মানুষের শরীরে শূকরের হৃদপিণ্ড প্রতিস্থাপনের ঘটনা ধর্মপ্রাণ মুসলিম হিসেবে ডা. মহিউদ্দিনের জন্য মোটেও সহজে মেনে নেয়ার বিষয় ছিল না। ইসলামে শূকরের মাংস খাওয়াই শুধু নয়, এর সঙ্গে কোনো ধরনের সংশ্লিষ্টতাও হারাম।
পাকিস্তানে সাগরতটের শহর করাচিতে ডা. মুহাম্মদ মহিউদ্দিন যখন বেড়ে উঠছিলেন তখন ‘শূকর’ শব্দটি ঘিরে ছিল ধর্মীয় বিধিনিষেধ, বিশেষ করে নিজ বাড়িতে।
কখনও ভুল করে শব্দটি মুখে চলে এলে শাস্তির মুখোমুখি হওয়া ছিল অবধারিত। সেসব দিনের স্মৃতিচারণ করে ডা. মহিউদ্দিন বলেন, ‘এমন হলে আমার মা আমাকে কুলকুচিও করাতেন।’
তিনি জানান, তাদের বাড়িতে শূকর ছিল নিষিদ্ধ এক প্রাণী। তিনি প্রায়ই বাবা এবং ভাইদের সঙ্গে সিন্ধু প্রদেশের গ্রামাঞ্চলে বুনো শূকর হত্যায় অংশ নিয়েছেন।
কয়েক দশকের ব্যবধানে এই মহিউদ্দিনই মানুষের শরীরে শূকরের হৃদপিণ্ড স্থাপনের পথপ্রদর্শক হিসেবে পরিচিতি পাচ্ছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অফ ম্যারিল্যান্ডের মেডিক্যাল সেন্টারে চলতি বছরের প্রথম সপ্তাহে যুগান্তকারী এই অস্ত্রোপচার হয়। মানুষের দেহে সম্পূর্ণ আলাদা প্রাণীর অঙ্গ প্রতিস্থাপন প্রক্রিয়াটির পরিচালক ছিলেন মহিউদ্দিন।
আর যেখানে অস্ত্রোপচারটি হয়েছে সেই মেডিক্যাল সেন্টারের হৃদপিণ্ড প্রতিস্থাপন প্রোগ্রামের পরিচালক ছিলেন বার্টলে পি গ্রিফিত।
ইউনিভার্সিটি অফ ম্যারিল্যান্ডের মেডিক্যাল সেন্টারে সম্প্রতি মানবদেহে শূকরের হৃদপিণ্ড প্রতিস্থাপনের অস্ত্রোপচার হয়
মহিউদ্দিন আর গ্রিফিতের নেতৃত্বে চলা অস্ত্রোপচারটিতে জিনগত পরিবর্তন ঘটানো শূকরের হৃদপিণ্ড সরবরাহ করেছে সুইডিশ বায়োটেক কোম্পানি রিভিভিকর। শূকরের এই হৃদপিণ্ডটি ডেভিড বেনেট নামে ৫৭ বছর বয়সী এক ব্যক্তির শরীরে প্রতিস্থাপন করা হয়। বর্তমানে তিনি সুস্থ হয়ে উঠছেন।
মহিউদ্দিন বলেন, ‘অঙ্গসংকটের কারণে শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই প্রতি বছর প্রায় দেড় লাখ মানুষের মৃত্যু ঘটছে। এবার হিসাব করে দেখুন বাকি দুনিয়ায় অঙ্গ সংকটের কারণে আরও কত কত মানুষ মারা যাচ্ছেন।’
তিনি দাবি করেন, এ ধরনের কৌশল সফল হলে অঙ্গ সংকটে থাকা পৃথিবীর প্রায় সব মানুষের জীবন বাঁচানো সম্ভব হবে।
মানুষের জীবন বাঁচানোর এই যাত্রাটি মহিউদ্দিন শুরু করেন পাকিস্তানের ডো মেডিক্যাল কলেজে স্নাতক হওয়ার পর থেকেই। বক্ষ ও হৃদপিণ্ড বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে ১৯৯২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে পা রাখেন তিনি। পরে ইউনিভার্সিটি অফ পেনসিলভ্যানিয়ায় একটি ফেলোশিপ প্রোগ্রামে যুক্ত হন। সেখানেই একজন তাকে অঙ্গ প্রতিস্থাপন গবেষণায় মনোযোগী হওয়ার পরামর্শ দেন।
সেই পরামর্শক বলেছিলেন, চিকিৎসক হিসেবে সারা জীবনে তুমি যে পরিমাণ মানুষকে সহযোগিতা করবে, অঙ্গ প্রতিস্থাপনবিদ্যায় সফল হলে তার চেয়ে আরও অনেক বেশি মানুষকে সাহায্য করার সুযোগ পাবে।
এরপর যা ঘটলো, তা এক ইতিহাস। মহিউদ্দিন শিগগিরই এক প্রাণীর অঙ্গ অন্য প্রাণীতে প্রতিস্থাপনে পারদর্শী হয়ে ওঠেন।
তবে বিষয়টি নিয়ে প্রচুর দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগেছেন তিনি। কেবলই মনে হতো এই বিষয়টিকে কোনোভাবেই মানুষের চিকিৎসায় হাসপাতাল পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না।
শূকরের হৃদপিণ্ড প্রতিস্থাপনের পর ডেভিড বেনেটের সঙ্গে ডা. মুহাম্মদ মহিউদ্দিন
সে যা-ই হোক, অবশেষে কোনো প্রাণীর হৃদপিণ্ড মানুষের শরীরে প্রতিস্থাপন সম্ভব হয়েছে। আর অস্ত্রোপচারের ১৬ দিন পরেও শূকরের হৃদপিণ্ড নিয়ে দিব্যি সুস্থ আছেন বেনেট। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, তার শরীর ওই হৃদপিণ্ডটিকে সাদরে গ্রহণ করেছে।
তবে মানুষের শরীরে শূকরের হৃদপিণ্ড প্রতিস্থাপনের ঘটনা ধর্মপ্রাণ মুসলিম হিসেবে ডা. মহিউদ্দিনের জন্য মোটেও সহজে মেনে নেয়ার বিষয় ছিল না। ইসলামে শূকরের মাংস খাওয়াই শুধু নয়, এর সঙ্গে কোনো ধরনের সংশ্লিষ্টতাও হারাম।
সবচেয়ে বড় ব্যাপার, মহিউদ্দিন নিজের পরিবার থেকেই নারা ধরনের বাধা-বিপত্তির মুখে পড়েছেন। তার বাবা প্রায়ই প্রশ্ন করতেন, ‘এই প্রাণীটাকে কেন তুমি ব্যবহার করছো? অন্য কোনো প্রাণী দিয়ে এটা করার চেষ্টা কেন করছো না?’
মহিউদ্দিন অবশ্য বাবার পরামর্শ মেনে অন্য প্রাণী দিয়ে এটা করা যায় কি-না সে চেষ্টা করেছিলেন। তবে এ ক্ষেত্রে শূকরের জিনগত বৈশিষ্ট্যগুলোই আদর্শ প্রমাণিত হয়।
তিনি জানান, শূকরের জিনগুলোকে এমনভাবে পরিবর্তন করা গেছে, যা অনেকটা মানুষের জিনের কাছাকাছি পর্যায়ে ছিল। ফলে শূকরের হৃদপিণ্ড কোনো মানুষের শরীরে প্রতিস্থাপন করার পর নিয়মমাফিক কিছু ওষুধ সেবন করে ওই অঙ্গটির কার্যক্ষমতা বজায় রাখা সম্ভব। জিনগত এই পরিবর্তন ঘটানো না গেলে অঙ্গটিকে শিগগিরই প্রত্যাখ্যান করতো মানুষের শরীর।
ইসলামে শূকর নিয়ে নানা বিধিনিষেধ থাকলেও মুসলিম বিশ্বের বাইরে এ নিয়ে তেমন কোনো সমস্যা নেই। মহিউদ্দিন আমেরিকায় অবস্থান করায় শূকর নিয়ে তার গবেষণাটি বেশ সহজ হয়।
তবে পরিবারের উদ্বেগ আর নিজের ধর্মীয় বিশ্বাস মহিউদ্দিনের মনে শূকরের ব্যবহার নিয়ে অসংখ্যবার প্রশ্ন তুলেছে। তিনি বলেন, ‘আমি ইসলামের সব নীতি মেনে চলার চেষ্টা করি। তাই এ বিষয়ে আমার মনে সব সময়েই উদ্বেগ ছিল। আমি প্রায়ই শূকর নিয়ে গবেষণাটি চালিয়ে যেতে যুক্তি খোঁজার চেষ্টা করতাম।’
সন্দেহ দূর করার জন্য তিনি বিশ্বের বেশ কয়েক জন বড় ধর্মীয় পণ্ডিতের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে পরামর্শ করেন। সব শেষে যে সারমর্মটি দাঁড়ায় তা হলো, ‘আল্লাহর কাছে একজন মানুষের জীবন বাঁচানোর চেয়ে বড় কিছু নেই।’
দৈনিক কলম কথা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।