রাজিবুল ইসলাম রিয়াজঃ সাফ নারী ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপে শিরোপা জিতে সারাদেশের মানুষ এখন আনন্দে ভাসছে। ফাইনালে নেপালের মাটিতে স্বাগতিকদের হারিয়ে বাংলাদেশের মেয়েদের এ সাফল্য খুলে দিয়েছে ফুটবলের নতুন দুয়ার।

তিন গোলের মধ্যে দুটি গোলই করেছেন কৃষ্ণা রানী সরকার। সেই আনন্দ ছুঁয়ে গেছে কৃষ্ণার বাড়িতে। টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলার উত্তর পাথালিয়া গ্রামে। তবে বাড়িতে বিদ্যুৎ না থাকায় তার মা নমিতা রানী সরকার মেয়ের খেলা দেখতে পারেননি। বাবা খেলা দেখেছেন অন্য গ্রামে গিয়ে। আর ভাই পলাশ সারাদিন উপবাস করেছিলেন বোনের ভালো খেলার জন্য।

টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলার নগদা ইউনিয়নের উত্তর পাথালিয়া গ্রামের শ্রী বাসুদেব ও শ্রীমতি নমিতা রানীর মেয়ে কৃষ্ণা রাণী সরকার।

নমিতা রানী এবং বাসুদেব ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দতে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। বিয়ের পর কিছু বুঝে উঠতে না উঠতেই নমিতা রানী সন্তান সম্ভবা হয়ে পড়েন। বাবার আর্থিক অনটনের কারণে বুকের ভেতরে লালিত সব স্বপ্নগুলো মিথ্যে হয়ে যায় নমিতা রানীর। এদিকে বাসুদেবসহ তার পাঁচ ভাই, দুই বোন এবং বাবা-মা নিয়ে ১০ জনের এক পরিবারের মাঝে গিয়ে পড়েন তিনি। স্বামীর অসচ্ছল সংসার। পুষ্টিহীনতার কারণে প্রচণ্ড অসুস্থ হয়ে পড়েন নমিতা রানী। তবুও তার দু’চোখ ভরা স্বপ্ন। সবসময় ভাবতেন নিজের অপূর্ণ ইচ্ছেগুলো পূর্ণতা পাবে তার সন্তানদের মাধ্যমে। স্বামী বাসুদেব এবং তার ভাইদের যৌথ প্রচেষ্টায় কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠলেন নমিতা।

ঘনিয়ে এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ! গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি, হালকা কুয়াশা, মেঘাচ্ছন্ন চারদিক। প্রচণ্ড শীতের এক সংকটময় মুহুর্তে ঘরের পেছনে বাঁশঝাড়ের ভিতর জন্ম নিল “কৃষ্ণা”। জন্মের পর কয়েক ঘন্টা অচেতন রইলেন তার মা। মেয়েকে বুকে আগলে নেয়ার ক্ষমতাটুকু ছিল না তার। দীর্ঘ একমাস নমিতা রানীর মা কৃষ্ণাকে দেখাশোনা করেন। বাবার অভাবের সংসারে দিন দিন বেড়ে উঠতে লাগল “কৃষ্ণা”।

সাধারণত ছোটকাল থেকেই মেয়ে শিশুরা পুতুল, হাঁড়ি-পাতিল, কুলা এসব নিয়ে খেলা করে থাকে। কিন্তু কৃষ্ণা ব্যস্ত থাকতো ভাইদের সাথে সারাদিন সাইকেল, ডাংগুলি আর ফুটবল নিয়ে। অজ পাড়াগাঁয়ে তাদের বাড়ি। সে যখন একটু বড় হয়ে উঠল, গ্রামের লোকেরা তখন মেয়ের এসব কাণ্ড দেখে নানা ধরণের কথা বলতে লাগল। কৃষ্ণার মা নীরবে হজম করতেন সে সব কথা। মেয়ের ইচ্ছেকে প্রাধান্য দিয়ে তাকে উৎসাহ যোগাতেন তিনি। কিন্তু স্বপ্নেও ভাবেননি মেয়ে তার এতদূর যাবে।

কৃষ্ণা আজ স্থানীয়, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নেতৃত্ব দিচ্ছে। কিন্তু এই অবস্থানে আসতে কত কাঠখড় তাকে পোড়াতে হয়েছে সে হিসেব পর্দার আড়ালেই রয়ে গেছে। সে যখন নিজ গ্রামে খেলতো তখন প্রতিবেশীরা বাড়ির উপরে এসে অকথ্য ভাষায় বকাঝকা করে যেতো। তারা ভাবতো কৃষ্ণার সাথে মিশলে অন্য মেয়েরা নষ্ট হয়ে যাবে।

কৃষ্ণার মা যখন সফল জননী হিসেবে উপজেলায় শ্রেষ্ঠ পদক পাওয়ার পর জেলায় যাচ্ছিলেন তখন তিনি জানান, কৃষ্ণার সাথে ঘটে যাওয়া সবচেয়ে আনন্দ দায়ক এবং বেদনা দায়ক ঘটনাটি কী? কথা বলতে বলতেই মূহুর্তেই তার চোখ থেকে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়তে লাগল। তিনি কান্না বিজড়িত কণ্ঠে বলতে লাগলেন, একদিন প্রতিবেশীরা প্রচণ্ড বকেছিল অকথ্য ভাষায়।

তিনি সেদিন কিছুতেই সহ্য করতে পারছিলেন না। তিনি রাগে, ক্ষোভে দৌঁড়ে গিয়ে বটি নিয়ে বসে এরপর কৃষ্ণার বলটাকে কুটিকুটি করে কেটে ফেলেন। কাটার পর যখন কৃষ্ণা কান্না দেখেন তখন মনে হলো তিনি তার হৃৎপিণ্ড কেটে কুটিকুটি করেছেন। ততক্ষণে মেয়ের চোখ থেকে এক নদী অশ্রু গড়িয়েছে। মা-মেয়ে জড়াজড়ি করে প্রচণ্ড কাঁন্নাও করেন সেদিন। চোখের পানি মুছে কাল-বিলম্ব না করে সেদিনই তাকে বল কিনে এনেদেন তিনি। বল হাতে পেয়ে মেয়ে কী যে খুশি হলো তা ভাষায় অবর্ণনীয়।

এই ঘটনার কিছুদিন পর শুরু হলো বঙ্গমাতা ফুটবল টুর্নামেন্ট। কৃষ্ণা খেলতে যান গোপালপুর উপজেলার উত্তর পাথালিয়া প্রাইমারি স্কুলের ছাত্রী হিসেবে সূতী ভি এম সরকারি মডেল পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে।

কৃষ্ণাকে বের করে নিয়ে আসে উক্ত বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক জনাব সাইম আল মামুন। সূতী ভি এম উচ্চ বিদ্যালয়ের ক্রীড়া শিক্ষক গোলাম রায়হান বাপন’র চোখে কৃষ্ণার ফুটবল নৈপুণ্যতা ধরা পড়ে। ততক্ষণে সারা গোপালপুরে কৃষ্ণা কৃষ্ণা রব উঠে গেছে। ঠিক তখনি অত্র বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুল লতিফ কৃষ্ণার বাড়িতে যান। তারপর পরিবারের সাথে কথা বলে কৃষ্ণাকে সূতি ভি এম স্কুলে ভর্তি এবং খেলাধুলার অনুশীলনের দায়িত্ব নেন।

আব্দুল লতিফ’র সহযোগিতায় শুরু হলো কৃষ্ণার জীবনের নতুন অধ্যায়। দিনগুলো একদিকে যেমন ছিল আনন্দঘন, অন্য দিকে তেমন চরম সংকটাপন্ন। কৃষ্ণার বাড়ি থেকে বিদ্যালয়ের দূরত্ব প্রায় ৯ কিলোমিটার। ভোর ৫টা ৩০ মিনিটে উঠে খেয়ে, না খেয়ে কৃষ্ণাকে যেতে হতো অনুশীলনের মাঠে।

আব্দুল লতিফ স্যার সকাল বিকাল তাদের অনুশীলন উপভোগ করতেন। তাদের ওয়ার্ম-আপের বিভিন্ন স্টাইলগুলো খুব আকর্ষণীয় ছিলো। নৃত্যের তালে তালে ছেলেদের পাশাপাশি বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গিতে তারা যখন পুরো মাঠটা অতিক্রম করতো তিনি তখন অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতেন। বয়কাট চুল, টিশার্ট, ট্রাউজার পরে ওরা ক’জন অনুশীলন করতো। এখানেও কটুক্তির অভাব ছিলো না। হ্যাঁ, আমার মতো দু’চারজন তো তাদেরকে স্যালুট জানাতোই বটে,অশ্রুসিক্ত চোখে এমনটাই জানান অবসরপ্রাপ্ত সূতি ভি এম স্কুলের প্রধান শিক্ষক আব্দুল।

আব্দুল লতিফ আরও বলেন, নিয়মিত চলছে বন্ধু-বান্ধবীদের সাথে কৃষ্ণার অনুশীলন, শত আনন্দের মাঝেও দূরত্বটা ছিল কষ্টের। এমনিতেই অসচ্ছল তার উপর যোগ হলো ভ্যান, রিক্সা ভাড়া। পরিবারের উপর আরও বাড়তি একটা চাপ। তবুও বাবা-কাকাদের আন্তরিকতার অভাব ছিলোনা। তারা কৃষ্ণাকে এগিয়ে দিয়ে যেতেন, নিয়ে যেতেন। প্রথম দিকে খেলার সরঞ্জাম, ড্রেস সরবরাহ করতেন শিক্ষক গোলাম রায়হান বাপন। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য, সেই সময়ে কৃষ্ণার প্রতি জোরালো স্নেহদৃষ্টি রাখেন এবং বিভিন্ন পরিস্থিতিতে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ইউনুস ইসলাম তালুকদার (ঠাণ্ডু), জেলা প্রাশাসক মহোদয় ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মহোদয়। পরবর্তীতে উপজেলা প্রশাসন থেকে একটি বাইসাইকেল দেয়া হয় কৃষ্ণাকে। সেই থেকেই অনায়াসে ছুটতে থাকে কৃষ্ণা। সেদিন যারা কৃষ্ণাকে তিরস্কার করতো আজ তারা কৃষ্ণার সাফল্যে উল্লসিত! আজ তারা কৃষ্ণার খবর খুঁজে বেড়ায়! এটাই কৃষ্ণার জীবনের পরম প্রাপ্য বলেই জানান আব্দুল লতিফ।

আব্দুল লতিফ আবেগে আপ্লূত হয়ে বলেন, আমরা গর্বিত ওদের মতো সন্তান পেয়ে, আমরা শিক্ষকরা গর্বিত কৃষ্ণার মতো সন্তান পেয়ে। কৃষ্ণা শুধু আমাদের নন, কৃষ্ণা আজ সারা বাংলার সম্মান।আমরা আরও স্যালুট জানাই মারিয়া, মনিকা, শামছুন্নাহার,রুপনা, আঁখি, মাসুরা, শিউলি, সানজিদা, সিরাত, সাবিনাসহ দলের সবাইকে।
বারবার বয়ে নিয়ে আসো এমন অনাবিল আনন্দ বাংলা মা’য়ের বুকে এমনটাই প্রত্যাশা তার।