একসময় গ্রাম বাংলার মানুষের রাতের বেলার সাথী ছিল হারিকেন ও কুপি বাতি । রাতের বেলায় মহিলারা সব কাজে এ ঘর থেকে ও ঘরে হারিকেন নিয়ে চলাফেরা করতো।মাঝরাতে বাহিরে যেতে হলেও ভরসা ছিল এই হারিকেন বা কুপিবাতি। কুপিবাতির চেয়ে হারিকেনের ব্যবহারটা ছিল বেশি।
তখনকার দিনে শুধু ঘরে নয় ঘুটঘুটে অন্ধকার রাতে এ গাঁও থেকে ও গাঁয়ে যেতে লোকেরা হারিকেন বহন করতো।নিশি রাতে মনের মানুষের সাথে দেখা করতে হারিকেন ছিল অন্যতম সঙ্গী। প্রিয় মানুষটার অবস্থান জানান দিতেই হারিকেন ব্যবহার করা হতো।মনের সখি বুঝে যেতো ঐ বুঝি সুজন দাঁড়িয়ে রইলো।হে আলোটা সুজনেরই।তৎকালে প্রাণের স্বামী হাঁট থেকে ফিরতে রাত হলে ঘরের ঢেলায় কুপি জ্বালিয়ে পথ আলোকিত করতো গাঁয়ের বধূরা।
এভাবেই হারিকেন ব্যবহার হতো বাংলার প্রতিটি ঘরে ঘরে।হারিকেন ছিল মূলত টিনের তৈরি একটি ল্যাম্প বাতির মতো।হারিকেন তৈরি করার কিছু আলাদা মানুষ ছিলো।
গঞ্জের হাঁটে হারিকেন কেনা যেতো।তবে কুপি বাতি অনেকে ঘরেই তৈরি করতো।হারিকেন কাঁচের আবরণ বিশিষ্ট একটি আলোর প্রদীপ।
গোলাকার একটি কাঁচ পিন্ড যার উপরে ও নিছে আনারসের মতো।নিছের অংশে টিনের একটি তেলের ট্যাংক থাকতো।আর ট্যাংকের ভিতর ঢালা হতো কেরোসিন।পেঁচানো রশি দিয়ে বানানো হতো রেশা।সেই রেশার এক চতুর্থাংশ তেলের ট্যাংকটিতে চুবানো হতো। বাকি এক অংশ কাঁচের উপরে থাকতো।দিয়াশলাই দিয়ে আগুন দিলেই আলো দিতে শুরু করতো হারিকেন।পাশেই একটি র্্যাগুলেটর থাকতো যা দিয়ে আলো কমানো-বাড়ানো যেতো। উপরের অংশে তারের একটি হাতল থাকতো।
মূলত এই হাতল দিয়ে সহজেই হারিকেন বহন করা যেত।কুপি বাতির কোন হাতল নেই।ঔষধের কাঁচের শিশা দিয়ে অনেকে ঘরেই তৈরি করতো কুপিবাতি।তবে পিতলের তৈরি কুপি বাতির বেশ কদর ছিলো।সেসময় বিয়েতে পিতলের কুপি দেওয়া হতো।সবার কাছে পিতলের কুপি থাকতো না।আগেকার দিনে হারিকেন ও কুপি ব্যবহার ছিলো বহুগুণে। ছিলোনা কোন টর্চলাইট।
গোধূলী বেলা শেষে মানুষের ঘরে আলোকিত করতো এই হারিকেন ও কুপিবাতি।কেরোসিন তেলের ব্যবহার ছিলো বেশ।গ্রামের দোকানে কেরোসিন বিক্রি হতো মাগরিবের নামাজের আগেই মহিলারা হারিকেন ও কুপি প্রস্তুুত করতো।রাত জেগে ধান ভানতো,ঢেঁকি চালাতো এই হারিকেনের আলোয়।তেল কমে এলে আলোও কমে আসতো।তেলের উপর নির্ভর করতো আলোর পরিমাণ।
কিন্তুু এক সময়ের আঁধারে আলোর সাথী হারিকেন বিদ্যুৎ এর দাপটে হারিয়ে গেছে অচিরেই। এখন আর হারিকেন দেখা যায় না। ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে বিদ্যুৎ। রাস্তা-ঘাট,হাঁট- বাজারে এখন বিদ্যুৎের দাপট।
বিজ্ঞানের এই মহা আবিষ্কার নিঃসন্দেহে জাতীর কল্যাণ বয়ে এনেছে।তবে হারিয়ে গেছে আমাদের ঐতিহ্য ও ইতিহাস।এখন হারিকেনের জন্য কেবল সেই গানই মানাই “যখন তোমার কেউ ছিলো না, তখন ছিলাম আমি” এখন তোমার সব হয়েছে, পর হয়েছি আমি”।
আগামী প্রজন্মের কাছে হারিকেন বা কুপি বাতি ঘুম পাড়ানিয়া কেচ্ছার মতো হয়ে যাবে।এখন সে পথেই আছে।হারিকেন বিলুপ্তি নয় শুধু সেই সাথে দেশের অর্থনীতিতেও পড়েছে প্রভাব। কেরোসিন তেলের ব্যবহার এখন অনেকটাই কম।
কেরোসিন তেল বিক্রি কমেছে আগের চেয়ে।এ বিক্রির হার একেবারে অর্ধেকে নেমে এসেছে। তবে সময়ের দাবি হচ্ছে আমাদের এসব সোনালী অতিত সংরক্ষণ করা অতিব প্রয়োজন।
নয়তো এককালের অতিত সম্পর্কে আগামী প্রজন্ম অজানাই থেকে যাবে।সরকারি/বেসরকারি উদ্যোগে এ ঐতিহ্যগুলো সংরক্ষণ করা দরকার।
তবে এখনো অনেক জায়গায় হারিকেন ব্যবহার করা হয়। নদীতে নৌকায়, জাহাজের পেছনে সংকেত হিসেবে হারিকেন ব্যবহার করতে দেখা যায়।
হারিকেনের বিলুপ্তির বিষয়ে সমাজকর্মী লিও আরাফাত বলেন বিদ্যুৎের দাপটে হারিকেন হারিয়েছে তার জৌলুস। এখন এটা স্বপ্নের মতো।কবে যে হারিকেন ঘরে দেখেছি সেটাও বলতে পারছিনা।তবে ঘরে না দেখলেও এখনো অনেক রিকশার পিছনে হারিকেন দেখতে পায়।হারিকেন ও কুপি বাতি বিশেষ করে পিতলের তৈরি কুপি সংরক্ষণ করা প্রয়োজন বলে মনে করি আমি।
এ বিষয়ে প্রফেসর কামাল উদ্দিন চৌধুরী কলেজ এর বাংলা বিভাগের প্রভাষক নাজিমুজ্জামান রাশেদ বলেন,হারিকেন ও কুপি গ্রাম বাংলার এক প্রাচীন নিদর্শন।এটি আমাদের গ্রামীণ জীবনের কথা মনে করিয়ে দেয়।এখনো মাঝে মাঝে রিকশা বা নৌকায় হারিকেন দেখে আমরা শৈশবে ফিরে যায়।তখনকার সময়ে হারিকেনের আলোয় পড়াশোনা করে আজ আমরা বড় হয়েছি।কাজেই এটি আমাদের জীবনের সেই সোনালী অতিতেরই অংশ।
সুমন চক্রবর্তী,সম্পাদক ও প্রকাশক
দৈনিক কলম কথা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।