যুগের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মানুষের ব্যস্ততা বেড়েছে বহুগুণ। শহরের যান্ত্রিক জীবন, দৈনন্দিন কাজের চাপ, হাজার রকমের দুশ্চিন্তার ভিড়ে একটু অবসর মেলা ভার। সেই সঙ্গে টিকে থাকার তাগাদায় মানুষকে হতে হচ্ছে মাল্টিটাস্ক। একই সময়ে বিভিন্ন রকম কাজে মনোনিবেশ করতে হচ্ছে তাকে।

ফলে কোনো বিষয়ে নিবিড় মনোযোগ ধরে রাখার স্বভাবজাত ক্ষমতা ধীরে ধীরে হ্রাস পাচ্ছে। গ্লাস থেকে ছলকে ওঠা পানির মতো বিক্ষিপ্ত হয়ে যাচ্ছে আমাদের চিন্তারাশি। এ ক্ষেত্রে সোশ্যাল মিডিয়ার আসক্তিও আমাদের জীবনে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। আমাদের অবসরটুকু গ্রাস করে নিচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম।
এসবের ভয়ংকর প্রভাব এসে পড়ছে আমাদের প্রাত্যহিক ইবাদত নামাজেও। ধীর-স্থির হয়ে খুশু-খুজুর সঙ্গে নামাজ পড়ার স্বাদ থেকে বঞ্চিত হচ্ছি আমরা; নামাজে একাগ্রতা ও মনোযোগ হারাচ্ছি প্রতিনিয়ত। নামাজে দাঁড়ালেই নানা চিন্তা আমাদের মগজে কিলবিল করতে শুরু করে। জগত্সংসারের কোলাহল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নামাজে প্রশান্তি খুঁজে পাওয়ার যে কথা ‘নামাজ’ প্রবন্ধে এয়াকুব আলী চৌধুরী বলেছিলেন, সেই তৃপ্তির জায়গাটুকুও হারিয়ে যাচ্ছে আজ। ২০১৫ সালে মাইক্রোসফট কানাডার এক গবেষণায় দেখা গেছে, আমাদের মনোযোগের গড় সময়ের ব্যাপ্তি মাত্র ১৫ সেকেন্ড, ২০১৮ সালে যা এসে ঠেকেছে মাত্র ৮ সেকেন্ডে; গোল্ডফিশের চেয়েও যা এক সেকেন্ড কম।

পবিত্র কোরআনে নামাজে মনোযোগী হওয়ার নির্দেশ দিয়ে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমরা সালাতের প্রতি যত্নবান হও, বিশেষ করে মধ্যবর্তী সালাতের প্রতি এবং আল্লাহর সামনে বিনীতভাবে দাঁড়াও। ’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ২৩৮)

অন্য আয়াতে বিনয়ী ও মনোযোগী মুসল্লিকে সফল আখ্যায়িত করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘অবশ্যই সফলকাম হয়েছে মুমিনরা, যারা নিজেদের নামাজে বিনয়-নম্র। ’ (সুরা মুমিনুন, আয়াত : ১-২)

নামাজে একাগ্রতা হারানোর অনেক কারণ আছে। ইমাম গাজালি (রহ.) নামাজে মনোযোগ ও একাগ্রতা হারানোর দুই ধরনের কারণ উল্লেখ করেছেন। বাহ্যিক কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন—শব্দদূষণ ও শোরগোল। অন্যদিকে মানসিক কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন—বিক্ষিপ্ত চিন্তা-ভাবনা, দুশ্চিন্তা, মানসিক অস্থিরতা ও উত্তেজনা।

নামাজের প্রাণ হলো খুশু তথা অন্তরের বিনয় ও নম্রতা। নামাজে মনোযোগ ও একাগ্রতা বৃদ্ধি করার বিভিন্ন উপায় ও পদ্ধতির কথা উলামায়ে কেরাম উল্লেখ করেছেন। যেমন—কোরআনের অর্থের দিকে মনোনিবেশ করা। মনে সব সময় এই ধারণা রাখার চেষ্টা করা যে আমি আল্লাহর সামনে দাঁড়ানো, আল্লাহ তাআলা আমাকে দেখছেন। রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘এমনভাবে আল্লাহর ইবাদত করো, যেন তাঁকে তুমি দেখতে পাচ্ছ। আর যদি দেখতে না পাও, তবে (ভাবো) তিনি তোমাকে দেখতে পাচ্ছেন। ’ (বুখারি, হাদিস : ৫০; মুসলিম, হাদিস : ৮)

এসব পদ্ধতির পাশাপাশি, নামাজে একাগ্রতা বাড়ানোর জন্য মনোবিজ্ঞানীদের বাতলে দেওয়া কিছু পদ্ধতিও অবলম্বন করা যেতে পারে। তাঁদের মতে, ইবাদত এমন এক মেডিটেশন, যা আমাদের মস্তিষ্ককে আরো গভীরে নিয়ে আলফা ব্রেইন ওয়েভের সঙ্গে সংযুক্ত করে। আমাদের একাগ্রতাকে আরো নিবিড় ও প্রখর করে তোলে; সৃজনশীলতা বৃদ্ধি করে এবং মানসিক প্রশান্তি আনে।

মনোবিজ্ঞানের আলোকে তিনটি উপায়

এক. নামাজ আদায়ের জন্য নীরব ও কোলাহলমুক্ত পরিবেশ নির্বাচন করা। কারণ শব্দবহুল ও অস্বস্তিকর স্থানে আমাদের অবচেতন মন ও অন্তর্দৃষ্টি রুদ্ধ হয়ে থাকে। তাই মনোবিজ্ঞানীরা ক্লায়েন্টের মনঃসংযোগ বিনষ্টকারী বিষয়গুলো হ্রাস করে থাকেন। কাজেই পুরুষের জন্য মসজিদই হতে পারে নামাজের উপযুক্ত স্থান। নারীদের জন্য ঘরের কোনো একটি স্থান নির্ধারণ করা উচিত, যেখানে বাচ্চাদের শোরগোল ও চেঁচামেচির সম্ভাবনা আপেক্ষিকভাবে কম। নামাজে দাঁড়ানোর আগে এমন কাজ থেকে বিরত থাকা উচিত, যা নামাজে দাঁড়ানোর পরও বিঘ্ন ঘটাতে পারে।

দুই. থেরাপি চলাকালীন সাইকোলজিস্টরা ক্লায়েন্টের চোখ নির্দিষ্ট কোনো বিন্দুতে নিবদ্ধ করতে বলেন। খুব গভীরভাবে ওই বিন্দুতে দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখলে ক্লায়েন্টের দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ শিথিল হয়ে আসে এবং মন ভারমুক্ত ও হালকা অনুভূত হয়, তখন থেরাপিস্ট নিশ্চিত হন যে ক্লায়েন্ট মনের গহিন স্তরে প্রবেশ করছে। বিষয়টি নামাজের সঙ্গেও গভীরভাবে জড়িত। রাসুল (সা.) ধীর-স্থিরে নামাজ আদায় করার নির্দেশ দিয়েছেন। নামাজে তাড়াহুড়া করা যাবে না। প্রতিটি রোকন সযত্নে দীর্ঘ সময় নিয়ে আদায় করতে হবে। দাঁড়ানো অবস্থায় দৃষ্টি সেজদার স্থানে, রুকুর সময়, পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলের নখে নিবদ্ধ রাখলে নামাজে নিমগ্নতা বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা যায়।

তিন. সাইকোলজিস্টরা ক্লায়েন্টের মনঃসংযোগ বৃদ্ধির জন্য আরেকটি উপায় অবলম্ব করেন। তা হলো গভীরভাবে শ্বাস-প্রশ্বাস। কারণ গভীরভাবে শ্বাস-প্রশ্বাসের ফলে মস্তিষ্কে রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি পায়। ফলে ক্লায়েন্টের মানসিক চাপ প্রশমিত হয় এবং তাঁরা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। নামাজের ভেতরে বা আগে-পরে আমরা তা প্রয়োগ করতে পারি।

আল্লাহ আমাদের সৃষ্টি করেছেন তাঁর ইবাদত করার জন্য। জীবন-জগতের ব্যস্ততায় আমরা যদি আল্লাহর ইবাদতে গাফিলতি করি এবং নামাজে তাড়াহুড়া করি, তবে লক্ষ্যচ্যুত হবো এবং আখেরাতে বিফল হবো, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।

অ্যাবাউট ইসলাম ডটকম অবলম্বনে