দ্বৈত নাগরিকত্ব নেওয়া সামরিক-বেসামরিক সরকারি কর্মকর্তা, বিচারপতি এবং জনপ্রতিনিধিদের তালিকা চেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগ, ব্যাংক, বিমা, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, শিল্পপ্রতিষ্ঠানসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান প্রধানদের কাছে এ তালিকা চাওয়া হয়েছে।
আগামী ২০ ফেব্রুয়ারির মধ্যে দুদকের কাছে সংশ্লিষ্টদের (দ্বৈত নাগরিক) নাম, পাসপোর্ট নম্বর ও পদবিসহ যাবতীয় তথ্য পাঠাতে অনুরোধ করা হয়েছে।
দুদকের চিঠিতে আরও বলা হয়, দুর্নীতিবিরোধী কার্যক্রম জোরদার হওয়ায় গ্রেফতার এড়াতে দ্বৈত নাগরিকত্ব নেওয়া কর্মকর্তা, কর্মচারী, রাজনীতিবিদরা বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিয়েছে। তাদের সঠিক পরিসংখ্যান সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ এবং দপ্তর সংস্থায় রয়েছে।
দ্বৈত নাগরিকদের বিষয়ে অনুসন্ধানের অংশ হিসাবে দুদক থেকে এই চিঠি ইস্যু করে আগামী ১৫ দিনের মধ্যে তাদের বিষয়ে প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করতে চায় সংস্থাটি। প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে পরবর্তী আইনানুগ প্রক্রিয়া শুরু করা হবে। খবর দায়িত্বশীল সূত্রের।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এপিডি অনুবিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, তারা দুদকের চিঠি পেয়েছেন। কিন্তু এ সংক্রান্ত তথ্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কাছে না থাকলেও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কিংবা ইমিগ্রেশন অথোরিটির কাছে থাকতে পারে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারাও দুদকের চিঠি পেয়েছেন। এ বিষয়ে পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে এর বেশি কিছু বলতে চাননি তারা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংশ্লিষ্ট একজন পদস্থ কর্মকর্তা বলেন, তালিকা প্রস্তুত হচ্ছে। এ তালিকা অনেক বড়। হাজার হাজার কর্মকর্তা, বিচারপতি, সাবেক সংসদ-সদস্য, মেয়র, উপজেলা চেয়ারম্যান, সামরিক বাহিনীর অফিসার, ব্যাংক কর্মকর্তা ও শিল্পপতির নাম রয়েছে এই তালিকায়।
এ বিষয়ে জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ ফিরোজ মিয়া বলেন, তথ্য গোপন করে বিদেশি রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব গ্রহণ করলে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর চাকরি থাকার কথা নয়। তাদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। এমনকি যারা পারমানেন্ট রেসিডেন্ট (পিআর) ও গ্রিনকার্ড নিয়েছেন তাদেরও শাস্তির আওতায় আনতে হবে। এটা সরকারের একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ বলে মনে করছেন সাবেক এই কর্মকর্তা।
জানা গেছে, সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সিনিয়র সচিব, সচিব ও সংশ্লিষ্ট সংস্থা প্রধানদের কাছে দুদক দ্বৈত নাগরিকত্ব নেওয়া কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তালিকা চাওয়া হয় গত ৬ জানুয়ারি। কিন্তু তালিকা দিতে গড়িমসি করায় ২৯ জানুয়ারি তালিকা চেয়ে ফের তাগিদপত্র দিয়েছে সংস্থাটি। এতে বলা হয়, সম্প্রতি লক্ষ করা গেছে, কিছু সরকারি কর্মচারী তথ্য গোপন করে বিভিন্ন দেশের পাসপোর্ট গ্রহণ ও ব্যবহার করছেন। চলমান দুর্নীতিবিরোধী অভিযান ও শাস্তি এড়াতে তারা বিভিন্ন দেশে অবস্থান করছে।
সন্দেহভাজন এসব ব্যক্তি নিজেদের রক্ষা এবং অপকর্ম ঢাকার চেষ্টা করছে। তারা বিভিন্ন দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছে। যা সরকারি চাকরি আইন ২০১৮-এর ৪০ ধারার সম্পূর্ণ পরিপন্থি। ওই ধারায় বিদেশি নাগরিকত্ব গ্রহণের প্রমাণ মিললে চাকরিচ্যুত করার বিধান রয়েছে।
দুদকের চিঠিতে আরও বলা হয়, সংস্থাটির অনুসন্ধানে প্রমাণ মিলেছে তারা দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অবৈধ সম্পদ গোপনে বিদেশে পাচার করে ভোগ করার চেষ্টা করছে। সরকারি পদে থেকে তারা দুর্নীতি বৃদ্ধিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে। ফলে দেশের অর্থনীতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
একই সঙ্গে তারা বিদেশি রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব গ্রহণ করার মধ্য দিয়ে দেশ ও দেশের জনগণের প্রতি দায়-দায়িত্ব পালনে অনাগ্রহ প্রকাশ করেছেন, যা কোনোক্রমেই বাঞ্ছনীয়।
দুর্নীতি দমন কমিশনের পত্রে আরও বলা হয়, ‘দণ্ডবিধির ২১ ধারা, ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি দমন আইনের (২) ধারা, ব্যাংক কোম্পানি আইন ১৯৯১-এর ১১০ ধারা এবং সংশ্লিষ্ট সব আইন অনুযায়ী প্রতিরক্ষা বিভাগের কমিশন্ড অফিসার, বিচারক, আদালতের কর্মচারী, রাজস্ব খাত থেকে বেতনভোগী সব কর্মচারী, স্বায়ত্তশাসিত, স্বশাসিত, আধা-সরকারি, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোম্পানির কর্মকর্তা-কর্মচারী বিভিন্ন পর্যায়ে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা পাবলিক সার্ভেন্ট। তাদের এবং তাদের পোষ্যদের দ্বৈত নাগরিকত্ব গ্রহণের বিষয়টি যাচাই করা অতীব জরুরি।’
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টরা জানান, বিগত স্বৈরাচার সরকারের আমলে লুটেরা রাজনীতিবিদদের সঙ্গে আঁতাত করে বহু কর্মকর্তা বিপুল পরিমাণ বিত্তবৈভবের মালিক হয়েছেন। তারা দেশে এবং বিদেশে অবৈধভাবে স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ গড়েছেন। যা ক্রয় বা অর্জনের সময় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কোনো পূর্বানুমতি গ্রহণ করেনি। সেই সময়ের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারাও দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কোনো আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। বরং নানাভাবে তাদের সুরক্ষা দিয়েছে।
ক্ষমতাসীনরা কর্মকর্তাদের ব্যবহার করেছে দলীয় কর্মীর মতো। রাজনীতিবিদ এবং আমলারা মিলেমিশে রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুণ্ঠন করেছেন। আওয়ামী স্বৈরাচার সরকারের কারসাজির কারণে সাড়ে ১৫ বছর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্পদ বিবরণী জমা দিতে হয়নি। বর্তমান সরকার সম্পদ বিবরণী দাখিলে কঠোর নিয়ম করায় তারা অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছে। তারা এখন আত্মগোপন ও অর্জিত সম্পদ লুকানোর চেষ্টা করছে।
সংশ্লিষ্টরা আরও জানান, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সম্পদ বিবরণী দাখিলের নির্দেশ দিলেও কোটিপতি আমলাদের সম্পদ বিবরণী যাচাই-বাছাইয়ের কোনো পদ্ধতি বা নীতিমালা তৈরি করেনি। ফলে বিষয়টি নিয়ে এক রকম ধোঁয়াশা রয়েই গেছে। তবে সম্পদ বিবরণী দাখিলের কঠোর নিয়ম করায় সবাইকে তা দাখিল করতে হচ্ছে বলে জানা গেছে।
সূত্র: যুগান্তর
দৈনিক কলম কথা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।