এক.
মুখোমুখি বসে থাকা কিশোরী মেয়েটা মাঝে মাঝে চোখ তুলে অবাক বিস্ময়ে তাকাচ্ছে। বাকিটা সময় ডুবে থাকছে তাই অ্যাইপ্যাডে। কিন্তু তারেক এক পলকে তাকিয়ে আছে তার দিকে। চোখ যেনো সরাতে পারছে না। মাঝে মাঝে চোখ দুটো ছলছল করে উঠছে। তখন দৃষ্টি সরিয়ে লুকানোর চেষ্টা করছে। স্বাভাবিক থাকার প্রাণান্ত চেষ্টা। মাঝে মাঝে টুকটাক প্রশ্ন করছে। অল্প কথায় উত্তর দিচ্ছে মেয়েটি।
এই প্রথম দেখা। মেয়েটা দেখতে অদ্ভূত সুন্দর হয়েছে। কোকড়ানো চুল, গায়ের রঙ বাদামী; ঠিক যেনো সাদার কাছাকাছি। চোখ দুটো বড় বড়, জ্বলজ্বলে। কি বিস্ময়মাখা চেহারা; স্বর্গের পরী যেনো। মা তার নাম রেখেছে এলিজাবেথ। কৃষ্ণাঙ্গ মা আর বাঙালি বাবার সন্তান মেয়েটি অবশ্য এসবের কিছুই জানে না। তার পৃথিবীতে জটিলতা বলতে কিছু নেই।
তার মা জেসিকা অসম্ভব দৃঢ়তায় গড়ে তুলছে তাকে। জেসিকার বয়ফ্রেন্ড পিটারকেই নিজের বাবা বলে জানে এলিজাবেথ। এ নিয়ে কখনো কোন প্রশ্ন ওঠেনি। ওঠার দরকারও হয়নি। আজ তারেক এসেছে নিজের মেয়েটাকে দেখতে। পিতৃত্বের দাবি নিয়ে নয়; সেটা করা যাবে না। এখানে নিয়ে আসবার আগে সেটাই ছিল জেসিকার শর্ত। মেয়েটার দুনিয়াকে ভেঙে চুরমার করে দেয়া যাবে না। কেবল একটু দেখা; একসঙ্গে কিছুটা সময় কাটানো। এরচেয়ে বেশি কিছু পাওয়ার নেই। তবুও ঝড়ের মতোই ছুটে এসেছে তারেক। এতগুলো বছর পর।
দুই.
জেসিকা এখন তার বয়ফ্রেন্ড পিটার এর সঙ্গে থাকে। পিটার খুব ভালো মানুষ। অ্যালাবামা থেকে নিউইয়র্কে এসেছে চাকরির সুবাদে। তখনই কোন একদিন তাদের দুজনের পরিচয়। এলিজাবেথ এর বয়স সবে দুই পেরিয়ে তিনে পড়েছে। সেই থেকে তিনজনের সংসার। ভালোই কেটে যাচ্ছে। শ্বেতাঙ্গ পিটার এলিজাবেথকে কখনো আলাদা করে ভাবেনি। নিজ কন্যার মতোই স্নেহ ও মমতা দিয়ে বড় করছে।
এর আগে কয়েকটা বছর জেসিকাকে একাই থাকতে হয়েছে। মেয়েটাকে গর্ভেধারণ, জন্মের দিনগুলোয় একাই সামলাতে হয়েছে তাকে। এর মধ্যে অনেক ঝড় এসেছে জীবনে। অনেক কষ্ট তাকে সহ্য করতে হয়েছে; মেনে নিতে হয়েছে একাকিত্বের অসহীয় যন্ত্রণাও। তবে পশ্চিমা দুনিয়ার অন্য অনেক মেয়ের মতো এসব নিয়ে তার কোন অভিযোগ ছিল না। জীবন তবুও থেমে থাকেনি। জেসিকা এরপরও তারেককে খুঁজতে যায়নি। কারণ সে তাকে কথা দিয়েছিল। বলেছিল, তাদের জীবনের সেই অজানা, গোপন অধ্যায়ের কথা সে কোনদিন কাউকে বলবে না। কোনদিন এলিজাবেথ এর পিতৃত্বের দাবি নিয়ে তারেকের কাছে হাজির হবে না। সেটা সে কখনো করেওনি। আজ এত বছর পর তারেক তাকে খুঁজে বের করেছে। সে তার সন্তানকে একনজর দেখতে চায়।
মানুষের জীবনে অদ্ভূত কত ঘটনাই না ঘটে। বিচিত্র এই দুনিয়া। তারেকের সঙ্গে জেসিকার পরিচয়, ঝড়ের মতো হঠাৎ সম্পর্ক এবং বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার কোন ব্যাখ্যা নেই। তাদের জীবনের গল্পটার শুরু এবং শেষ কিছুই নেই।
তিন.
তারেক এবং জেসিকা একইদিনে একই অফিসে চাকরি শুরু করেছিল। নিউইয়র্কের ম্যানহাটনের ডাউনটাউনে তাদের হেডঅফিস। দুজনের কাজের ধরণও একই। ট্রেনিংও শুরু হয় একই সঙ্গে। ফলে তাদের দুজনের মধ্যে অল্প সময়ের মধ্যে বন্ধুত্ব তৈরি হয়ে যায়।
তারেক বিবাহিত। এক ছেলে এবং এক মেয়ের বাবা। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে সুখের সংসার। জেসিকা থাকে একা। তার বয়ফ্রেন্ড এর সঙ্গে অনেক দিন একসঙ্গে থেকেছে। এরপর হঠাৎ দুজনের পথ আলাদা হয়ে গেছে। জেসিকার বয়ফ্রেন্ড জর্জ এখন আরেকটা মেয়ের সঙ্গে থাকে। কাজ করে জেএফকে এয়ারপোর্টে লুফথানসা এয়ারলাইন্সের হয়ে। জর্জের চলে যাওয়া জেসিকাকে এখনো খুব ব্যথিত করে। যদিও স্বল্প সময়ের পরিচয়ে জেসিকাকে সবসময়ই খুব শক্ত একটা মেয়ে বলেই মনে হয়েছে তারেকের কাছে। গভীর আবেগ থাকলেও, সেটা সে দেখাতে রাজি নয়। ব্যস্ত দুনিয়ায় চরম বাস্তববাদী নারী বলেই তাকে মনে হয়। মনে হয় সে জানে, জীবনে কখন কি করতে হবে।
নিজেদের গল্পের ব্যাপ্তি কাজের জায়গা ছাপিয়ে ব্যক্তিগত পর্যায় পর্যন্ত চলে গেছে। অথচ এখানকার মানুষ কিন্তু অত সহজে ব্যক্তিগত আলাপে যায় না। জেসিকা গল্প করতে পছন্দ করে। ইংরেজিতে তার কথা বলার ধরণটা খুব পরিস্কার। তারেকের বুঝতে কোন সমস্যা হয় না। তারেকের ইংরেজি বলাটাও ভালো। ফলে তাদের কথা বলার দুনিয়াটা অনেক সহজই হয়ে যায়। কাজের ফাঁকে ফাঁকে তারা একে অপরের সঙ্গে পরামর্শ করে, আলাপ করে। কখনো কখনো সেই আলাপের কোন বিষয়বস্তু থাকে না।
তাদের চাকরির ধরণটাই এমন যে কখনো কখনো বাড়ি বাড়ি ভিজিটে যেতে হয়। মানুষের সমস্যার সমাধান দেয়াই তাদের কাজের অন্যতম একটি অংশ। তারেক আর জেসিকার শুরুটাও হয়েছিল শেখার মাধ্যমে। প্রথমে ট্রেনিং। এরপর অন্য কারও সঙ্গে ভিজিটে যাওয়া। এক পর্যায়ে তারা যখন কিছুটা অভিজ্ঞ হয়েছে, একা একা যাওয়া শুরু করেছে। এরি মধ্যে এমনও দিন গেছে তাদের দুজনকে একসঙ্গে পাঠানো হয়েছে। তবে দিন গেছে পরিস্থিতি বদলেছে। দুজনকেই নিজেদের কাজ বুঝে নিতে হয়েছে। কাজের ব্যস্ততাও বেড়ে গেছে। ফলে তাদের দুনিয়ায় হঠাৎ একটা পরিবর্তন এসেছে। দেখাও হয় কালেভদ্রে।
একদিন ঝড়ো হাওয়া বয়ে যাচ্ছিল বাইরে। বৃষ্টির গতি থামে আর বাড়ে। এমন দিনে দশতলা অফিসের উপর থেকে বাইরে তাকিয়ে থাকতে বেশ লাগে। এককাপ কফি নিয়ে বসেছে তারেক। তখনো ধোঁয়া উঠছে। হাতের কাজগুলো দ্রুত শেষ করে ফেলতে হবে। জমিয়ে রাখতে রাখতে টেবিলে পাহাড় হয়ে যাচ্ছে। কখনো বাইরে তাকায়, কখনো কফির কাপে চুমুক। কাঁচ দেয়া ভবনে বৃষ্টির ফোটাগুলো আছড়ে পড়ছে। দেখতে বেশ লাগে। কখন যে তার টেবিলের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে জেসিকা টেরই পায়নি তারেক। মিষ্টি করে হেসে বলে, তুমি কি খুব বেশি ব্যস্ত?
কিছুটা চমকে ওঠে তারেক। জেসিকার দিকে তাকিয়ে বলেন, তেমন কিছু না। হাতের কাজগুলো শেষ করার চেষ্টা করছি’।‘লাঞ্চে তো যেতে হবে। চলো তোমাকে আজ ক্যারাবিয়ান ফুড খাওয়াবো’।‘চলো যাওয়া যাক। তাহলে একদিন তোমাকে বাংলাদেশি খাবার খাওয়াতে নিয়ে যাবো। কি, রাজি তো’?দুজন একসঙ্গে হেসে ওঠে।
তারেকের মনে আছে, সেদিন জেসিকার সঙ্গে অনেক কথা হয়েছিল। একজন বাংলায় ভাবে, বাংলায় স্বপ্ন দেখে। আরেকজন জগৎ ইংরেজিতে গড়া। চিন্তা, সংস্কৃতি, জীবনাচরণ আলাদা। জীবনের অভিজ্ঞতাও দুজনের এক নয়। এরপরও দুজনের মধ্যে কেমন মিল। কোথায় যেনো, কিছু একটা। হয়তো কিছুই না। জীবন যেখানে যেমন, তার চেয়ে বাড়তি কিছু।
তাদের গল্পের বেশিরভাগ বিষয়ই কাজের জায়গা নিয়ে। তবে কখনো কখনো ব্যক্তিজীবন নিয়েও কথা হয়। তারেক বলে, সহকর্মীর বাইরে গিয়েও, আমরা তো দেখি ভালো বন্ধু হয়ে গেছি। তুমি কি বলো?
‘তাহলে, আজ থেকে কেবল জেসিকা বলে ডাকো, মিস জেসিকা নয়’।
হেসে তারেক জবাব দেয়, ‘আমার শেষ নামটা চৌধুরী। তুমি ডাকো মিস্টার চৌধুরী বলে। তোমার সম্ভবত কষ্ট হয় উচ্চারণ করতে। এটা কেমন হয়, যদি তুমি আমাকে তারেক নামে ডাকো’? প্রশ্ন করে উত্তরের জন্য অপেক্ষা করে না তারেক। হেসে ওঠে। সেই হাসি থামতে চায় না। কারণ জেসিকা ভয়াবহ উচ্চারণে তাকে ডাকছে। ‘টা-রে-ক’। তবু শুনতে খুব ভালো লাগছে। বেশ অনেকক্ষণ চেষ্টার পর ‘তারেক’ নামটার কাছাকাছি ডাকতে পারলো জেসিকা। তাতে তার মধ্যে এক ধরণের গৌরববোধ দেখা গেলো।
মনে আছে সেদিন কাজ শেষে জেসিকাকে তার বাড়িতে ড্রপ দিয়েছিল তারেক। তবে ভেতরে যাওয়া হয়নি। জেসিকাও ডাকেনি। অ্যাস্টোরিয়ায় একটা অ্যাপার্টমেন্টে একাই থাকে সে। কাজ শেষের সময়টা পুরোটাই তার নিজের। জেসিকার একাকী জীবন।
আগে থেকেই সতর্কীকরণ ছিল। জানাই ছিল তুষারপাত হবে। হয়েছেও তাই। পুরো শহর ঢেকে গেছে সাদা চাদরে। যখন তুষার ঝরে পরে, আর যখন জমা হয় চারপাশে; বেশ ভালো লাগে। মনে হয় সাদা ভাস্কর্যের আশ্চর্য এক দুনিয়া। আজ ভিজিটে যাওয়া হয়নি তার। সারাদিনই অফিসে থাকতে হয়েছে। ভালোই ছিল দিনটা। হাতের কাজগুলো অনেকটাই গুছিয়ে এনেছে সে। এখন বাড়ি যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে। টেবিলটা গুছগাছ করে ওভারকোটটা গায়ে জড়িয়ে নিল। কাঁধে ঝুলিয়ে নিলো নিজের ব্যাগটা। লিফটের সামনে গিয়ে দেখা হয়ে গেলো জেসিকার সঙ্গে। ‘হাই জেসিকা। তোমাকে তো সারাদিন দেখিনি। ফিল্ডে কাজ ছিল’?
‘আর বলো না, এমন দিনেও বাইরে যেতে হয়েছে। অফিসে ফিরতাম না। জরুরি একটা জিনিস ফেলে গেছি। তাই এসেছি। এখনই বের হয়ে যাবো’।
‘তোমার জন্য অপেক্ষা করবো’?
‘করতে পারো’। বলে হেসে দ্রুতই অফিসের ভেতরে চলে গেলো। এর অল্প কিছুক্ষণ পরেই বের হয়ে এলো। দুজনে বাইরে বের হয়ে এলো একসঙ্গে। তখন অন্ধকার নেমে এসেছে। শীতকালে নিউইয়র্কে দিনটা হয় অনেক ছোট। যখন বিকেল, তখন মনে হয় গভীর রাত। তবে আজ কেমন যেনো অন্যরকম লাগছে। সাদা বরফে নিয়ন বাতির আলো প্রতিফলিত হয়ে রহস্যময় একটা পরিবেশ তৈরি করেছে। রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা কম। অল্প কিছু গাড়ি চলছে। সেই তুলনায় মানুষের সংখ্যা অনেক। আজ ট্রেনগুলো ঠিকমতো চলবে না। বাসেও অনেক মানুষ। এরপরও স্নো এলার্ট থাকায় গাড়ি আনেনি তারেক।
উবার অ্যাপসে ঢুকে একটা গাড়ি ডাকলো তারেক। প্রথম গন্তব্য জেসিকার বাসা। জেসিকার তাতে অবশ্য আপত্তি নেই। এমন সন্ধ্যায় অসংখ্যবার একাকী বাড়ি ফিরেছে সে। তার কাছে কঠিন কিছু কখনই মনে হয়নি। তবে আজ কেন জানি, তারেকের সঙ্গে ফেরার কথাটা ভাবতে ভালোই লাগছে তার। এমনিতে প্রচণ্ড বাস্তববাদী জেসিকা সহজে তার আবেগ অনুভূতি প্রকাশ করে না। বোঝাও যায় না অনেক সময়। ফলে তারেক ঠিক ধরতে পারে না। সে ধরতে চায়ও না। একজন ভালো বন্ধু ও সহকর্মীর বাইরে সে অন্য কিছু ভাবতেও চায় না। তার উপর নিজের পরিবারের প্রতি শ্রদ্ধা ও দায়িত্বশীলতা কখনও ভুলে যেতে চায় না তারেক।
কালো রঙের হোন্ডা অ্যাকর্ড গাড়িটা এসে থামলো জেসিকার অ্যাপার্টমেন্ট এর সামনে। হঠাৎ কি মনে করে জেসিকা বললো, আমি যদি তোমাকে এক কাপ কফি পান করে যেতে বলি, তুমি কি কিছু মনে করবে’?
জেসিকার হঠাৎ এমন কথায় কিছুটা চমকেই উঠলো সে। কোন কিছু ভেবে ওঠার আগেই গাড়ি থেকে নেমেও পড়লো। জেসিকার পেছন পেছন হাঁটতেও শুরু করলো। সিঁড়ি ভেঙে তিনতলায় উঠে গেলো তারা। ভবনে লিফট আছে। তবে হেঁটে উঠতেই ভালো লাগে জেসিকার। তাকে অনুসরণ করে তারেকও উঠে গেলো। এই পথটুকু নিজেদের মধ্যে তেমন কোন কথা হলো না। দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতে দেখা গেলো বেশ পরিপাটি করে গুছানো বাসার ভেতরটা। পরিচ্ছন্ন, ছিমছাম। লিভিংরুমটা বেশ বড়। সেখানে সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে বসলো তারেক। ভেতরে চলে গেলো জেসিকা। একটু সময় নিলো।
এই সময়টুকু তারেককে একা বসে থাকতে হয়েছে। কেমন যেনো ঘোরের মতো লাগছে। আকাশ পাতাল ভাবছে। কিছুক্ষণ পর জেসিকা দুই হাতে দুটি কফি মগ নিয়ে লিভিংরুমে প্রবেশ করলো। বসলো পাশাপাশি। কফির মগে চুমুক দিতে দিতে নানা গল্পে মেতে উঠলো তারা। তবে হঠাৎ কেমন করে যেনো গল্পের বিষয়টা বদলে গেলো। কখন যে কি হয়ে গেলো, দুজনের কেউ কিছু বুঝে উঠতে পারলো না। তাদের গল্পের বিষয় একসময় মানবীয় সম্পর্কের দিকে চলে গেলো। মানবীয় সম্পর্কের জটিল এক ধাঁধার নাম শারীরিক সম্পর্ক। এবার কি তাদের গন্তব্য সেদিকে যাবে! ভেবে হঠাৎ কিছুটা আৎকে ওঠে তারেক। ভেতরে ভেতরে এক ধরনের উত্তেজনা বোধ করে।
সে টের পাচ্ছে, শরীরটা তার কাঁপছে। অস্থির লাগছে। জেসিকার দৃষ্টিও কেমন বদলে যাচ্ছে। একটু কাছে ঘেষে এলো সে। অকারণেই তারেকের হাতের উপর হাত রাখলো। শরীরের ভেতর শির শির করে রক্ত স্রোত বয়ে গেলো তারেকের। তবে বাঁধা দেয়ার কোন কারণ যেনো খুঁজে পেলো না তারেক। একটু একটু করে তারা আরও কাছে আসতে শুরু করলো। দুজনের হাত একে অপরের শরীরের স্পর্ষকাতর জায়গাগুলো খুঁজে নিচ্ছে। ঠোঁটে ঠোঁট গেছে লেপ্টে। সোফা সীমিত এই জায়গা ছাপিয়ে তারা দুজন একসময় আশ্রয় নিয়েছে বিছানায়। বাইরের তুষার ঝড় ছাপিয়ে জেসিকার অ্যাপার্টমেন্টে অনেকদিন পর অন্যরকম একটা ঝড় উঠলো। দুজন ডুবে গেলো দুজনের মধ্যে।
ঝম যখন থামলো, তখন জেসিকা আর তারেক নিজেদের আবিস্কার করলো একই বিছানায়। একে অপরের আলিঙ্গণে। জেসিকা তারেকের দিকে তাকালো। তারেকের মধ্যে লজ্জার একটা হাসি। সেই সঙ্গে এক ধরণের অনিশ্চয়তা। হঠাৎ কি হয়ে গেলো! কোন ধরনের প্রতিরোধ ব্যবস্থা ছাড়াই যে সম্পর্কের মধ্য দিয়ে সে গেলো, তার ফলাফল কি! প্রচণ্ডরকম একটা অপরাধবোধ নিয়ে সে রাতে বাড়ি ফিরলো তারেক।
সেদিনের পর তারেক কেমন যেন অন্যরকম হয়ে গেলো। কিছু একটা তাকে তাড়া করে ফিরছে। কোন কিছুতে স্বস্তি মিলছে না। এমনিভাবে বেশ কিছুদিন চলে গেলো। জেসিকাকে এড়িয়ে চলে তারেক। তাই দেখা হয় না নিজেদের মধ্যে। তবে এরিমধ্যে জেসিকা জানায়, তারেকের সঙ্গে তার কথা আছে। বুকের ভেতরটা ধক করে উঠলো তারেকের। কি কথা তার সাথে!
আজ শীতটা একটু কম। দিনও একটু একটু করে বড় হচ্ছে। ফলে অফিসের পরও কিছুসময় আলো পাওয়া যায়। ব্রুকলীন ব্রিজের নিচে একটা বেঞ্চে পাশাপাশি বসে আছে তারেক আর জেসিকা। তারেকের ভেতরের অস্থিরতা তখন চরমে। বুঝে উঠতে পারছে না কি করবে। সেইদিনের পর থেকে বদলে গেছে তার জীবন। মনে হচ্ছে বিরাট একটা ভুল করে ফেলেছে সে। বাড়িতে গিয়ে স্ত্রী-সন্তানদের দিকেও ভালো করে তাকাতে পারছে না। ভাবতে ভাবতে ব্রিজের দিকে তাকিয়ে থাকে সে। উপর দিয়ে গাড়ি ছুটে যাচ্ছে; আসছে। যাওয়া আসার এই খেলা দেখা হঠাৎ থামাতে হলো জেসিকার কথায়। কোন রকম ভনিতা না করেই জেসিকা বললো, ‘তারেক, আমি প্রেগনেন্ট। আর এই বেবিটা আমি রাখতে চাই’।
ভয়ে শিওরে উঠলো তারেক! বলে কি এই মেয়ে। এসবের মানে কি! ‘জেসিকা কি বলছো এসব’?
‘তোমার ভয় পাওয়ার কোন কারণ নেই। কাল থেকে তোমার সঙ্গে আমার আর দেখাও হবে না। আমি কোনদিন তোমার কাছে যাবো না। তোমার সঙ্গে দেখাও হবে না। এমনকি তোমাকে কোনদিন আমার বেবিটার বাবা হিসেবে কোন দায়িত্ব পালন করতে হবে না। পরিচয়ও দিতে হবে না’। জেসিকা একটানা কথাগুলো বলে যায়। এবার একটু দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে।
তারেক বুঝতে পারে না কি বলবে। ভেতরে ভেতরে যে অস্থিরতা পুষে বেড়াচ্ছে সে, তা যেনো বিরাট এক ঝড়ে রূপ নিয়েছে। সে তাকিয়ে আছে জেসিকার দিকে। ভয় সংক্রামক। কিন্তু জেসিকার মধ্যে ভয়ের কোন লেশ দেখা যাচ্ছে না। কে অপরাধী তা নিয়ে কথা বলতেও সে আগ্রহী নয়। এরিমধ্যে সে পরিস্কার করেছে, ‘পিতৃত্বের দাবি নিয়ে সে কোনদিন আসবে না’। জেসিকার এমন কথায় আশ্বাসের চেয়ে, লজ্জা বেশি পাচ্ছে তারেক। বাবা হবে; এমন সংবাদ কতটা মধুর, সেটা যে জানে। অথচ আজ তার দুনিয়া অন্ধকার লাগছে।
‘তারেক, আমি জানি তোমার সুন্দর একটা ফ্যামিলি আছে। তোমার বাচ্চাদের নিয়ে সুখের একটা জীবন আছে। সেই জীবনের অংশ হওয়ার কোন ইচ্ছা আমার নেই। তোমাকে কেবল সত্যটা জানানোর জন্য আজ ডেকেছি। তাছাড়া সবকিছু পরিস্কার করে বিদায় নিতে চেয়েছি। কাল থেকে তোমার সঙ্গে আমার আর দেখা হবে না। তুমি আমাকে একদম খুঁজতে এসো না। কোনদিন জানতে এসো না ছেলে হয়েছে, নাকি মেয়ে’।
তারেক তার হাতটা বাড়িয়ে দিলো জেসিকার দিকে। সেই হাত কাঁপছে। জেসিকা স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই হাতটা ধরলো। ‘তুমি কি ভয় পাচ্ছো’?
‘ভয় না, নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে। কি বলবো, বুঝতে পারছি না’।
‘কিছু বলতে হবে না। তুমি কেবল আমাকে খুঁজবে না। তোমার সুখী জীবনে আমি কোন ঝামেলা চাই না। কোন অবস্থাতেই তুমি আমাকে খুঁজবে না। আমার বেবিটাকে আমি একাই বড় করে তুলবো। এই সমাজে অনেক সিঙ্গেল মাদার আছে। আমি না হয়, তাদেরই মতো কেউ একজন হবো’। বলে উঠে দাঁড়ালো জেসিকা। এরপর আবারো বলতে শুরু করলো, ‘নিজেকে অপরাধী ভেবো না। যা ঘটেছে, তার জন্য আমরা কেউ তৈরি ছিলাম না। আমি ঠিকই থাকবো। আমরা, মানে আমি আর আমার বেবি ঠিকই থাকবো। তুমি ভালো থেকো’। বলে হাঁটা শুরু করলো জেসিকা। তার চলে যাওয়ার পথে তাকিয়ে থাকলো তারেক। সেই দৃষ্টিতে কেবলই শূন্যতা।
সেই থেকে জেসিকার সঙ্গে আর কখনো দেখা হয়নি তারেকের। অফিসও ছেড়ে গেছে। ফলে মুখোমুখি হওয়ার দায় থেকেও মুক্তি দিয়ে গেছে তাকে। কিন্তু তার অপরাধবোধ থেকে মুক্তি তাকে কেউ দিতে পারেনি। নিজের মনেই জেলখানায় বন্দী জীবন কাটতে থাকে তারেকের। মাঝে মাঝে ভাবে জেসিকার গর্ভে বেড়ে ওঠা তার সন্তান নিশ্চয়ই পৃথিবীর আলো দেখেছে। সেকি ছেলে, নাকি মেয়ে! দেখতে কেমন হয়েছে। কোনদিন তার হাতখানা কি ছুঁয়ে দেখা হবে! দেখা হবে একনজর!
অনেকগুলো বছর পরের এক বিকেল। তারেকের মধ্যে তীব্র অস্থিরতা কাজ করে। সে ব্রুকলীন ব্রিজের নিচের সেই বেঞ্চে গিয়ে বসে থাকে। এখানটাতেই জেসিকার সঙ্গে তার শেষ দেখা হয়েছিল। নিজের অজান্তে ফোন করে জেসিকাকে। ওপাশ থেকে টেলিফোন ধরে জেসিকা বলে, ‘সব বদলে ফেলেছি, তবে ফোনের নম্বরটা ইচ্ছা করেই বদলাইনি। তুমি কোন একদিন ফোন দিতে পারো এই ভেবে’।
‘বলো কি? তুমি তো বলেছিলে আমি যেনো কোনদিন তোমার সঙ্গে যোগাযোগ না করি’।
‘হ্যাঁ বলেছিলাম। তাই তুমি এতগুলো বছর কোন যোগাযোগ করোনি, তাইতো? আমিও চাইনি, তোমার কোন ঝামেলা হোক। তাই একদম আড়াল করেই রেখেছিলাম নিজেকে। তবে কোন একদিন তুমি তোমার সন্তানের খোঁজ নিতে চাইতে পারো, সে কথা ভেবে ফোনের নম্বরটা বদলাইনি’।
তারেক কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকে। এরপর প্রচণ্ড দ্বিধা নিয়েই প্রশ্ন করে, ‘ছেলে নাকি মেয়ে হয়েছিল’?
‘মেয়ে। খুব সুন্দর হয়েছে দেখতে। নাম রেখেছি এলিজাবেথ। তার বেড়ে উঠবার পথে কোন সমস্যা হয়নি। সে ঠিক আছে। মেয়েকে নিয়ে আমিও খুব অআনন্দে আছি। ভালো আছি’।
শুনে বুকের ভেতরটায় কেমন যেন উথাল পাতাল শুরু হয়ে গেলো তারেকের। মুখের সামনে অজানা অচেনা এক কিশোরীর মুখটা ভেসে উঠতে লাগলো। অচেনা সেই মুখের উপর তারেকের ছায়া। অন্য ভুবনের সেই কিশোরীর জন্য তারেকের কত মায়া। কি অদ্ভূত এক চান। বুকের মধ্যে চিন চিন করে ব্যথা হচ্ছে। সেই ব্যথা যেনো তীব্র হচ্ছে। হঠাৎ মনে হলো শ্বাস নিতেও যেনো কষ্ট হচ্ছে। কিছুটা সামলে তারেক প্রশ্ন করলো, ‘তুমি কিছু মনে না করলে, একটা কথা কি বলতে পারি’?
‘হ্যাঁ, নিশ্চয়ই বলো’।
‘মেয়েটাকে কি একবার দেখতে চাইতে পারি’?
কিছুক্ষণ ভেবে টেলিফোনের ওপাশ থেকে জেসিকা জবাব দেয়, ‘দেখতে আসতে পারো। তবে তুমি কিছুতেই নিজের পরিচয় তাকে দিতে পারবে না। কারণ তার দুনিয়ার তোমার কোন অস্বিস্ত নেই। আমার এখনকার বয়ফ্রেন্ড পিটারকে দেখেই সে বড় হচ্ছে। মমতার কোন কমতি তার হচ্ছে না। আমি চাই না, তার ভাবনার জগতে কোন পরিবর্তন আসুক। তা ছাড়া তুমিও নিজের জীবনে ঢেকে রাখা সত্যটা উন্মোচন করে ঝামেলা ডেকে এনো না’।
তারেক চুপচাপ। জেসিকার মতো করে গুছিয়ে কথা সে বলতে পারে না। তার মতো অত সাহসও তার নেই। নিজেকে ভীরু মনে হচ্ছে। তারেক আসলে একজন ভুল মানুষ।
জেসিকা থাকে নিউইয়র্কেরই আপস্টেটের রকল্যান্ড কাউন্টিতে। চমৎকার একটি বাড়ি করেছে সেখানে। বিরাট ছায়া ঢাকা। সেখানেই সরকারি চাকরি করে। শনিবার সাপ্তাহিক ছুটির দিনে বাড়িতেই ছিল সবাই। জেসিকার জীবনের ফেলে আসা সময়ের পুরো গল্পটাই তার বয়ফ্রেন্ড পিটারের জানা আছে। সেই গল্প নিয়ে কখনোই কোন আপত্তি ছিল না তার। সাদাসিধে ভালো মানুষ। চারজনের সুখি সংসার তাদের। এলিজাবেথ ছাড়াও জেসিকা আর পিটারের একটা ছেলে হয়েছে। তার নাম আলবার্ট।
প্রায় পুরোটা দিন এই পরিবারের সঙ্গে কাটিয়েছে তারেক। অনেক বছর পর জেসিকাকে দেখে ভেতরে ভেতরে আবেগতাড়িতও হয়ে পড়েছে। কিন্তু জেসিকা তার আচরণে কোন কিছুই বুঝতে দেয়নি। যেনো বাড়িতে কেবল একজন বন্ধু এসেছে। তার যত্নে অবশ্য কোন ত্রুটি করেনি সে। দিনভর মেয়েটাকে নানাভাবে কাছে পেতে চেয়েছে। মনে মনে তারেক ভেবেছে, এটা তার মেয়ে। এটা তার মেয়ে। অথচ এই পরী বাচ্চাটার উপর তার কোন অধিকার নেই। ভীষণ অসহায় লাগছে তার। এরপরও পুরোটা সময়জুড়ে নিজেকে মেলে ধরতে চেয়েছে তারেক। আবার কবে দেখা হবে, জানা নেই। আর কি দেখা হবে? সেও এ অনিশ্চিত প্রশ্ন।
দিন গড়িয়ে রাত নেমেছে পাহাড়ি জনপদে। আকাশে তারার মেলা। ঝাকে ঝাকে তারা। তারেক এর আগে খেয়াল করেনি নিউইয়র্কের আকাশে এমনভাবে তারা দেখা যায় কিনা। ফেরার জন্য উঠে দাঁড়ালো তারেক। জেসিকা তাকে এগিয়ে দিতে এসেছে বাইরে। পেছনে পেছনে এলিজাবেথও এসেছে। পুরোটা দিন তারেকের সঙ্গে বলতে গেলে তেমন কোন কথাই বলেনি মেয়েটা। বিদায় বেলায় তার বাইরে আসাটা তারেকের কাছে বিস্ময় হয়েই এলো। প্রকৃতি কি মেয়েটার অন্তরকে নাড়া দিয়েছে। কিছু কি জানিয়ে দিয়েছে! হয়তো সে বুঝতে পারছে না। কিন্তু এটুকু অনুভব করছে, চলে যাচ্ছে যে মানুষটা; সে তার পরম আপনজন।
বিদায় নেয়ার জন্য জেসিকার দিকে হাত বাড়িয়ে দেয় তারেক। বাড়িয়ে দেয়া হাতটা ধরে জেসিকা বলে, ‘ভালো থেকো’। গাড়িতে উঠতে যাওয়ার ঠিক আগে হঠাৎ কি মনে করে এলিজাবেথ এর দিকে হাত বাড়ালো তারেক। তাকে চমকে দিয়ে সেই হাত ধরলো মেয়েটা। শরীরে অন্যরকম একটা অনুভূতি স্পর্ষ করলো। এ এক স্বর্গীয় ভালোলাগা। এই ভালোলাগা বর্ণনা করা যায় না। এই ভালোবাসার কোন নাম হয় না। হঠাৎ করে চোখ দুটো দিয়ে স্রোত বয়ে গেলো। অনেক কষ্টে কান্না লুকিয়ে কেবল ‘বাই’ বলে গাড়িতে উঠে পড়লো তারেক। গাড়িতে স্টার্ট দিলো। রাতের নির্জনতা ভেঁদ করে গর্জে উঠলো ইঞ্জিন। সেই শব্দের আড়ালে ঢাকা পড়ে গেলো তারেকের আর্তনাদ, কান্না। তারেক টের পেলো তার প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছে। হৃদয় ভেঙে যাচ্ছে।
গাড়িটা চলতে শুরু করলো। ডানে মাথা ঘুরিয়ে এলিজাবেথকে শেষবার দেখে নিলো। রাস্তায় নেমে এলো গাড়ি। দু’পাশে ঘন গাছের সারি। শীতের জীর্ণতা ছাপিয়ে গাছে গাছে নতুন পাতা দেখা দিয়েছে। গাছের ফাঁক গলিয়ে প্রায়ই উঁকি দিচ্ছে আকাশ। উঁচু নিচু রাস্তা ধরে চলছে গাড়ি। পাহাড়ি রাস্তায় রাতে গাড়ি চালাতে দরকার বাড়তি সতর্কতা। তার মধ্যেও মাঝে মধ্যে আকাশের দিকে তাকাচ্ছে তারেক। অনেক তারার ভিড়ে চোখে পড়লো উজ্জ্বল একটা তারা। তারেক সেই তারার নাম দিলো ‘এলিজাবেথ’। অনেক দূরে থাকা তারা। ঝলমলে সেই তারা তার জীবনের অন্য এক ভালোবাসা। অন্য এক কষ্ট।
দৈনিক কলম কথা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।