বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে ২৫শে মার্চ ছিল একটি নির্মম গণহত্যার দিন। উনিশ’শ একাত্তর সালের ২৫শে মার্চ রাতে নিরস্ত্র বাঙালির উপর পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণের ফলশ্রুতিতে ২৬শে মার্চের প্রথম প্রহরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। শুরু হয়েছিল বাংলাদেশের নয় মাস ব্যাপী স্বাধীনতার লড়াই।
“অপারেশন সার্চ লাইট” নামে পরিচালিত ২৫শে মার্চের সেই অভিযানে প্রায় ৫০ হাজার বাঙালিকে হত্যা করা হয় বলে দাবি করে বাংলাদেশ।
ওই অপারেশনের উদ্দেশ্য ছিল ঢাকাসহ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান শহরগুলোতে আওয়ামী লীগ নেতা ও ছাত্র নেতৃবৃন্দ এবং বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের গ্রেপ্তার করে ও সামরিক অভিযান চালিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পরিচালিত অসহযোগ আন্দোলন কঠোর হস্তে দমন করা এবং পূর্ব পাকিস্তানে, পাকিস্তান সরকারের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা।
তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে তখন তুমুল অসহযোগ আন্দোলন চলছে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জয়ী আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে।
আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালের মার্চের শুরু থেকেই উত্তাল হয়ে উঠেছে ঢাকার রাজপথ। সাতই মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণের পর পরিস্থিতি হয়ে উঠেছে আরও অগ্নিগর্ভ।
মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠক
এমন পরিস্থিতিতে ঢাকায় এলেন সে সময়ের পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এবং ১৬ই মার্চ থেকে শুরু হল মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠক।
মার্চের ২৪ তারিখ পর্যন্ত আলোচনায় সময় গড়িয়ে গেলেও সমাধান মিলল না। পঁচিশে মার্চ রাতে ঢাকায় শুরু হলো সামরিক অভিযান। এরই মধ্যে জানা গেল ইয়াহিয়া খান সেদিনই ঢাকা ত্যাগ করেছেন।
একদিকে যখন এই আলোচনা চলছে, তখনই পশ্চিম পাকিস্তান থেকে শিপিং করপোরেশনের জাহাজে করে পূর্ব পাকিস্তানে অস্ত্র ও সৈন্য আনার খবর প্রকাশ হয়। ধারণা করা হয় আলোচনার নামে সময়ক্ষেপণ করে পাকিস্তানি বাহিনী তাদের সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করেছে।
টিক্কা খানের সবুজ সঙ্কেত
সেই সময়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জনসংযোগ কর্মকর্তা সিদ্দিক সালিক তার বই ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ এ লিখেছেন, শেখ মুজিব আর ইয়াহিয়া খানের মধ্যে আলোচনার কী পরিণাম হয়, তা নিয়ে ২৫শে মার্চ দুপুরে মেজর জেনারেল খাদিম হুসেইন নিজের দপ্তরে বসে যখন ভাবছিলেন, তখন তাকে ফোন করেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান।
সরাসরি বলেন, “খাদিম, আজই করতে হবে কাজটা।”
খাদিম এই নির্দেশের জন্যেই অপেক্ষাই করছিলেন। নিজের কর্মচারীদের সঙ্গে সঙ্গে ওই আদেশ পালনের কথা জানিয়ে দিয়েছিলেন তিনি।
সিদ্দিক সালিক লিখেছেন, “ক্র্যাকডাউনের সময় ঠিক করা হয়েছিল ২৬শে মার্চ রাত একটায়। আশা করা হচ্ছিল যে ততক্ষণে ইয়াহিয়া খান করাচিতে পৌঁছে যাবেন।”
পঁচিশ তারিখ রাত প্রায় সাড়ে এগারোটার সময় ঢাকার স্থানীয় কমান্ডার টিক্কা খানের কাছে অনুমোদন চেয়েছিলেন ক্র্যাকডাউনের সময়টা এগিয়ে আনার। সালিক লিখছেন, “জেনারেল টিক্কা আদেশ দিয়েছিলেন যতটা সম্ভব দেরি করতে। এরপর রাত সাড়ে এগারোটায় পুরো শহরের ওপরে পাকিস্তানি বাহিনী হামলা করেছিল। শুরু হয়েছিল অপারেশন সার্চলাইট।”
যুদ্ধের প্রস্তুতি
তৎকালীন আওয়ামী লীগের নেতা ড. কামাল হোসেন বিবিসি বাংলাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ২৫শে মার্চ সন্ধ্যায় তার বাসভবন, ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর বাড়ি থেকে টেলিফোনে সারা দেশে যুদ্ধের প্রস্তুতির নির্দেশনা দেন।
ড. হোসেন বলেন নির্দেশনা পৌঁছনর ওই প্রক্রিয়ায় তিনিও সম্পৃক্ত ছিলেন।
“পঁচিশ তারিখ সন্ধ্যার দিকে আমরা রিপোর্ট পাওয়া শুরু করলাম যে, সব ট্যাংক ক্যান্টনমেন্টে লাইন আপ করা হচ্ছে, আক্রমণ করার প্রস্তুতি সেখানে চলছে। আমরা এটা বঙ্গবন্ধুকে রিপোর্ট করলাম, বঙ্গবন্ধু তখন বললেন, হ্যাঁ এখন তো মনে হয় তারা অ্যাকশনে যাবে।
শেখ মুজিবুর রহমানের যুদ্ধের প্রস্তুতির সেই নির্দেশ ছিল খুবই সুস্পষ্ট।
“ইনস্ট্রাকশানের একটা ফর্মূলা ছিল, যে মুহূর্তে তারা আক্রমণ শুরু করবে, সেই মুহূর্ত থেকে আমরা স্বাধীন। আঘাত হওয়ার সাথে সাথেই আমরা স্বাধীন। যে যা কিছু পাই, তা নিয়ে আমরা প্রতিবাদ প্রতিরোধে নেমে যাব। এই কথাটা ফোনে আমরা বলা শুরু করলাম। যে যেখানে যে কোন অস্ত্র ধরতে পার, সেটা নিয়ে নেমে প্রতিরোধ গড়ে তোল,” বলেন ড. হোসেন।
পাকিস্তানিদের আক্রমণ
পাকিস্তানি বাহিনী ২৫শে মার্চ মধ্যরাতে আক্রমণ চালায় ঢাকায় রাজারবাগ পুলিশ লাইনে এবং পিলখানায় তৎকালীন সীমান্ত রক্ষী বাহিনী ইপিআর-এর সদর দপ্তরে।
সেই রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের আবাসিক হল জগন্নাথ হল এবং নীলক্ষেতে শিক্ষকদের একটি আবাসিক এলাকাসহ বিভিন্ন জায়গায় ট্যাংকসহ ভারী অস্ত্র নিয়ে নিরস্ত্র মানুষের উপর চড়াও হয় পাকিস্তানি বাহিনী।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এই হামলার ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছিলেন রবিউল আফতাব। তখন তার বয়স মাত্র ছয়। মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবী এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আনোয়ার পাশা ছিলেন তার পিতা।
বিবিসি বাংলাকে ওই ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন রাত্রি একটু বেশি হতেই শোনা গেল প্রচণ্ড গোলাগুলির আওয়াজ। তার এটুকু মনে আছে যে অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই তা বেড়ে ভয়াবহ রূপ ধারণ করল।
“কান ফাটানো আওয়াজ, কিছুক্ষণের মধ্যে চারিদিকে প্রচণ্ড আলো- এখন যেমন আমরা ফ্লাড-লাইট বলি, সেরকম আলো। কিছুক্ষণের মধ্যে শোনা গেল অনেক গাড়ির আওয়াজ। আমাদের ছাদের ওপর কেমন জানি ভারী মচমচে জুতার আওয়াজ। আমরা ভয়ে খাটের নিচে ঢুকে গিয়েছিলাম।”
পরে তিনি শুনেছিলেন ছাদের দেয়ালে চারিদিক থেকে পাকিস্তানি সেনারা এলোপাথাড়ি গুলি চালাচ্ছে। চারিদিকে মানুষের “বাঁচাও বাঁচাও” ভয়ার্ত চিৎকারের মধ্যে ২৫শে মার্চের সেই “বিভীষিকাময়” গোটা রাত্রি কাটায় তার পরিবার।
সেই আক্রমণের মধ্যেই ২৫শে মার্চ দিবাগত রাতে পাকিস্তানি বাহিনী গ্রেফতার করে শেখ মুজিবুর রহমানকে ।
গ্রেফতারের ঘটনার কয়েক ঘন্টা আগে রাত ন’টার দিকে শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে শেষ দেখা করে বিদায় নিয়েছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ, ড. কামাল হোসেন এবং আমীর-উল ইসলাম।
ড. হোসেন বিবিসিকে বলেন তারা সেসময় নিরাপদ জায়গায় গিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলার নির্দেশ পেয়েছিলেন। তাদের বিদায় দেবার সময় শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন তিনি থেকে যাচ্ছেন অন্য এক হিসাব থেকে, বলেন ড. কামাল হোসেন।
“বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, দেখ, আমার সারা জীবনে আমি ঘন ঘন অ্যারেস্ট হয়েছি। আমি জানি আমাকে ধরলে হয়ত তাদের আক্রমণের তীব্রতা অন্তত কিছুটা কমবে। আর আমাকে যদি না পায়, তাহলে প্রতিশোধ নেবে তারা এলোপাথাড়ি আরও লোক মেরে।”
সেই রাতেই ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়ি থেকে পাকিস্তানি বাহিনী শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে। তাকে নিয়ে যায় পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে।
চট্টগ্রামে হামলা
বিভিন্ন বাহিনীর মধ্যে প্রথম প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল সীমান্ত রক্ষী বাহিনী। সেসময় ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর) নামের এই বাহিনীর চট্টগ্রাম অঞ্চলের নেতৃত্বে ছিলেন বাঙালি কর্মকর্তা মেজর রফিকুল ইসলাম।
বিবিসিকে তিনি বলেন ২৪শে মার্চ রাতেই চট্টগ্রাম অঞ্চলের সীমান্তগুলোতে তাদের বাহিনীতে পাকিস্তানি সদস্যদের হত্যা করে পুরো নিয়ন্ত্রণ নেয়া হয়েছিল। তারা ২৫শে মার্চ রাতেই চট্টগ্রাম শহরের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিলেন।
তিনি বলেন ২৫শে মার্চ ষোলোশহরের সেনা হেডকোয়ার্টারের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে পুরো শহরের দখল তারা গ্রহণ করেন রাত ১১টা বিশ মিনিটে।
“আমি অবস্থান নিয়ে ফেলেছি রেলওয়ে পাহাড়ে-২৫শে রাত্রি- তখন ১১টা কুড়ি মিনিট। কিছুক্ষণ পর রাত ১১টা তিরিশের দিকে দেখি একটা গাড়ি রেলওয়ে হিল এবং বাটালি হিলের মধ্যে যে রাস্তা, সে রাস্তা দিয়ে পোর্টের দিকে যাচ্ছে। আমার এক সুবেদার, আইজুদ্দীন নায়েব সুবেদার বলল যে, সার এখানে তো অনেকগুলো পাকিস্তানি সৈন্য আছে- পাঞ্জাবি, একটা রকেট লঞ্চার মারি! আমি বললাম রাখো, ওরা বোধহয় দেখছে রাস্তাটা পরিষ্কার আছে কিনা!”
মেজর ইসলাম বলেন তার ধারণা পাকিস্তানি সেনাদের পরিকল্পনা ছিল রাস্তা পরিষ্কার থাকলে পোর্টে যেসব অস্ত্রশস্ত্র আছে সেগুলো নিয়ে ক্যান্টনমেন্টে যাবে। তিনি তার সুবেদারকে বলেছিলেন সেটা হলে অস্ত্র নিয়ে ফেরার সময় আমরা আক্রমণ চালিয়ে অস্ত্রগুলো ধ্বংস করতে পারব।
তিনি জানান ওই গাড়িটা কিছুদূর গিয়ে আগ্রাবাদে ঢোকার মুখে একটা পেট্রল পাম্পে থামে। “ওখানে আমাদের বাঙালিরা টায়ার জ্বালিয়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছিল। এর দু তিন মিনিটের মধ্যে দেখি খুব দ্রুত একটা জিপ সেখানে গিয়ে পৌঁছয়। সেটাও ওখানে থামে এবং কিছুক্ষণ পর দুটো গাড়িই একসাথে ফিরে আসে। পরে জেনেছিলাম প্রথম গাড়িতে জিয়া সাহেব পোর্টে যাচ্ছিলেন। সোয়াত জাহাজ থেকে অস্ত্র খালাস করার জন্য তাকে দায়িত্ব দিয়ে পাঠানো হয়েছিল। তখনও শহর আমাদের নিয়ন্ত্রণেই ছিল।”
তিনি বলেন ওই ব্যারিকেডে আটকে যাবার সময় বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণের খবর জিয়াউর রহামনের কাছে পৌঁছে দেয়া হয় বলে তিনি পরে জেনেছিলেন।
মেজর রফিকুল ইসলাম জানান চট্টগ্রাম শহরে তাদের নিয়ন্ত্রণের ওপরে পাকিস্তানি বাহিনী আক্রমণ শুরু করেছিল পরের দিন ২৬শে মার্চ।
বাংলাদেশের বিভিন্ন শহরে পাকিস্তানি সেনাদের এই অভিযান ‘অপারেশন সার্চলাইট’ চলে ১০ই এপ্রিল পর্যন্ত।
স্বাধীনতার ঘোষণা
শেখ মুজিবুর রহমান ২৬শে মার্চের প্রথম প্রহরে আটক হবার আগেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন। সেই ঘোষণা তিনি দেন ধানমন্ডির ৩২ নম্বর থেকেই।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র তাদের সম্প্রচার শুরু করে ২৬শে মার্চ। তৎকালীন রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত বেতারের চট্টগ্রামের কয়েকজন কর্মী শহর থেকে অনেকটা দূরে নিরাপদ জায়গা হিসাবে কালুরঘাটে বেতারেরই ছোট্ট একটি কেন্দ্রে তাদের প্রথম অনুষ্ঠান করেছিলেন।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অন্যতম সংগঠক বেলাল মোহম্মদ বিবিসি বাংলাকে বলেন ওই অনুষ্ঠানেই স্বাধীনতার সেই ঘোষণা প্রথম সম্প্রচার করা হয়। শেখ মুজিবুর রহমানের নামে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেছিলেন রাজনীতিকদের মধ্যে চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ হান্নান।
“সকালবেলা ২৬শে মার্চ আমরা শুনতে পেয়েছি একটা মাইকিং যে গত রাতে ঢাকায় আকস্মিকভাবে পাকিস্তান আর্মি নিরস্ত্র জনপদে আক্রমণ করেছে। এবং খণ্ড খণ্ড যুদ্ধ চলছে। এই অবস্থায় আমাদের মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। এইটুক মাইকিং আমরা শুনেছি।
“ওই সময় দুপুরবেলা একটা লিফলেট পেলাম হাতে। আওয়ামী লীগের ইউনিয়ন পর্যায়ের ড. আনোয়ার আলি একটা কাগজ আমার হাতে দিলেন। উনি নিজে বললেন একটা তারবার্তা এসেছে ঢাকা থেকে। আমরা এটার অনুবাদ করে এখন লিফলেট আকারে ছেড়েছি আর মাইকিংও করেছি আমরা।”
তিনি বলেন কালুরঘাট থেকে প্রথম সেই ঘোষণা সম্প্রচারের ব্যবস্থা তারা করতে পেরেছিলেন সন্ধ্যা ৭টা ৪০ মিনিটে।
তিনি বলেন সেই প্রথম অনুষ্ঠানে এম এ হান্নান শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণাটি পড়েন এবং তার ভিত্তিতে একটি বক্তৃতাও দেন।
“আর আমরা বেতার কর্মীরা নিজেদের ভয়েসে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার তারবার্তার অনুবাদ যেটা লিফলেট আকারে পেয়েছিলাম, সেটা বিভিন্ন কণ্ঠে বারবার প্রচার করি ২৬শে মার্চ প্রথম ট্রান্সমিশানের এক ঘন্টার মত অনুষ্ঠানে।”
কালুরঘাট কেন্দ্র থেকে ২৭শে মার্চ সন্ধ্যাতেও দ্বিতীয়বারের মত অনুষ্ঠান সম্প্রচারে সক্ষম হয় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। সেদিনের অনুষ্ঠানে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন জিয়াউর রহমান। সেসময় তিনি সেনবাহিনীতে মেজর পদমর্যাদায় কর্মরত ছিলেন।
বেলাল মোহম্মদ জানান জিয়াউর রহমান ওই ঘোষণা পাঠ করেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমানের নামে।
“স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করার জন্য আমি যখন এদিক ওদিক খোঁজ করছি, এক বন্ধু আমাকে বললেন যে, একজন মেজর আছেন পটিয়াতে। তিনি সোয়াতের অস্ত্র নামাবার অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে দেড়শ সৈন্য নিয়ে হেডকোয়ার্টারের বাইরে আছেন পটিয়াতে। এ খবর শুনে ২৭শে মার্চ দিনের বেলায় আমি পটিয়াতে চলে যাই।”
বেলাল মোহম্মদ জানান, তার অনুরোধে বেতার কেন্দ্রের নিরাপত্তা রক্ষায় পটিয়া থেকে সৈন্য নিয়ে কালুরঘাটে যান জিয়াউর রহমান ।
“পটিয়া থেকে আমরা যখন কালুরঘাট পৌঁছলাম, তখন প্রায় সন্ধ্যা হয় হয়। এবং এসেই প্রোগ্রাম শুরু করা হল। এবং আমি হঠাৎ, কী মনে করে আমি জানি না, বললাম- আচ্ছা মেজর সাহেব, এখানে তো আমরা সব মাইনর। আপনি একমাত্র মেজর। আপনি কি নিজের কণ্ঠে কিছু বলবেন? উনি নড়েচড়ে উঠলেন। বললেন- হ্যাঁ সত্যি তো, কী বলা যায় বলুন তো? কাগজ বের করা হল, উনি কলম নিলেন। প্রত্যেকটি যে শব্দ তিনি উচ্চারণ করেছেন, আমিও উচ্চারণ করেছি। তারপরে লেখা হয়েছে।”
বেলাল মোহম্মদ বলেন এভাবেই তৈরি হয়েছিল জিয়াউর রহমান কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে ২৭শে মার্চ রাত সাড়ে সাতটার অনুষ্ঠানে শেখ মুজিবের নামে যে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেছিলেন তার বয়ান।
তবে, এই স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে তৈরি হয় রাজনৈতিক মতপার্থক্য। বিএনপি দাবি করে তাদের দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানই প্রথম স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে স্বাধীনতার ঘোষণার খবর
বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত থেকে দেখা যায়, ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাতের ঢাকার পরিস্থিতি ও শেখ মুজিবকে আটকের ঘটনা ২৭শে মার্চেই বিশ্বের অন্তত ২৫টি দেশের পত্রিকা বা সংবাদ সংস্থার খবরে প্রকাশিত হয়।
“বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা: ফ্যাক্টস অ্যান্ড উইটনেস (আ.ফ.ম সাঈদ)” বইতে স্বাধীনতার ঘোষণা সম্পর্কে বিদেশী সংবাদপত্র ও সংবাদ মাধ্যমের রিপোর্টের একটি সংকলন প্রকাশ করা হয়েছে।
ভয়েস অব আমেরিকার খবরে বলা হয়: “…ঢাকায় পাকিস্তান বাহিনী আক্রমণ শুরু করেছে। মুজিবুর রহমান একটি বার্তা পাঠিয়েছেন এবং সারা বিশ্বের নিকট সাহায্যের আবেদন জানিয়েছেন।…”
দিল্লির দ্য স্টেটসম্যান-এর খবর ছিল: “বাংলাদেশ স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে, সামরিক অভিযানের প্রতিবাদে রহমানের পদক্ষেপ। একটি গোপন বেতার থেকে প্রচারিত ভাষণে শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের পূর্বাংশকে স্বাধীন বাংলাদেশ হিসেবে নতুন নামকরণ করেছেন।”
দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ, লন্ডন: ২৭শে মার্চের পত্রিকায় ‘সিভিল ওয়ার ফ্লেয়ারস ইন ইস্ট পাকিস্তান: শেখ এ ট্রেইটর, সেইস প্রেসিডেন্ট’ শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদে শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণা ও ইয়াহিয়া খান তার বেতার ভাষণে শেখ মুজিবকে বিশ্বাসঘাতক বলার কথা উল্লেখ করা হয়।
ব্রিটেনের দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় ২৭শে মার্চের এক খবরে বলা হয়, “…২৬শে মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতির উদ্দেশ্যে রেডিওতে ভাষণ দেয়ার পরপরই দ্য ভয়েস অব বাংলাদেশ নামে একটি গোপন বেতারকেন্দ্র থেকে শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়েছে। তাঁর এই ঘোষণা অপর এক ব্যক্তি পাঠ করেন।”
এর বাইরে ভারতের বহু সংবাদপত্র এবং আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, ক্যানাডা, দক্ষিণ আফ্রিকা, জাপান, হংকং, নরওয়ে, তুরস্ক, সিঙ্গাপুরসহ অনেক দেশের খবরে স্থান পায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার খবর।
আর্জেন্টিনার বুয়েনস আয়ারস হেরাল্ডের ২৭শে মার্চের সংখ্যার একটি খবরের শিরোনাম ছিলো, “বেঙ্গলি ইন্ডিপেন্ডেন্স ডিক্লেয়ার্ড বাই মুজিব।”
নিউইয়র্ক টাইমস-এও শেখ মুজিব ও ইয়াহিয়ার ছবি ছাপানো হয়। পাশেই লেখা হয় “স্বাধীনতা ঘোষণার পরই শেখ মুজিব আটক”।
বার্তা সংস্থা এপির খবর ছিল: “ইয়াহিয়া খান পুনরায় মার্শাল ল দেয়ার ও আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণার পর পূর্ব পাকিস্তানে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছে।”
আয়ারল্যান্ডের দ্য আইরিশ টাইমস-এর শিরোনাম ছিল – পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণা আর সাথে ছিল শেখ মুজিবের ছবি।
ব্যাংকক পোস্ট-এর খবরে বলা হয়, “শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ নাম দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণার পর পাকিস্তানে গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।”
পাকিস্তানি বাহিনীর ২৫শে মার্চের আক্রমণের মুখে যে প্রতিরোধ গড়ে উঠেছিল পূর্ব পাকিস্তানে, যে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে বাঙালি জনগণকে উদ্বুদ্ধ করেছিল শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণা, নিরস্ত্র বাঙালির সেই প্রতিরোধ রূপ নিয়েছিল নয় মাস ব্যাপী সশস্ত্র রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা যুদ্ধে।
রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে ১৯৭১ সালে ২৫শে মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানি বাহিনী রাতের আঁধারে নিরস্ত্র ও ঘুমন্ত মানুষের ওপর যে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল, অত্যাধুনিক অস্ত্রসজ্জিত কোনও বাহিনীর আক্রমণের সেই ঘটনা, পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম বিরল ও ভয়াবহ একটি গণহত্যার ঘটনা।
পঁচিশে মার্চকে “জাতীয় গণহত্যা দিবস” হিসাবে পালনের জন্য বাংলাদেশের সংসদে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয় ২০১৭ সালের ১১ মার্চ।
দৈনিক কলম কথা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।