কাজী শাহনেওয়াজ আফরিন সিমি। জন্ম পঞ্চগড় উপজেলার গলেহাকান্তমনি গ্রামে। বাবা ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং মা গৃহিণী। বিয়ের পর পড়াশোনা শেষ করেছেন তিনি। চাকরি না করে ইচ্ছা ছিল নিজের প্রচেষ্টায় কিছু করবেন। আলাদা পরিচয় তৈরি করবেন। প্রথম দিকে তেমন একটা সাহস করে উঠতে পারেননি। চাকরির সুযোগ থাকলেও সন্তানের ভবিষ্যতের কথা ভেবে করা হয়নি।
ঘরে বসেই কিছু করার চিন্তা নিয়ে ধীরে ধীরে এগোতে থাকেন। তখন করোনার কথা মাথায় রেখে ভাবেন অনলাইনে ব্যবসা করবেন। ঘরে বসেই প্রোডাক্ট বিক্রি করবেন। অল্প পুঁজি নিয়ে ‘জুনাইরাস সিক্রেট (Junayra’s secret)’ নামে একটি ফেসবুক পেজ খোলেন।
ছোটবেলা থেকেই সিমি টেইলারকে দিয়ে নিজের পছন্দমতো ড্রেস বানাতেন ও সেগুলোয় সুই-সুতা দিয়ে হাতের কাজ করতেন। শাড়ি এবং ওয়ালম্যাট তৈরি করতেন। তাই অনেক আগে থেকেই তার স্বপ্ন ছিল নিজের ডিজাইনে কিছু করবেন। প্রথম দিকে শুধু জামদানি শাড়ি নিয়ে কাজ শুরু করলেও মনে থাকা স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে চেষ্টা করতে থাকেন। নতুন উদ্যোম নিয়ে আবার কাস্টমাইজ ড্রেস বিক্রি শুরু করেন।
সিমি বলেন, সুই-সুতার প্রতি আগ্রহ থেকেই নিজে ডিজাইন করা ড্রেস, ওয়ান পিস ও গাউন নিয়ে কাজ শুরু করি। প্রথমেই গাউন ড্রেস, কটি ও হিজাবগুলো বাজিমাত করতে থাকে। ডিজাইনা করা গাউনগুলো হিজাব ও ওয়েস্টার্ন দু’ভাবেই পরা যায় বলে ব্যাপক সাড়া পাই। তাছাড়া কাপড় ও সেলাইয়ের ভালো কোয়ালিটির কারণে এক কাস্টমার বেশ কয়েকবার আমার কাছ থেকে ড্রেস নিয়ে রিপিট কাস্টমার হন। ফলে রিপিট কাস্টমারের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।
তাছাড়া দেশের গণ্ডি পেরিয়ে লন্ডন, আমেরিকা, ফ্রান্স, ইতালি, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, স্পেনসহ বিভিন্ন দেশে যাচ্ছে আমার ড্রেস। দেশের বাইরে থেকেও একেকজন কাস্টমার আমার কাছ থেকে বারবার ড্রেস অর্ডার করে রিপিট কাস্টমার হচ্ছেন। লন্ডন, ইতালি ও আমেরিকায় পাইকারিতে যাচ্ছে আমার ড্রেস। এখন আমার মাসে আয় ২ লাখ টাকার উপরে।
তিনি আর বলেন, আমি মনে করি শুধু লাগামহীন পণ্য বিক্রি করে কোটিপতি হলেই সফল উদ্যোক্তা হওয়া যায় না। একজন সফল উদ্যোক্তা হতে হলে কাস্টমারের আস্থা ও বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করা জরুরি। আমার কাস্টমারের সংখ্যা তুলনামূলক কম। কিন্তুু রিপিট কাস্টমারের সংখ্যা বেশি বলে সেল বেশি হয়। কোয়ালিটিফুল ড্রেস সেল করে রিপিট কাস্টমারের সংখ্যা বাড়িয়েছি। দেশ ও দেশের বাইরের একেকজন কাস্টমার আমার কাছ থেকে ৫-৬টা গাউন, কটি, শাড়ি ও ড্রেস নেওয়ার পরও নতুন করে ৭-৮টি ড্রেস অন্য কালার অর্ডার করেছেন।
কিছু কাস্টমার আছেন, যারা পেজে নতুন কিছু কালেকশন আসলে সাথে সাথেই সেটা অর্ডার করে রাখেন। আর কিছু কাস্টমার সবসময় আমাকে বলতে থাকেন নতুন কোনো কালেকশন আনলে যেন তাদের দেই। আমার কাছ থেকে হোলসেল ড্রেস নিয়েও অনেকে ব্যবসা শুরু করে স্বাবলম্বী হচ্ছেন। আমি মনে করি, আমার বড় সফলতা কাস্টমারের বিশ্বাস, আস্থা ও ভালোবাসা।
কিছুটা আক্ষেপ নিয়ে তিনি বলেন, প্রথমে কারো কাছ থেকেই কোনো প্রকার সাপোর্ট পাইনি। ব্যবসার শুরুতে মানুষের অনেক কটুকথা ও সমালোচনা শুনতে হয়েছে। জীবনের কঠিন সময় একাই পার করেছি। কিন্তু কখনো ভেঙে পড়িনি। শত বাধার পরও নিজের দুই সন্তান, সংসার ও ব্যবসাকে সমানতালে একা হাতে চালিয়ে নিয়েছি। স্বামী তার চাকরি নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। তাই প্রোডাক্ট সোর্সিং, মার্কেটিং, কাস্টমার দেখাশোনা এবং ডেলিভারি ম্যান—সব কিছু আমাকেই করতে হতো। একমাত্র স্বামীর মানসিক সাপোর্ট ও নিজের চেষ্টায় শত বাধা অতিক্রম করে এগিয়ে যাই। তবে ব্যবসায় ভালো করার পর অনেকেই উৎসাহ দিয়েছেন।
কাস্টমাইজ ড্রেসের পাশাপাশি সিমির অনলাইন পেজে জামদানি শাড়ির চাহিদাও ব্যাপক। শাড়িগুলো নারায়ণগঞ্জের জামদানি পল্লি থেকে আনা হয়। এছাড়া টাঙ্গাইল ও তাঁতের শাড়ি বিক্রি করা হয়। শাড়ির জন্য বিদেশ থেকেও অনেক অর্ডার আসে। সেগুলো কুরিয়ারের মাধ্যমে পৌঁছে দেওয়া হয়।
সিমি বলেন, ভালো কোয়ালিটির সাথে যদি ইউনিক ড্রেস পেতে চান, তাহলে একদিন Junayra’s secret হবে সহ কাস্টমারের আস্থা ও ভালোবাসার নাম।
সব মিলিয়ে সিমির মনে থাকা স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে পেরেছেন। পাশাপাশি মানসম্মত পণ্য বিক্রি করে ক্রেতার চাহিদা পূরণ করে একটি স্থায়ী অবস্থান তৈরি করছেন। এভাবে সিমির প্রতিষ্ঠিত অনলাইন ব্যবসার স্বপ্ন, উদ্যোম আর সাফল্য গাথা দেশের হাজারো তরুণ উদ্যোক্তাকে উৎসাহ এবং সাহস জোগাবে।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে সিমি বলেন, ব্যবসাকে সবার মাঝে পৌঁছে দেওয়া ও প্রতিষ্ঠানকে একটি ব্র্যান্ড হিসেবে দাঁড় করানোর স্বপ্ন আছে। সৎভাবে ব্যবসাকে আরও বড় করতে চাই। ইচ্ছে আছে এবছর ভালো কোনো একটা জায়গায় শো-রুম দেবো। কাস্টমারদের ভালোবাসায় আমি যেন আরও সফলতা অর্জন করতে পারি, সবার কাছে এই দোয়া চাই।
দৈনিক কলম কথা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।