শ্রী রবীন্দ্রনাথ সরকার, গংগাচড়া প্রতিনিধিঃ  রংপুরের গংগাচড়া উপজেলায়  ‘দি হাঙ্গার প্রজেক্ট’ এর সহযোগিতায় দক্ষতা বৃদ্ধি মূলক সেলাই প্রশিক্ষণ বদলে দিয়েছে লেখাপড়া নাজানা পিছিয়ে থাকা এক নারীর জীবন। গংগাচড়া উপজেলার নোহালী ইউনিয়নের পূর্ব কচুয়া গ্রামের দৃঢ় আত্মবিশ্বাসী এই নারীর নাম ছবিতা মোহন্ত।

দরিদ্র কৃষক বাবা অতুল মোহন্ত, মা- চম্পো মোহন্ত’র তিন মেয়ে ও এক ছেলের মধ্যে সবিতা সবার বড়। ছেলে সন্তান প্রত্যাশী মা-বাবার একাধিক কন্যা সন্তান হওয়ায়, কম বয়সে বিয়ে হয়ে যায় শিক্ষা বঞ্চিত ছবিতা মোহন্ত’র। প্রাথমিক পাশ করা স্বামী রনজিত মোহন্ত চার ভাইয়ের মধ্যে দ্বিতীয়।

বসতভিটা সহ পৈত্রিক ৩০ শতাংশ কৃষি জমি চাষাবাদ করে, ভালমতো চলেনা তাদের সংসার। স্বামী রনজিত মোহন্তে’র কৃষি মজুরির আয়ে অনাহারে অর্ধাহারে দিন কেটে যেতো। ছবিতা মহন্ত বিয়ের এক বছর পরেই প্রথম কন্যা সন্তানের মা হলেন। তখন আরও বেশি সংকটের সম্মুখীনে পড়লেন।

বছর তিনেক পরে দ্বিতীয় কন্যা সন্তানের জন্ম হলো। অভাব অনাটনের সংসারে চার মুখের খাবার জোগানো যেন অদৃশ্য ভাগ্য বিধাতার দয়া নির্ভর বিষয়। ছবিতা মোহন্ত শিক্ষা বঞ্চিত হলেও নিজের জীবনকে স্রোতে ভাসিয়ে দেওয়ার কথা কখনো ভাবেননি। তিনি ভাবতেন তার সন্তানেরা যেন কখনো তার মতো অভিশপ্ত জীবন বয়ে না বেড়ায়। তার মেয়েরা লেখাপড়া শিখবে সাবালিকা হয়ে বিয়ে করবে। লেখাপড়া নেই, কিংবা নিজে একজন নারী এইসব কখনো উপলব্ধি করেননি তিনি বরং সন্তানদের নিয়ে সংসারে লড়াই করে টিকে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা ছিলো তার।

ঠিক সেই সময় ২০১৩ সালে ‘দি হাঙ্গার প্রজেক্ট ‘ ভিডিটির চাহিদা ভিত্তিক দক্ষতা বৃদ্ধি মূলক সেলাই (দর্জি) প্রশিক্ষণের আয়োজন করেছিল। প্রশিক্ষনে নির্বাচিত অন্যান্য নারীদের মতো ছবিতা মোহন্ত অংশগ্রহণ করার আগ্রহের কথা জানালেও নিরক্ষরতা প্রাথমিক অন্তরায় হয়ে দ্বারায়। তবে তার আকুতি মিনতির একপর্যায়ে আয়োজক ইয়ূথ লিডারের সুপারিশে প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণের সুযোগ পান। ২৮ জুলাই,২০১৩ শুরু হয় ৭৬৩ ব্যাচে একমাসের সেলাই প্রশিক্ষণ। ছবিতা মোহন্ত প্রশিক্ষণ ক্লাসে নিয়মিত উপস্থিত থেকে মনোযোগ দিয়ে গ্রহন করেন একমাসের সেলাই প্রশিক্ষণ। প্রশিক্ষক সুনীল রায় অংশগ্রহনকারীদের অনুরোধে প্রশিকন শেষে মূল্যায়ন পরীক্ষার আয়োজন করেন। এই পরীক্ষায় ছবিতা মোহন্ত প্রথম হলেন।

এখানেই তার আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়। যদিও সংসারে আর্থিক সংকট লেগেই আছে তবুও এখন একটা সেলাই মেশিন খুব দরকার, এই ভাবনাটা তাকে সবসময় তাড়া করে বেড়ায়। তিনি সরকার পাড়া নারী জিজিএস এ সদস্য হিসেবে যুক্ত হন। হাত খরচ বাচিয়ে, হাস- মুরগির ডিম বিক্রি করে, কখনো শাক-সবজী বিক্রির টাকা জমিয়ে দীর্ঘ তিন বছর ধরে সঞ্চয় করেন প্রায় ৩০০০ টাকা। স্বামীর নিকট সেলাই মেশিন কেনার বাকী টাকা চাইলেও তা সম্ভব হয়নি। অবশেষে স্বামীকে রাজি করে সমিতি থেকে ৫০০০ টাকা ঋণ গ্রহন করে ২০১৭ সালে কাঙ্খিত সেলাই মেশিন কিনেন।
শুরু হলো সেলাই থেকে আয়। দিন যায় কাজ বাড়ে, আয়ও বাড়তে থাকে। স্কুল পড়ালেখার পাশাপাশি তার দুই মেয়ে তাকে হাতের কাজে সহোযোগিতায় করে। এখন তার মাসিক আয় গড়ে ৬০০০ টাকার উপরে।

সংসারের সহযোগিতার পাশাপাশি তিনি আয়ের টাকা দিয়ে মেয়েদের লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছেন। বড় মেয়ে ববিতা মোহন্ত ডিগ্রিতে পড়ে এবং দ্বিতীয় মেয়ে অন্তরা মোহন্ত এসএসসি পরীক্ষার্থী। দুই মেয়েই মায়ের কাছে সেলাই শিখেছে। স্বামী এখন কৃষিমজুরী করেনা। ব্যাটারী চালিত ভ্যানগাড়ী চালিয়ে উপার্জন করছেন। দুজনের আয়ে সুখের সংসার গড়েছেন সবিতা মোহন্ত। স্বামী এখন যে কোনো ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে তার সাথে পরামর্শ করেন।

গ্রামের নারীরা তাকে আগের থেকে অনেক গুরুত্ব দেয়, সম্মানও করেন। তিনি এখন সমাজের নারীদের কাছে বদলে যাওয়ার অনন্য উদাহরণ