আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, জেনে রেখো! যদি সব সৃষ্টি একত্র হয়ে তোমার কোনো উপকার করতে চায়, তবু তারা আল্লাহর নির্ধারিত পরিমাণ ছাড়া কখনই তোমার উপকার করতে পারবে না। আর যদি সব সৃষ্টি একত্র হয়ে তোমার কোনো ক্ষতি করতে চায়, তবু তারা আল্লাহর নির্ধারিত পরিমাণ ছাড়া কখনই তোমার ক্ষতি করতে পারবে না। কলম তুলে নেওয়া হয়েছে এবং দপ্তরসমূহ শুকিয়ে গেছে।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ২৫১৬)

আলোচ্য হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) মুমিনদের আল্লাহর সান্নিধ্য ও নৈকট্য লাভে উৎসাহিত করেছেন। যেন তারা ঈমান, ইখলাস (সততা), ইবাদত ও আনুগত্যের মাধ্যমে আল্লাহর ভালোবাসা, সান্নিধ্য ও রহমতের দৃষ্টি লাভে সক্ষম হয়। পার্থিব জীবনে তারা কখনো আল্লাহর অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত না হয়।

আল্লাহ সঙ্গে থাকার অর্থ: সঙ্গ বা সঙ্গে থাকা বোঝাতে আরবি ভাষায় ‘মায়িয়্যাত’ শব্দ ব্যবহৃত হয়। আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের বিশ্বাস অনুযায়ী ‘মায়িয়্যাত’ মহান আল্লাহর একটি গুণ। তবে আল্লাহর সঙ্গে থাকা কোনো সৃষ্টির সঙ্গে থাকার মতো নয়। কেননা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘কোনো কিছুই তার মতো নয়, তিনি সব শোনেন এবং দেখেন।’ (সুরা আশ-শুরা, আয়াত : ১১)

বিশেষজ্ঞ আলেমরা আল্লাহর সঙ্গে থাকার দুটি অর্থ করেন। এক. সাধারণ অর্থে আল্লাহর সঙ্গে থাকা। তাহলো আল্লাহ তাঁর জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও ক্ষমতার মাধ্যমে সব সৃষ্টির সঙ্গে থাকেন।

দুই. বিশেষ অর্থে সঙ্গে থাকা। আর তাহলো সতর্কীকরণ, সাহায্য, সহযোগিতা ও সুযোগ দানের মাধ্যমে সঙ্গে থাকা। কোরআন ও হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী আল্লাহ নবী-রাসুল, মুমিন ও তার নৈকট্যপ্রাপ্ত বান্দাদের সঙ্গে দয়া, অনুগ্রহ ও সহযোগিতার মাধ্যমে সঙ্গে থাকেন। ওহি ও ইলহামের মাধ্যমে তাদের সতর্ক করেন। (https://bit.ly/3bIWzYO)

আল্লাহর যাদের সঙ্গে থাকেন: পবিত্র কোরআনের একাধিক আয়াতে ‘আল্লাহর থাকা’র বিষয়টি বিবৃত হয়েছে। যেমন, ১. আল্লাহভীরু ও দয়াশীল মানুষ : আল্লাহ মুত্তাকি ও দয়াশীল মানুষের সঙ্গে থাকার ঘোষণা দিয়ে বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তাদের সঙ্গে আছেন যারা আল্লাহভীরু ও অনুগ্রহকারী।’ (সুরা নাহল, আয়াত : ১২৮)

২. আল্লাহর পথে আহ্বানকারী : যারা মানুষকে আল্লাহর পথে আহ্বান করে আল্লাহ তাদের সঙ্গে থাকেন। আল্লাহর মহান দুই নবী মুসা ও হারুন (আ.)-কে ফেরাউনের কাছে দ্বিনি দাওয়াত নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে বলেন, ‘তোমরা ভয় পেয়ো না, নিশ্চয়ই আমি তোমাদের সঙ্গে আছি, আমি শুনি ও দেখি।’ (সুরা তাহা, আয়াত : ৪৬)

৩. বিপদগ্রস্ত মুমিন : যখন কোনো মুমিন বিপদগ্রস্ত হয় এবং তারা আল্লাহর সাহায্য কামনা করে আল্লাহ সাহায্যের মাধ্যমে তাদের সঙ্গে থাকেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘যখন দুই দল পরস্পরকে দেখল, মুসার অনুসারীরা বলল, নিশ্চয়ই আমরা ধরা পড়ে যাব। মুসা বলল, কখনোই না। নিশ্চয়ই আমার প্রভু আমার সঙ্গে আছেন। তিনি আমাকে পথ দেখাবেন।’ (সুরা আশ-শুরা, আয়াত : ৬২)

৪. আল্লাহর পথে হিজরতকারী : আল্লাহর নির্দেশে মহানবী (সা.) যখন মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করছিলেন, তখন আবু বকর (রা.) শত্রুর হাতে ধরা পড়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেন—সে সময় সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে, ‘যখন তারা গুহায় ছিল, তখন সে তার সঙ্গীকে বলেছিল, বিষণ্ন হয়ো না। আল্লাহ আমাদের সঙ্গে আছেন।’ (সুরা তাওবা, আয়াত : ৪০)

৫. ধৈর্যশীল ব্যক্তি : যারা দ্বিনের ওপর চলতে গিয়ে বিপদের শিকার হয় এবং ধৈর্য ধারণ করে আল্লাহ তাদের সঙ্গে থাকেন। আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনরা! তোমরা ধৈর্য ও নামাজের মাধ্যমে সাহায্য চাও। নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে আছেন।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ১৫৩)

আল্লাহ পাপীদেরও সঙ্গে থাকেন: কোনো মানুষ আল্লাহর জ্ঞান ও ক্ষমতার বাইরে নয়। সুতরাং কেউ পাপ কাজ করলেও আল্লাহ তার সম্মুখে থাকেন। আল্লাহ বলেন, ‘তিনি তাদের সঙ্গে আছেন রাতে যখন তারা, তিনি যা পছন্দ করেন না—এমন বিষয়ে পরামর্শ করে এবং তারা যা করে তা সর্বতোভাবে আল্লাহর জ্ঞানায়ত্ত।’ (সুরা নিসা, আয়াত : ১০৮)

অন্য আয়াতে ষড়যন্ত্রকারীদের ব্যাপারে আল্লাহ বলেন, ‘তিন ব্যক্তির মধ্যে এমন কোনো গোপন পরামর্শ হয় না যেখানে তিনি চতুর্থজন হিসেবে উপস্থিত থাকেন না এবং পাঁচ ব্যক্তির মধ্যেও হয় না যেখানে তিনি ষষ্ঠজন হিসেবে উপস্থিত থাকেন না। তারা এর চেয়ে কম হোক বা বেশি তিনি তো তাদের সঙ্গেই আছেন; তারা যেখানেই থাকুক না কেন।’ (সুরা মুজাদালা, আয়াত : ৭)

আল্লাহকে সঙ্গে পেতে হলে: আল্লাহকে সঙ্গে পেতে হলে আল্লাহকে যথাযথভাবে ভয় করতে হবে। জীবনের সর্বত্র তাঁর বিধি-বিধান যথাযথভাবে পালন করতে এবং তার সৃষ্টির সঙ্গে বিনম্র আচরণ করতে হবে। আর কখনো আল্লাহ বিপদ-আপদ দ্বারা পরীক্ষা নিলে ধৈর্য ধারণ করতে হবে। আল্লাহ পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তাদের সঙ্গে আছেন যারা আল্লাহভীরু ও অনুগ্রহকারী।’ (সুরা নাহল, আয়াত : ১২৮)

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি তার কঠিন বিপদের সময়ে আল্লাহর কাছে দোয়া কবুল হওয়ার আনন্দ পেতে চায় সে যেন তার সচ্ছলতার সময় বেশি বেশি দোয়া করে।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ৩৩৮২)

আল্লাহ যখন সঙ্গে থাকেন: কাতাদাহ (রহ.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করবে আল্লাহ তার সঙ্গী হবেন, যার সঙ্গী আল্লাহ হবেন, তার সঙ্গী এমন একটি দল হবে যাদের পরাজিত করা যায় না (ফেরেশতা), এমন পাহারাদার হবেন যিনি ঘুমান না এবং এমন পথপ্রদর্শক হবেন যিনি কখনো পথভ্রষ্ট হন না।’ (জামিউল উলুম ওয়াল হিকাম : ২০/১৪)

লেখক: সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (সিসি), বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা।