বারআউলিয়ার পুণ্যভূমিখ্যাত চট্টগ্রামের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের নিদর্শন মোগল স্থাপত্য ‘কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ’। এটি শহরের সবচাইতে প্রাচীন মসজিদ। সেই আদিকাল থেকেই ধর্মীয় তীর্থস্থান হিসেবে কদম মোবারক মসজিদের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। এই মসজিদ তার অতীত ঐতিহ্যকে ধারণ করে আজও টিকে আছে। এ মসজিদের নিকটবর্তী লোকালয় কদম মুবারক নামে পরিচিত। এই মসজিদের গঠন, অবকাঠামো, নির্মাণ শৈলী, কারুকার্য এখনো আকৃষ্ট করে মুসল্লিদের।

বৃটিশ শাসনামলে আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদকে অস্ত্রাগার হিসেবে ব্যবহার করা শুরু করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। তখন এখানকার মুসলমানরা কদম মোবারক মসজিদে নামাজ আদায় করতেন। এই মসজিদ যখন নির্মাণ করা হয়েছিল তখন ৫ কাতারে ১০০ জন মুসল্লি একসঙ্গে নামাজ আদায় করতে পারতেন। বর্তমানে মসজিদটি সমপ্রসারণ করায় এখানে একসঙ্গে এক হাজার মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারেন।

কদম মোবারক মসজিদ-এর ইতিহাস

মুঘল ফৌজদার ইয়াসিন খাঁন কর্তৃক এই মসজিদ নির্মিত হয়। মোঘল শাসকরা মগ এবং পর্তুগিজদের হাত থেকে চট্টগ্রামকে মুক্ত করে মোঘল শাসন প্রতিষ্ঠার পর তাদের বিজয়ের নির্দশন স্বরূপ বহু মসজিদ নির্মাণ করেন। এমনই এক মসজিদ ‘কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ’। মসজিদের মূল কক্ষে রক্ষিত এক শিলাখন্ডে হযরত মুহম্মদ (সা.) এর একজোড়া পবিত্র পদচিহ্ন থেকে এ মসজিদের নামকরণ।

এই উৎকীর্ণ শিলালিপি থেকে জানা যায় যে, মুহম্মদ ইয়াসিন নামে এক স্থানীয় ফৌজদার মুঘল সম্রাট মুহম্মদ শাহ এর শাসনামলে ১১৫৬ হিজরিতে (১৭২৩ খ্রি.) এ মসজিদ নির্মাণ করেন। তিনি নিজস্ব খরচে চট্টগ্রাম শহরের প্রাণকেন্দ্র চেরাগীর পাহাড় (মোমিনরোড) এলাকায় এই মসজিদ নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ১৭১৯ থেকে ১৭২৩ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ চার বছরে মসজিদের নির্মাণ কাজ সমাপ্ত হয়। কদম মোবারক মসজিদটি নির্মাণকালে মুঘল স্থাপত্য শৈল্পিক চেতনাকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়। কদম মোবারক মসজিদের নির্মাণ শৈলী এখনো দর্শনার্থীদের আকৃষ্ট করে। কদম মোবারক মসজিদে মুঘল শাসকদের রুচির বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।

সমতল ভূমি থেকে অনুচ্ছ পাহাড়ের মাঝখানে উত্তর-দক্ষিণে লম্বাকৃতির এ মসজিদের ছাদ তিনটি গম্বুজ দ্বারা ও দুটি ভল্ট দ্বারা আচ্ছাদিত। চারকোণে রয়েছে তিন-স্তর বিশিষ্ট অষ্টভুজী মিনার বা বুরুজ।

এ মিনারগুলির প্রতিটির শীর্ষে রয়েছে ক্ষুদ্র গম্বুজ ও তারও শীর্ষে গোলাকার শীর্ষালঙ্করণ (finial)। এছাড়া, মসজিদের সামনের দেয়ালের মাঝখানের দরজার দুপাশে দুটি সরুমিনার রয়েছে। আয়তাকার এ মসজিদের মূল কক্ষের উত্তর ও দক্ষিণ দিকে রয়েছে একটি করে পার্শ্বকক্ষ।

কদম মোবারক মসজিদ মূল কক্ষটি তিনটি ‘বে’তে বিভক্ত এরং পশ্চিম দেওয়ালের কেন্দ্রে একটি কেন্দ্রীয় মিহরাব রয়েছে। মসজিদের পূর্ব দেয়ালে রয়েছে তিনটি খিলান দেয়া দরজা।

মাঝখানের দরজাটির আকার অন্যদুটি দরজার তুলনায় বড়। দরজাগুলো সোজা ভিতরে পশ্চিমে দেয়ালে আছে তিনটি মেহরাব। মেহরাবগুলোর সংলগ্ন স্থানটুকু অপূর্ব সুন্দর কারুকার্যময় লতাগুলোর নকশা ও সুন্দর হস্তাক্ষরে আরবি ভাষায় উত্তীর্ণ লিপি এখনো রয়েছে।

মসজিদ গৃহের বাইরের দিকের মাপ হচ্ছে ১৩ মি × ৭.৪২ মি। এর সঙ্গে বাড়তি পার্শ্বকক্ষ দুটির দৈর্ঘ্য ২৩.১৬ মিটার। মসজিদের পূর্ব দিকে আছে এক সুপরিসর খোলা আঙিনা।

জনশ্রুতি
কদম মোবারক মসজিদের উত্তর পার্শ্বের একটি কক্ষে পাথরের উপর মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সা.) এর পায়ের ছাপবিশিষ্ট কদম রয়েছে। তার পাশে আরেকটি পায়ের ছাপ বিদ্যামান যা নাকি বড়পীর হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রা.) এর বলে জনশ্রুতি রয়েছে। কদমের ছাপদ্বয় মুঘল আমল থেকেই এখানে এভাবে সংরক্ষিত আছে। এক পদচিহ্ন বরাবরে বাংলায় লেখা রয়েছে: ‘সরওয়ারে কায়েনাত হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাহু আলাহি ওয়া সাল্লাম–এর কদম মোবারক’। অপর পদচিহ্ন বরাবরে লেখারয়েছে : ‘হজরত গাউসুল আজম আব্দুল কাদের জিলানী (রা.) এর কদম মোবারক’।

মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা নবাব ইয়াছিন খান কদমের ছাপদ্বয় সুদূর আরব দেশ থেকে সংগ্রহ করেছিলেন বলে জানা যায়। বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন সংস্কার ও সমপ্রসারণ কর্মকাণ্ডের ফলে মসজিদের কিছুটা আধুনিকতার ছাপ পড়লেও মসজিদটির মূল অবকাঠামো মোঘল স্থাপত্যের অনুপম সৌন্দর্য্যের কোনো পরিবর্তন ঘটেনি।

ধর্মীয় তীর্থ কেন্দ্র
সেই আদিকাল থেকেই ধর্মীয় তীর্থ কেন্দ্র হিসেবে কদম মোবারক মসজিদের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। কদমের ছাপদ্বয় সবসময় পানিতে ডুবানো থাকে। মনোবাসনা পূরনের উদ্দেশ্যে এবং রোগমুক্তির আশায় অনেকেই এই পানি সবাই ভক্তি সহকারে পান করে। অনেকেই দূরদূরান্ত থেকে আসেন কদমদ্বয়ের ছাপ দর্শন লাভের আশায়।