১৩ বছরেও শেষ হয়নি পিলখানা হত্যাকাণ্ডের বিস্ফোরক আইনের মামলার বিচার। তবে রাষ্ট্রপক্ষ আশা করছে, মামলাটির বিচার দ্রুতই শেষ হয়ে যাবে। আসামিপক্ষ বলছে, হত্যা মামলায় অনেক আসামি খালাস পেয়েও বিস্ফোরক মামলার কারণে তারা জেলে আছেন। মামলাটির দ্রুত নিষ্পত্তি হলে তারা মুক্তি পাবেন।
২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর পিলখানায় এক মর্মান্তিক ঘটনায় দেশ হারায় ৫৭ সেনা কর্মকর্তাকে। সে দিনের সেই ঘটনায় পুরো জাতি শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়ে।
২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর নিম্ন আদালতের রায় এবং ২০১৭ সালের ২৭ নভেম্বর হাইকোর্টে ডেথ রেফারেন্স ও আপিল নিষ্পত্তি হয়। এ ঘটনার বিস্ফোরক আইনে করা মামলা এখনো বিচারাধীন।
রাজধানীর বকশীবাজারের সরকারি আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে স্থাপিত ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের অস্থায়ী এজলাসে এ মামলার কার্যক্রম চলছে। ১১৬৪ জন সাক্ষীর মধ্যে এখন পর্যন্ত মামলাটিতে ২১১ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়েছে। সর্বশেষ গত ৯ ফেব্রুয়ারি মামলাটি সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য ধার্য ছিল। আগামী ৯ ও ১০ মার্চ মামলাটি পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের তারিখ ধার্য করেছেন বিচারক কেএম ইমরুল কায়েশ।
মামলা সম্পর্কে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল বলেন, ‘এই ঘটনায় দায়ের করা হত্যা মামলার বিচার নিম্ন আদালতের পর হাইকোর্টে পর্যন্ত নিষ্পত্তি হয়েছে। বিস্ফোরক আইনের মামলাটিতে সাক্ষ্যগ্রহণ চলছে। নিয়মিত সাক্ষ্যগ্রহণ হচ্ছিল। মাঝে দুই বছর করোনার কারণে সাক্ষ্য গ্রহণ একটু বিলম্বিত হয়। এখন আবার আদালতের কার্যক্রম চলছে। সাক্ষীও আসছে। ২১১ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়েছে। ৩০০-৩৫০ জন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ করে মামলার বিচারিক কার্যক্রম শেষ করে আদালত রায় ঘোষণা করতে পারবেন বলে আশা করছি।’
আসামি পক্ষের আইনজীবী ফারুক আহাম্মদ বলেন, ‘১৩ বছর হয়ে গেল বিস্ফোরক আইনের মামলাটির বিচার শেষ হয়নি। রাষ্ট্রপক্ষই হত্যা মামলায় রায় পাওয়ার পর বিস্ফোরক আইনের মামলার বিচার দ্রুত নিষ্পত্তির করার চেষ্টা করছে না। হত্যা মামলার খালাসপ্রাপ্ত ২৭৮ আসামি বিস্ফোরক মামলারও আসামি। হত্যা মামলায় খালাস পেয়েও বিস্ফোরক আইনের মামলার কারণে তারা মুক্তি পাননি। জামিন পাচ্ছেন না। তাই উচিত হবে যারা হত্যা মামলায় খালাস পেয়েছেন তাদের জামিন দেয়া, না হয় বিস্ফোরক আইনের মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করা। কিন্তু তা তো হচ্ছে না। আমরা আশা করছি, বিস্ফোরক মামলায় তারা খালাস পাবেন। কিন্তু কবে মামলাটি নিষ্পত্তি হবে।’
কারাবন্দি বিডিআর সদস্য মুসার ভাই মো. ওয়ারেছ বলেন, ‘বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় বিভাগীয় মামলা শেষ হয় ২০১১ সালে। এরপর হত্যা মামলাটি দুই বছর ১১ মাসের মধ্যে সকল আইনি কার্যক্রম শেষে ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর রায় দেন আদালত। এ মামলা উচ্চ আদালতে আপিল নিষ্পত্তি হয় ২০১৭ সালের ২৭ নভেম্বর। অথচ একইসঙ্গে হত্যা ও বিস্ফোরক মামলার গেজেট হওয়া সত্বেও বিস্ফোরক মামলাটি কোন এক অদৃশ্য কারণে আলাদা করা হয় যা এখনো নিম্ন আদালতে বিচারাধীন।’
তিনি বলেন, ‘আদালত থেকে হত্যা মামলায় নির্দোষ প্রমাণিত হয়ে খালাস পান ২৭৮ জন। এছাড়া স্বল্পমেয়াদী সাজাভোগ শেষ করা ১৯০ জন বিডিআর সদস্য রয়েছেন। সব মিলিয়ে ৪৬৮ জন বিডিআর সদস্য মুক্তির প্রহর গুনছেন। কিন্তু বিস্ফোরক মামলার কারণে খালাসপ্রাপ্ত ব্যক্তিগণ মুক্তি পাচ্ছেন না। এমনকি মামলা নিষ্পত্তি করা হচ্ছে না ও জামিন দেওয়া হচ্ছে না।’
মো. ওয়ারেছ বলেন, ‘আমরা অসহায় পরিবারগুলো প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করছি। কারণ ভুক্তভোগী পরিবার যেমনি ন্যায়বিচার প্রত্যাশা করে, তেমনি আমরা আসামির পরিবারগুলো ন্যায়বিচার প্রত্যাশা করি। একজন বন্দির সকল আইনি সুযোগ-সুবিধাসহ ন্যায়বিচার করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। কিন্তু আমরা সকল আইনি সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছি।’
উল্লেখ্য, ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি দাবি-দাওয়ার নামে পিলখানায় তৎকালীন বাংলাদেশ রাইফেলসের (বিডিআর) কিছু উচ্ছৃঙ্খল জওয়ান বিদ্রোহ শুরু করে। এসময় তাদের গুলিতে প্রাণ হারান ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন।
পিলখানা ট্র্যাজেডির পর বিডিআরের নাম, লোগো ও পতাকা পরিবর্তন করা হয়। এ বাহিনীর নাম পাল্টে রাখা হয় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ-বিজিবি। পরিবর্তন করা হয় বাহিনীর আইন। এদিকে পিলখানা ট্র্যাজেডির ঘটনায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে প্রথমে চকবাজার থানায় দুটি মামলা দায়ের করা হয়। পরে মামলা দুটি নিউমার্কেট থানায় স্থানান্তর করা হয়।
২০১০ সালের ১২ জুলাই হত্যা মামলায় এবং ২৭ জুলাই বিস্ফোরক আইনের মামলায় চার্জশিট দাখিল করে সিআইডি। ২০১১ সালের ১০ আগস্ট হত্যা মামলায় চার্জগঠন করে বিচার শুরু হলেও বিস্ফোরক আইনের মামলার বিচার স্থগিত ছিল। হত্যা মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণের শেষ পর্যায়ে ২০১৩ সালের ১৩ মে বিস্ফোরক আইনের মামলায় চার্জগঠনের মাধ্যমে বিচার শুরু হয়। হত্যা মামলায় চার বছর ৮ মাসে ২৩২টি কার্যদিবস পর ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর রায় ঘোষণা হয়।
রায়ে ঢাকার নিম্ন আদালত ১৫২ জনের মৃত্যুদণ্ড দেন। পরে ২০১৭ সালের ২৭ নভেম্বর হাইকোর্টে আপিলের রায়ে ১৩৯ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখা হয়। ৮ জনের মৃত্যুদণ্ডের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন ও চার জনকে খালাস দেওয়া হয়। নিম্ন আদালতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ পাওয়া ১৬০ জনের মধ্যে ১৪৬ জনের সাজা বহাল রাখা হয়। হাইকোর্টে আপিল চলার সময় কারাগারে থাকা দুজন মারা যান। খালাস পান ১২ আসামি।
দৈনিক কলম কথা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।