কাজ শেষ না করেই সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়েছে ১২৪টি উন্নয়ন প্রকল্প। এসব প্রকল্পের পেছনে খরচও হয়েছে কোটি কোটি টাকা। কিন্তু পুরো কাজ শেষ করা সম্ভব হয়নি। ফলে এগুলো গ্রহণের মূল উদ্দেশ্য কতটুকু পূরণ হয়েছে তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির আওতায় এসব প্রকল্প সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) বাস্তবায়ন অগ্রগতি পর্যালোচনা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এমন চিত্র। আজ প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করা হবে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) বৈঠকে। তবে এমন ঘটনা কেন ঘটছে তার সঠিক কোনো কারণ জানাতে পারেননি সংশ্লিষ্টরা।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ইনস্টিটিউট অব ইনক্লুসিভ ফিন্যান্সিয়াল অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইএনএম) নির্বাহী পরিচালক ড. মুস্তাফা কে মুজেরী মঙ্গলবার বলেন, এরকম কাজ ঠিক হয়নি। এর অর্থ হতে পারে প্রকল্প দলিলে যেসব কাজ উল্লেখ ছিল তা পুরোপুরি শেষ করা হয়নি। অথবা এমন হতে পারে যে, প্রকল্প বাস্তবায়ন পর্যায়ে গিয়ে দেখা যায় এসব কাজের প্রয়োজন ছিল না। প্রকল্প তৈরির সময় বেশি টাকা নেওয়ার জন্য হোক বা অন্য যে কোনো কারণে হোক কাজগুলো ধরা হয়েছিল। যে কারণেই হোক এটি পরিকল্পনা ও আর্থিক শৃঙ্খলার পরিপন্থি।
কেননা একদিকে যেসব কাজ করার কথা সেগুলোতো হলোই না, অন্যদিকে যে টাকা খরচ হলো তা থেকেও পুরোপুরি সুবিধা পাওয়া গেল না। এটা এক ধরনের অপচয় ছাড়া কিছুই হলো না। তিনি আরও বলেন, প্রকল্প ডিজাইন যখন করা হয়েছিল সেখানে ভুল থাকতে পারে। ফলে পরে তড়িঘড়ি দায়সারাভাবে প্রকল্প শেষ করার মতো ঘটনা ঘটতে পারে। যে কারণেই হোক, গোড়ায় যে গলদ ছিল তারই প্রকৃত উদাহরণ এসব প্রকল্প। এ থেকে বোঝা যায় রাজনৈতিক বিবেচনায় হোক আর যে কোনো উদ্দেশ্যেই হোক এডিপিতে যেনতেন ভাবে প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে। সেটি না হলে সমাপ্ত হওয়া প্রকল্পের প্রায় অর্ধেকের ক্ষেত্রে কেন এমন ঘটনা ঘটবে?
আইএমইডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে এডিপিভুক্ত মোট প্রকল্প ছিল ১ হাজার ৯৪৫টি। এর মধ্যে ৪৩৯টি উন্নয়ন প্রকল্প সমাপ্ত করার জন্য নির্ধারিত ছিল। কিন্তু নির্ধারিত সময় অর্থাৎ ২০২১ সালের জুনের মধ্যে শেষ হয়েছে ২৩৬টি প্রকল্প। এছাড়া সমাপ্তর জন্য নির্ধারিত না থাকলেও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগ থেকে সমাপ্ত করা হয়েছে আরও ২৮টি প্রকল্প। ওই অর্থবছরে মোট প্রকল্প শেষ করা হয় ২৬৪টি। সমাপ্ত ঘোষণা করা প্রকল্পগুলোর মধ্যে শতভাগ কাজ শেষ হয় ১৪০টির। বাকি ১২৪টি প্রকল্পের কাজ বাকি রেখেই সমাপ্ত করা হয়েছে। এগুলো পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, কোনোটি ৩৫-৪০ শতাংশ কাজ হলেও প্রকল্প সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়। ৬০ শতাংশের নিচে কাজ হয়েছে এমন প্রকল্পের সংখ্যাও রয়েছে উল্লেখযোগ্য। তবে কেন এমন হয়েছে তার কোনো ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি প্রতিবেদনে।
এর আগে ২০১৯-২০ অর্থবছরে মোট ৩০৫টি উন্নয়ন প্রকল্প সমাপ্ত করার লক্ষ্য ছিল। কিন্তু ২০২০ সালের জুনের মধ্যে ১৪১টির কাজ শেষ করা সম্ভব হয়। এছাড়া লক্ষ্যমাত্রা ছিল না কিন্তু তারপরও বাস্তবায়ন কাজ শেষ হয় ৪১টি প্রকল্পের। সব মিলিয়ে ওই অর্থবছরের শেষ হয়েছে ১৮২টি উন্নয়ন প্রকল্প। এগুলোর মধ্যে ৯০টি প্রকল্পের কাজ শতভাগ শেষ হয়েছে। বাকি ৯২টির কাজ শতভাগ শেষ না হলেও সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়।
আইএমইডির সাবেক সচিব আবুল মনসুর মো. ফয়জুল্লা মঙ্গলবার বলেন, এসব প্রকল্পের বিষয়ে অবশ্যই ভাববার আছে। কেননা শতভাগ কাজ শেষ না করে প্রকল্প সমাপ্ত ঘোষণার মানেই হচ্ছে কোন কোন অঙ্গ হয়ত বাদ দেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে প্রকল্পটি সম্ভাব্যতা যাচাই হয়তো ঠিকঠাক করা হয়নি। ফলে বাস্তবায়ন পর্যায়ে গিয়ে কিছু কিছু কাজ বাদ দেওয়া হয়েছে। এতে প্রকল্পটির উদ্দেশ্য যেমন ব্যাহত হতে পারে, তেমনি যে টাকা ব্যয় হয়েছে সেটিও কতটুকু কাজে লেগেছে তা প্রশ্নসাপেক্ষ। তাই এরকম প্রকল্পের বিষয়ে বিস্তারিত তদন্ত করে দেখা দরকার।
আইএমইডির প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ইনস্টিটিউশনাল কো অপারেশন (বিটুইন স্ট্যাটিসটিকস সুইডেন অ্যান্ড বিবিএস) প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয় ২০১৯ সালের জুলাইয়ে। শেষ করা হয় ২০২০ সালের জুনে। এটির মোট ব্যয় ছিল ১৮ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। এর মধ্যে খরচ হয়েছে ৬ কোটি ৮১ লাখ টাকা। প্রকল্পটি আর্থিক অগ্রগতি দাঁড়িয়েছে ৩৬ দশমিক ৫৩ শতাংশ। আর বাস্তব অগ্রগতি হয়েছে ৩৮ শতাংশ।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) মহাপরিচালক মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, এ প্রকল্পটির ডিপিপিতে (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) যা ছিল প্রথম দিকে সুইডেন সব মেনে নিয়েছিল। অর্থায়ন ছিল সুইডেনের। কিন্তু প্রকল্প শুরুর পর তারা তাদের মতো করে অর্থ ব্যয় শুরু করে। অর্থাৎ আমাদের যা প্রয়োজন সেটি না করে তারা ইচ্ছমতো টাকা খরচ করতে থাকে। এমনটি সুইডেনের একজন পরামর্শক ছিলেন যিনি সুইডেন ভাষা ছাড়া কিছুই বোঝেন না বা বলতেও পারেন না। তিন তার ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য একটি গাড়িও কেনেন প্রকল্পের টাকায়। এরকম পরিস্থিতিতে তখনকার সচিব স্যারের সিদ্ধান্তে প্রকল্পটি বন্ধ করে দেওয়া হয়।
সেকেন্ড স্মল অ্যান্ড মিডিয়াম সাইজ এন্টারপ্রেনিওর শীর্ষক প্রকল্পটি শুরু হয় ২০১৭ সালের জুলাইয়ে। পরে মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২১ সালের জুনে সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়। এটির ব্যয় ধরা হয় ১৬ কাটি ৭১ লাখ টাকা। খরচ হয়েছিল ১৪ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। কিন্তু বাস্তব কাজ শেষ হয় ৪৬ শতাংশ। তবে আর্থিক অগ্রগতি ছিল ৮৬ দশমিক ৪৮ শতাংশ। একই অবস্থা দেখা যায় প্রাণী ও মুরগির ক্ষেত্রে রোগ নির্ণয়সংক্রান্ত প্রকল্পে। এটি ২০১২ সালে হাতে নেওয়া হয়। দীর্ঘ ৯ বছর ধরে চললেও বাস্তব অগ্রগতি হয় ৬০ শতাংশ । আর্থিক অগ্রগতি দাঁড়ায় ৫৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ।
এ অবস্থায় সমাপ্ত করা হয়েছে। এরকম আরও কয়েকটি উল্লেখযোগ্য প্রকল্প হচ্ছে-টেকনিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রজেক্ট প্রপোজাল (টিপিপি) ফর প্রজেক্ট ডিজাইন অ্যাডভান্স (পিডিএ) ফর সিটি রিজিওন ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট ইনভেস্টমেন্ট প্রজেক্ট। এটির আর্থিক অগ্রগতি ৪৪ দশমিক ২৮ শতাংশ এবং বাস্তব অগ্রগতি ৪৫ শতাংশ। কনস্ট্রাকশন অব কানেকশন রোড উইথ শেখ হাসিনা ব্রিজ অন মহানন্দা রিভার আন্ডার চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌরসভা। এটির বাস্তব অগ্রগতি ৩৩ দশমিক ৬৭ শতাংশ এবং আর্থিক অগ্রগতি ২৭ দশমিক ৬৯ শতাংশ।
দৈনিক কলম কথা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।