গাড়ির শব্দ পেলেই বুক কেপে উঠে এলাকার নারীদের। আতঙ্ক ও ভয়ে দিন কাটছে বলে জানান ঠাকুরগাঁও জেলার রাণীশংকৈল উপজেলার বাচোঁর ইউনিয়নের ভাংবাড়ি মহেশপুর গ্রামের নারীরা।
প্রায় পাঁচ বছর আগে নদী ভাঙনে বাড়ি-ঘর জমি জায়গা সব বিলীন হয়ে যায় সবুরা খাতুন (৫০)। নদী ভাঙ্গনে নিঃশ্ব হয়ে বগুড়া থেকে স্বামী সন্তান নিয়ে চলে আসেন রাণীশংকৈলের মহেশপুরে।
পাঁচ সদস্যদের পরিবারের একমাত্র উপার্যনক্ষম ব্যক্তি স্বামী বেল্লাল হোসেন। দিনমুজুরি আয়ে সংসার চলে তাদের। কিন্তু গেল ২৭ জুলাই ইউপি নির্বাচনী সহিংসতায় ভাংবাড়ি ভিএফ নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ভোট কেন্দ্রে পুলিশের গুলিতে সুরাইয়া আক্তার নামে সাত মাস বয়সী শিশু নিহত হয়। এ ঘটনায় অজ্ঞতনামা আটশ জনের নামে মামলা হওয়ায় স্বামী ও সন্তান গ্রেপ্তার আতঙ্ককে ঘর ছাড়া।
বর্তমানে বাড়িতে পুরুষ মানুষ না থাকায় বৃদ্ধা সবুরার দিন কাটছে আতঙ্কে। সবুরা খাতুনের অভিযোগ, এখানকার ভোটার না হয়েও আমার স্বামী-সন্তান গ্রেপ্তারের ভয়ে পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে। বাড়িতে খাওয়ার মতো চাল ডাল কিছুই নেই।
অন্যদিকে সবুরা খাতুনের মতো নদী ভাঙনে নিঃশ্ব হয়ে কয়েক বছর আগে হাতিবান্ধা থেকে স্বামী-সন্তান নিয়ে মহেশপুর গ্রামে বসবাস শুরু করেন সখিনা আক্তার। ভ্যানগাড়ি চালিয়ে তার স্বামী যা আয় রোজগার করেন তা দিয়েই চলতো সংসার।
সখিনা আক্তার কান্না জড়িত কন্ঠে বলেন, নির্বাচনী সহিংসতায় বর্তমানে পরিবারের একমাত্র উপার্যনক্ষম ব্যক্তি গ্রেপ্তারের আতঙ্কে পালিয়ে থাকায় অনাহারে থাকতে হচ্ছে সখিনা আক্তারকে। মারামারি করলো ভোটে অংশ নেয়া ব্যক্তিরা আর শাস্তি ভোগ করতে হচ্ছে আমাদের মতো দিনমুজুর গরিবদের। একদিন ভ্যাগ না চালালে যেখানে চুলা জ্বলেনা। সেখানে স্বামী পালিয়ে বেড়াচ্ছে। তাহলে কতটা ভালো আছি বলার অপেক্ষা নেই।
সখিনা আক্তারের পাশে বসে থাকা পঞ্চান্ন বছর বয়সী নারী রুবিনা বেগম অঝরে কান্না করছিলেন। স্বামী দিনমুজুর সিরাজুল ইসলাম ও ছেলেরা আজ কয়েকদিন থেকে বাড়িতে থাকতে পাচ্ছেন না যদি পুলিশ এসে ধরে নিয়ে যায় এই ভয়ে। কান্না যেন থামছেইনা রুবিনা বেগমের।
তিনি জানায়, বাড়ির পাশে ভোট কেন্দ্রটি আনাতেই আমাদের উপর বিপদ নেমে আসলো। আজ কয়েকদিন হলো আমার স্বামী বাড়িতে নেই। ছেলেদের কোন খোজ নেই। আমার বাপের জন্মেও এমন ঘটনা দেখিনি। আল্লাহর কাছে বলছি এর থেকে মৃত্যুই অনেক ভালো। আমরা নদী ভাঙালোক। অনেক কষ্ট করে সন্তানদের বড় করেছি। এখন যে এখান থেকে চলে যাবো তারও কোন অবস্থা নেই। কিস্তি চালাতে পারছি না। চিকিৎসা করার টাকা নাই। খাবার টাকা নাই। বিপদের মধ্যে দিন কাটছে।
কথা হয় একই এলাকার সালেহা আক্তারের সাথে। পুলিশের ভয়ে তার স্বামী পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। দুই শিশু সন্তান নিয়ে কষ্টে দিন কাটছে সালেহার। পুলিশ যদি তার স্বামীকে ধরে নিয়ে যায় এ ভয়ে কোথাও কাজ করতে পারে না। বড় ছেলের জ্বর টাকার অভাবে ওষুধ কিনতে পারেন না। মায়ের কাছে ২০০ টাকা নিয়ে সন্তানের ওষুধ ও বাজার করেছেন তিনি। এভাবে আর কত দিন থাকতে হবে প্রশ্ন রাখেন সালেহা।
এ বিষয়ে পুলিশ সুপার জাহাঙ্গীর হোসেন জানান, সহিংসতার ঘটনায় তিনটি পৃথক মামলা হয়েছে। এতে ভাংবাড়ি ভিএফ নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় ভোট কেন্দ্রের দায়িত্বরত প্রিসাইডিং কর্মকর্তা খতিবর রহমান একটি ও থানার দুই সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) বিলাশ চন্দ্র রায় ও আহাদুজ্জামান বাদী হয়ে দু’টি মামলা দায়ের করেছেন। মামলায় কারো না উল্লেখ্য নেই অজ্ঞাত আটশ জনের বিরুদ্ধে। তবে এ মামলায় নির্দোষ কাউকে হয়রানী করা হবে না।
উল্লেখ্য, নিহত সুরাইয়াকে নিয়ে মা মিনারা বেগম রাণীশংকৈল উপজেলার বাচোঁর ইউনিয়নের ৩নং ওয়ার্ডের ভাংবাড়ি ভিএফ নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় ভোট কেন্দ্রে ভোটের ফলাফল দেখতে যান । সেখানে ভোটে ফলাফলকে কেন্দ্র করে পরাজিত ইউপি সদস্য সমর্থকদের সাথে আইনসৃংখলাবাহিনীর সংর্ঘষ হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের পুলিশ গুলি ছুড়লে গুলিবিদ্ধ হয়ে শিশু সুরাইয়া আক্তার নিহত হয়।
দৈনিক কলম কথা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।