রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উম্মতের মধ্যে সর্বপ্রথম জান্নাতের সুসংবাদ পান খাদিজা (রাদিয়াল্লাহু আনহা)। তিনি রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শুধুমাত্র জীবনসঙ্গী ছিলেন না, তিনি ছিলেন তাঁর চিন্তাসঙ্গী।

নবুওয়্যাত লাভের পূর্বে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কখনো মূর্তিপূজা করেননি। মূর্তিপূজারী সমাজে বসবাস করে মূর্তিপূজা না করাটা বিস্ময়কর। কুরাইশরা হয়তো তাঁকে মূর্তিপূজার জন্য জোরাজোরি করেছিলো।

কুরাইশদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিজের ঘরে ফিরে খাদিজাকে (রাঃ) বলেন, “আমি কখনো লাত-উজ্জার পূজা করবো না।” নবুওয়্যাত লাভের পূর্বে রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এই তাওহীদি আবেগকে খাদিজা (রাঃ) সমর্থন জানান। তিনি বলেন, “ছাড়ুন তো লাত-উজ্জার প্রসঙ্গ! এগুলোর কথা উঠানোরই দরকার নাই।” [মুসনাদে আহমাদঃ ৪/২২২]

হেরা গুহায় ওহীলাভের পর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কিছুক্ষণের জন্য ছিলেন ‘কনফিউজড’। তিনি বুঝে উঠতে পারছিলেন না তাঁর সাথে কী ঘটছে। তাঁর হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়। মাঘ মাসের কনকনে ঠাণ্ডায় মানুষ যেমন কাঁপে, তেমনি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কাঁপতে কাঁপতে বাড়ি ফিরেন। খাদিজাকে (রাঃ) বলেন, “জাম্মিলুনী জাম্মিলুনী- আমাকে চাদরাবৃত করো, আমাকে চাদরাবৃত করো।”

খাদিজা (রাঃ) রাসূলকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) চাদরাবৃত করার পর তাঁর কাঁপুনি কমে গেলো, তাঁর শঙ্কা অনেকটা কেটে যায়। আস্তে আস্তে তিনি খাদিজাকে (রাঃ) ওহী নাজিলের পুরো ঘটনা বর্ণনা করে বললেন, “আমি নিজেকে নিয়ে শংকাবোধ করছি।”

মক্কাবাসীর কাছে ওহী নাজিলের ধারণাটি ছিলো অপরিচিত, অদ্ভুত। তারা ছিলো মুর্তিপূজারী, ওহী বা আল্লাহর কিতাবে বিশ্বাসী নয়। সেই সমাজে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ওহী লাভ করেন, যেই সমাজে ওহীর কোনো ধারণাই নেই, তিনি নিজেও শঙ্কার মধ্যে আছেন।

ঠিক সেই মুহূর্তে খাদিজা (রাঃ) আত্মবিশ্বাসের সাথে বলছেন, “ওয়াল্লাহী- আল্লাহর কসম! কখনোই না, আল্লাহ আপনাকে কখনো লাঞ্চিত করবেন না।” রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিজে শঙ্কায় আছেন, কিন্তু খাদিজা (রাঃ) তাঁকে অভয় দিচ্ছেন। আল্লাহ কেন তাঁকে লাঞ্চিত করবেন না তার পেছনে খাদিজার (রাঃ) কিছু যুক্তি আছে। তিনি একে একে যুক্তিগুলো তুলে ধরে রাসূলকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাহস যোগালেন।

– আপনি তো আত্মীয়-স্বজনের সাথে সদাচরণ করেন

– অসহায়-দুস্থদের দায়িত্ব বহন করেন

– নিঃস্বকে সহযোগীতা করেন

– অতিথিদের আপ্যায়ন করেন

– হক পথের দুর্দশাগ্রস্থকে সাহায্য করেন।

এই পাঁচটি পয়েন্টের মাধ্যমে খাদিজা (রাঃ) যেন রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নবুওয়্যাত পূর্বের জীবনীকে সামারী করলেন। মুর্তিপূজারী সমাজে বসবাস করেও খাদিজার (রাঃ) বিশ্বাস ছিলো, যে ব্যক্তির মধ্যে এতোগুলো ভালো গুণ, আল্লাহ কিভাবে তাঁকে লাঞ্চিত করবেন?

মানবজাতির ইতিহাসে অন্যতম টার্নিং-পয়েন্ট ছিলো সেই দিনটি, যেদিন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ওহীলাভ করেন। সেদিন রাসূলকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কেবল স্বান্ত্বনা দিয়েই খাদিজা (রাঃ) ক্ষান্ত হননি। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যা নিয়ে শঙ্কা করছেন, সেটার উত্তর জানতে তিনি রাসূলকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিয়ে ছুটলেন সেই বিষয়ের ‘স্পেশালিস্ট’ -এর কাছে।

ওহী, আসমানী কিতাব, ফেরেশতা এগুলো বিষয়ের উপর মক্কায় বিশেষজ্ঞ ছিলেন ওয়ারাকা ইবনে নাওফাল। তিনি জাহিলী যুগে ‘খ্রিস্টধর্ম’ গ্রহণ করেন। ওয়ারাকা ছিলেন খাদিজার (রাঃ) চাচাতো ভাই। রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নবুওয়্যাতকে ওয়ারাকা স্বীকৃতি দেন। তিনি বলেন, “তোমার কাছে তো সেই বার্তাবাহক এসেছেন, যিনি মূসার (আলাইহিস সালাম) কাছে এসেছিলেন।” [ওহী নাজিলের পুরো ঘটনাটি সহীহ বুখারীর #৩ হাদীসে আছে]

আজকের যুগে রাসূলকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বিশ্বাস করা সহজ। কারণ, আজকের যুগে একজন যদি রাসূলকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বিশ্বাস করতে চায়, সে দেখবে, সে ছাড়াও আরো ১৮০ কোটির বেশি মানুষ তার মতো বিশ্বাস করছে। তার বিশ্বাসকে কেউ ‘অদ্ভুত’ বলে ব্যঙ্গ করলে সে বলবে, আমি ছাড়াও তো আরো ১৮০ কোটির বেশি মানুষ এমন ‘অদ্ভুত’ বিশ্বাস লালন করছে, আমাকে অদ্ভুত বললে তাতে কী আসে যায়!

কিন্তু, চিন্তা করুন সেই সময়ের কথা, যখন আশেপাশের সবাই রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কথাবার্তা শুনে মনে করেছিলো, এটা অদ্ভুত কথা, এমন কথা বলার জন্য তাঁকে ‘পাগল’ বলেছিলো।

পবিত্র কুর’আনে কাফিরদের প্রতিক্রিয়া আল্লাহ তুলে ধরেন- “আর তারা বললো, হে ঐ ব্যাক্তি, যার উপর কুর’আন নাজিল করা হয়েছে, তুমি তো নিশ্চিত পাগল।” [সূরা আল-হিজরঃ ১৫:৬]

সমাজের বেশিরভাগ লোক যখন রাসূলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ‘পাগল’ বলছে, ঠিক সেই সময় খাদিজা (রাঃ) তাঁকে সত্য বলে মেনে নিচ্ছেন, এটা চট্টিখানি কথা না।

রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) খাদিজা (রাঃ) সম্পর্কে মন্তব্য করেন, “মানুষ যখন আমাকে মানতে অস্বীকার করেছে, সে তখন আমাকে বিশ্বাস করেছে। মানুষ যখন আমাকে বঞ্চিত করেছে, সে তখন তাঁর সম্পদে আমাকে অংশীদার করেছে।” [মুসনাদে আহমাদঃ ৬/১১৭-১১৮]

রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইসলামের দাওয়াত শুরু করলে কাফেররা তাঁকে নিয়ে ঠাট্টায় লিপ্ত হয়। তারা তাঁকে পাগল, গণক, কবি, মিথ্যাবাদী বলে অপবাদ দেয়।

আল্লাহ কাফেরদের অপবাদের জবাবে নবীকে স্বান্তনা দিয়ে বলেন-

“আর অবশ্যই তোমার পূর্বের রাসূলণকে নিয়েও উপহাস করা হয়েছিলো।” [সূরা আল-আন’আমঃ ৬:১০]

“তুমি উপদেশ দিতে থাকো। কারণ, তোমার রবের অনুগ্রহে তুমি গণকও নও, পাগলও নও।” [সূরা আত-তূরঃ ৫২:২৯]

“যদি তারা তোমাকে মিথ্যাবাদী বলে, তবে (জেনে রাখো) তোমার পূর্বের রাসূলগণকেও মিথ্যাবাদী বলা হয়েছিলো।” [সূরা আলে-ইমরানঃ ৩:১৮৪]

একদিকে আল্লাহ ওহী পাঠিয়ে রাসূলকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) স্বান্ত্বনা দিতেন, অন্যদিকে খাদিজা (রাঃ) রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অশান্ত মনে প্রশান্তি এনে দিতেন। কুরাইশদের উপহাস-নির্যাতন সহ্য করে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন ঘরে ফিরতেন, খাদিজা (রাঃ) তখন রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সকল কষ্ট ভুলিয়ে দিতেন।

রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রথম সীরাত রচয়িতা ইবনে ইসহাক খাদিজার (রাঃ) ব্যাপারে মন্তব্য করেন, “মুশরিকদের প্রত্যাখ্যান ও অবিশ্বাসের কারণে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যে ব্যথা অনুভব করতেন, খাদিজার (রাঃ) দ্বারা আল্লাহ তা দূর করে দিতেন। কারণ, তিনি স্বান্তনা দিতেন, সাহস এবং উৎসাহ যোগাতেন। তাঁর সব কথাই তিনি বিনা দ্বিধায় বিশ্বাস করতেন। মুশরিকদের সকল অমার্জিত আচরণ তিনি রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কাছে অত্যন্ত হালকা ও তুচ্ছভাবে তুলে ধরতেন।” [আল-ইসতীয়াবঃ ৪/২৮৩]

খাদিজার (রাঃ) ছিলো বিস্ময়কর প্রজ্ঞা। একটা উদাহরণ দিলে ব্যাপারটি বুঝতে সুবিধা হবে।

রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তখন মদীনায় ছিলেন। নবুওয়্যাত লাভের প্রায় (কমপক্ষে) পনেরো বছর পরের ঘটনা। তাশাহুদের বিধান তখনো অবতীর্ণ হয়নি। তাশাহুদের বিধান অবতীর্ণ হবার পূর্বে সাহাবীরা তাশাহুদ পড়তেন এভাবে- “আস-সালামু আলাল্লাহ” অর্থাৎ, আল্লাহর উপর সালাম (শান্তি) বর্ষিত হোক। আল্লাহ নিজেই শান্তিদাতা, আল্লাহর উপর কিভাবে শান্তি বর্ষিত হবে? আল্লাহর উপর কে শান্তি বর্ষণ করবে?

রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাহাবীদেরকে সংশোধন করে দিয়ে বললেন, “তোমরা বলবে- আত্তাহিয়্যাতু লিল্লাহি…” [সহীহ মুসলিমঃ ৭৮৩]।

অথচ নবুওয়্যাতের প্রাথমিক যুগেও আল্লাহর ব্যাপারে খাদিজার (রাঃ) ‘আকীদা’ ছিলো ক্লিস্টাল ক্লিয়ার। একবার তিনি রাসূলের জন্য হেরা গুহায় ‘টিফিন’ নিয়ে যাচ্ছিলেন। জিবরাঈল (আলাইহিস সালাম) খাদিজার (রাঃ) আগমনী বার্তা রাসূলকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দিয়ে বলেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ! ঐ যে খাদিজা আসছেন। যখন তিনি পৌঁছবেন, তখন তাঁর রবের পক্ষ থেকে এবং আমার পক্ষ থেকে তাঁকে সালাম জানাবেন। তাঁকে জান্নাতের এমন একটি প্রসাদের সুসংবাদ দিবেন, যার অভ্যন্তর ভাগ ফাঁকা-মোতি দ্বারা তৈরি করা হয়েছে। সেখানে থাকবে না কোনো প্রকার শোরগোল, থাকবে না কোনো প্রকার দুঃখ-ক্লেশ।” [সহীহ বুখারীঃ ৩৮২০]

রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উম্মতের মধ্যে এই প্রথমবারের মতো কেউ জান্নাতের সুসংবাদ পেলেন, পাশাপাশি আল্লাহর পক্ষ থেকে সালাম। রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উম্মতের মধ্যে আর কাউকে আল্লাহ এভাবে ‘সালাম’ প্রেরণ করেননি। জিবরাঈল (আঃ) অবশ্য আয়িশাকে (রাদিয়াল্লাহু আনহা) সালাম প্রেরণ করেছিলেন [সুনানে আন-নাসাঈঃ ৩৯৫৪]।

আল্লাহ এবং জিবরাঈলের (আঃ) সালামের জবাবে খাদিজা (রাঃ) জবাব দেন- “ইন্নাল্লাহা হুয়াস সালাম- আল্লাহ নিজেই শান্তিদাতা। সালাম বর্ষিত হোক জিবরাঈলের (আঃ) উপর, সালাম বর্ষিত হোক নবীর উপর।” [মুস্তাদরাকে হাকেম]

আল্লাহর সালামের জবাবে তিনি বলেননি- আল্লাহর উপরও সালাম বর্ষিত হোক; বরং তিনি জানতেন আল্লাহর উপর সালাম দেওয়া যায় না, বলতে হয় ‘আল্লাহ তো নিজেই শান্তিদাতা’।

খাদিজার (রাঃ) ইন্তেকালের পরও তিনি রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) চিন্তায় থাকতেন। আয়িশা (রাঃ) খাদিজাকে (রাঃ) দেখেননি। তবুও তিনি তাঁর উপর ঈর্ষা করতেন। কারণ, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এতো এতোবার খাদিজার (রাঃ) কথা আয়িশাকে (রাঃ) বলতেন যে, আয়িশা (রাঃ) মাঝেমধ্যে ঈর্ষায় রেগে যেতেন।

খাদিজার (রাঃ) ইন্তেকালের পর একটা বকরী জবাই হলে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বকরীর গোশত খাদিজার (রাঃ) বান্ধবীদের কাছে পাঠাতেন। আয়িশা (রাঃ) রাসূলকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জিজ্ঞেস করতেন, “আপনি খাদিজাকে (রাঃ) এতো ভালোবাসেন?”

রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জবাব দিতেন, “তাঁর ভালোবাসা তো আমার মন-মাজারে জায়গা করে নিয়েছে।” [সহীহ মুসলিমঃ ৬১৭২]

লেখক –

ইলিয়াস হুসাইন শ্রাবণ

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়