা ঝাপসা দেখছেন!

২ মার্চ মায়ের ডান চোখে অপারেশন হলো। ব্যান্ডেজ খোলার পর মনে হলো, জীবনে প্রথমবারের মতো মা আমাদের দেখছেন। তবে চিনতে পারেননি। আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন। তারপর অবাক হয়ে চারপাশ দেখলেন। বললাম, ‘মা তুমি দেখতেছ?’ তখন চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন। অনেকবার আমার মুখ-নাক-চুল স্পর্শ করলেন। পরে আমাকে বুকে নিয়ে কান্না শুরু করে দিলেন। তবে এ অশ্রু আনন্দের। ২৪ বছর পর মা আমাকে দেখছেন—আমার জীবনে এর চেয়ে সুখের মুহূর্ত আর আসেনি, আর কখনো আসবেও না। নিজেকে মনে হলো দুনিয়ার সবচেয়ে সুখী মানুষ!

একসময় আর কিছুই দেখতাম না। অনুমানের ওপর চলতাম। সংসারের কাজ তো করতেই হইতো। বিপদ আসত। কখনো হাত পুড়ত, কখনো পা কাটত। একবার তো হাত আগুনে পোড়ায়ালাইছি বেশি। লাকড়ির লগে চুলায় হাত ঢুকাইয়া দিলাম। হাতটা পুইড়া গেছে। এখন সব স্বপ্নের মতো লাগছে।

আর কারো সাহায্যের প্রয়োজন পড়তেছে না। উঠতে পারতেছি, নামতে পারতেছি, চলতে পারতেছি। পল্লবের বয়স এখন ২৩ বছর। ওকে দেখে তো আমি আশ্চর্য, আমার ছেলের মুখ এ রকম অইছে। পৃথিবীটা এতই সুন্দর। আমার জীবনে এর চেয়ে বড় শান্তি আর কিছুই হইবো না। সব কিছুই মনে হইছে আশ্চর্য, নতুন। ২৪ বছর আগে যা দেখতাম, তা ভুলেই গেছি। পৃথিবী এত সুন্দর তা আমার মনে ছিল না। ভগবান, আমার ছেলেমেয়েগুলারে দেখতে পাইতেছি। জীবনে আর কিছুই চাওয়ার নাই। ’

 

 

কলমকথা/ বিথী