পৃথিবীর সর্বকালের সেরা ধনী মুসলিম শাসক মানসা মুসা। মানসা মুসার সম্পদের পরিমাণ এতো বেশি যে পৃথিবীর কোনো ধনী ব্যক্তি আজ পর্যন্ত তার সম্পদের প্রাচুর্য্য স্পর্শ করতে পারেনি। ইতিহাসবিদদের মতে, মুসার সম্পদের পরিমাণ কোনো সংখ্যা দিয়ে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। পশ্চিম আফ্রিকার দেশ মালির সুলতান মুসা। ২০১২ সালের এক জরিপে বিশ্বের সর্বকালের সেরা ধনীদের তালিকা প্রকাশ করা হয়। মূল্যস্ফীতির হিসেবে মুসার সম্পত্তিকে মুদ্রা রুপান্তর করলে সেটা পরিমাণ হবে প্রায় ১০০ বা ২০০ নয় পুরো ৪০০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি।

যেখানে পোপসের জরিপ অনুযায়ী, আধুনিক ইতিহাসের সবচেয়ে সেরা ধনী আমাজনের প্রতিষ্ঠাতা জেফ বেজোস। যার সম্পদের পরিমাণ মাত্র ২০ হাজার কোটি বা ২০০ বিলিয়ন ডলার। আধুনিক ধনকুবদের ইতিহাসে তার মতো এতো বেশি সম্পদ কেউ অর্জন করতে পারেনি। মানসা মুসা যদি বেঁচে থাকতেন তবে তিনি বিশ্বের ধনী ব্যক্তিদের তালিকায় প্রথম স্থান অর্জন করতেন। এই ধনকুবের কাছে এতো বেশি পরিমাণ স্বর্ণ ছিলো যে তিনি তার রাজ্য থেকে ১০ কিলোমিটার একটি পথ স্বর্ণ দিয়ে ঢেকে দিতে পারতেন। তার সম্পদ নিয়ে অনুমান করা হয় যে ভারতের ধনকুব মুকেশ আম্বানির সম্পদের চেয়ে বেশি অর্থ একদিনই দান করতেন।

প্রশ্ন হতে পারে, কিভাবে এতো সম্পদের মালিক হন মুসা। ১৪ শতকের পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী তিনটি অঞ্চলের একটি অঞ্চল ছিল পশ্চিম আফ্রিকার মালি সাম্রাজ্য। কারণ মালি সাম্রাজ্য তখন প্রকৃতিক সম্পদে পরিপূর্ণ ছিল। প্রকৃত অর্থে সোনা ফলতো বালির মাটিতে। মুসার অধিকাংশ সম্পদের উৎস সোনা ও লবণ। ব্রিটিশ মিউজিয়ামের তথ্য মতে, মুসার শাসন আমলে প্রাচীন বিশ্বের সোনার প্রায় অর্ধেক মালি সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল। শুধু সোনা উত্তলনই নয় পাশাপাশি পুরো দুনিয়ার অর্ধেক লবণ হতো মুসার সম্রাজের অধীনে। এসবের মালিক ছিলেন রাজা স্বয়ং। বিশাল স্বর্ণ ও লবণের বাণিজ্যের বরাতে বিপুল সম্পদের মালিক হয়ে উঠে মুসা।

মুসার জন্ম ১২৮০ খ্রিষ্টাব্দে। বড় ভাই আবু বকরের পর মুসা মালির রাজা হন ১৩১২ খ্রিষ্টাব্দে। তার শাসন আমলে মালি সম্রাজ্যে আকার ব্যপক বৃদ্ধি পায়। তিনি তার রাজত্বে আরও ২৪টি শহর যুক্ত করেন। একটি ছিল টিম্বাক্টু। তার রাজত্ব বিস্তৃত ছিল ২০০ মেইল জুড়ে। আটলান্টিক মহাসাগর থেকে শুরু করে বর্তমান নাইজার, সেনেগাল, মৌরিতানিয়া, মালি, বুর্কিনা ফাসো, গাম্বিয়া, গিনি-বিসাউ, গিনি এবং আইভোরি কোস্টের বড় অংশ ছিল তার রাজত্বে। মানসা মুসার বিলাসিতা ও তার রাজত্ব সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয় যখন সে হজ্ব করতে যায়। মালির এই শাসক মনে করতেন, ইসলাম প্রবেশ মানেই হচ্ছে একটি সভ্য সাংস্কৃতিক দুনিয়ায় পদার্পণ। নিজের সাম্রাজ্যের মধ্যে ধর্ম প্রসারে কাজে বেশিরভাগ সময় ব্যস্ত থাকতেন তিনি। ১৩২৪ থেকে ১৩২৫ সালের মধ্যে হজ্ব করতে গিয়েছিলেন মুসা। ওই সময় তার সঙ্গে ছিল ৬০ হাজার মানুষ। এদের মধ্যে ১২ হাজার ছিল সেবক। যাদের প্রত্যেকের সঙ্গে ছিল একটি করে সোনার বার। তাছাড়াও ৮০ থেকে ১০০টি উট ছিল বহরে। প্রত্যকটি প্রায় ১৪০ কেজি করে সোনা বহন করছিল। যাত্রা পথে কয়েকশো কোটি টাকা মূল্যের সোনা বিতরণ করেন তিনি।

বলা হয়ে থাকে, হজ্বে মুসা আজকের দিনে প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার পাউন্ড ওজনের সোনা ব্যয় করে ছিলেন। যে কারণে এর পরের কয়েক বছর কায়রো, মক্কা এবং মদিনায় সোনার দাম একেবারেই নেমে গিয়েছিল। এতে অবশ্য শহরগুলোর অর্থনীতিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। বেড়ে গিয়েছিল মুদ্রাস্ফীতি। তিনি সোনা নিয়ে গিয়ে ছিলেন হজ্ব পলনের উদ্দেশ্যে ফেরত আসেন জ্ঞান নিয়ে। মক্কা থেকে বেশ কয়েকজন ইসলামিক চিন্তাবিদকে সাথে নিয়ে আসেন মানসা মুসা। যাদের মধ্যে ছিলেন নবী হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) -এর সরাসরি বংশধর এবং কবি ও স্থপিত আবু এস হক এস সাহিনি। যাকে কিনা বিখ্যাত জিজ্ঞারাবার মসজিদের নকশাকার হিসিবে ধারণা করা হয়।

কথিত আছে, মানসা মুসা সেই কবিকে পারিশ্রমিক হিসেবে ২০০ কেজি স্বর্ণ দিয়ে ছিলেন। তিনি প্রতি শুক্রবার একটি করে মসজিদ নির্মাণ করতেন। ধনী সেই রাজাকে পশ্চিম আফ্রিকায় শিক্ষা অরসারের অগ্রদূত হিসেবেও বিবেচনা করা হয়। যদিও সেই সাম্রাজ্যের বাইরে তার সে গল্প খুব কম মনুষেই জানতে পেরে ছিলেন। ১৩৩৭ সালে ৫৭ বছর বয়সে মানসা মুসার মৃত্যুর পর তার ছেলেরা আর সাম্রাজ্য ধরে রাখতে পারেনি। ছোট রাজ্য গুলো একে একে বিদ্রোহ করে। এক সময় পরো সাম্রাজু ধসে পড়ে।

ইতিহাসে সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি মানসা মুসা। তার সোনার সাম্রাজ্য তার মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাতে পারেনি। মানসা মুসার সমৃদ্ধ মালি সম্রাজ্য বর্তমানে আফ্রিকার দরিদ্রতম দেশে পরিণত হয়েছে।