
- উন্নয়নে পাকিস্তানকে অনেক পেছনে ফেলেছে বাংলাদেশ।
সুমনসেন চট্টগ্রাম জেলা প্রতিনিধি-
মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী গত ৪৯ বছরে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের বেশিরভাগ গুরুত্বপূর্ণ সূচকে পাকিস্তানকে পেছনে ফেলেছে বাংলাদেশ। বিশ্বে বাংলাদেশ এখন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও দারিদ্র্য বিমোচনের রোল মডেল। আর পাকিস্তানের পরিচিতি দ্বন্দ্ব-সংঘাতময় পিছিয়ে পড়া এক রাষ্ট্র হিসেবে।
১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর পূর্ব পাকিস্তান নানাভাবে বঞ্চিত হয়েছে টানা ২৪ বছর। এই বঞ্চনা থেকে মুক্তি পেতে ১৯৭১ সালে স্বাধীন দেশের জন্য মুক্তিযুদ্ধে নামেন বাংলাদেশের আপামর জনগণ। ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ওই বছরের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতা অর্জন করেন। দীর্ঘদিনের বঞ্চনা আর দীর্ঘসময়ের মুক্তিযুদ্ধের ফলে স্বাধীনতার সময় দেশের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি অত্যন্ত ভঙ্গুর ছিল। অনেকে বাংলাদেশের টিকে থাকা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে। এরপর পার হয়েছে ৪৯ বছর। বাংলাদেশের জনগণের পরিশ্রম, বিভিন্ন সময়ে দায়িত্বে থাকা সরকারগুলোর ভূমিকার ফলে নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্যে বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়িয়েছে। তবে শেষ এক দশকে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক খাতে অভূতপূর্ব অগ্রগতি হয়েছে। বিশ্বব্যাংকসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা বাংলাদেশের উন্নয়নকে অন্যান্য দেশের কাছে উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরছে। অন্যদিকে, পাকিস্তান পরিণত হয়েছে দ্বন্দ্ব সংঘাতের রাষ্ট্রে।
পঞ্চাশের দশকে পূর্ব পাকিস্তানের গড় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ছিল ১ দশমিক ৯ শতাংশ। একই সময়কালে পশ্চিম পাকিস্তানে প্রবৃদ্ধি ছিল ২ দশমিক ৭ শতাংশ। ষাটের দশকে এ ব্যবধান আরও বেড়ে যায়। এ অঞ্চলের ৪ দশমিক ৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধির তুলনায় পশ্চিম পাকিস্তানে ৬ দশমিক ৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়। স্বাধীন বাংলাদেশ সেই অবস্থার পরিবর্তন করেছে অনেক আগেই। এক দশক ধরে ৬ শতাংশের বেশি হারে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হচ্ছে।গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ। এই অর্থবছরে পাকিস্তানের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল ৩ দশমিক ২৯ শতাংশ।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর কিছুদিন যেতে না যেতেই পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ শুরু করে তৎকালীন শাসকরা। এ অঞ্চলের ব্যবসা থেকে অর্জিত সম্পদ পাচার হয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে বিনিয়োগ হতো। পূর্ব পাকিস্তানের নামে নেওয়া ঋণ ব্যবহৃত হতো পশ্চিম পাকিস্তানে। ১৯৫০-৫৫ সালে সরকারি উন্নয়ন ব্যয়ের ৭০ কোটি টাকা জোটে পূর্ব পাকিস্তানের ভাগ্যে। পশ্চিম পাকিস্তান পায় ২০০ কোটি টাকা। ১৯৫৯ থেকে ৭০ সাল পর্যন্ত সরকারি রাজস্ব থেকে ব্যয়ের মাত্র ২৩ শতাংশ পায় পূর্ব পাকিস্তান। পশ্চিম পাকিস্তানের রাস্তাঘাট, বিদ্যুৎসহ অবকাঠামো উন্নয়নে ব্যাপক বিনিয়োগ করা হয়। অবহেলিত থেকে যায় এ অঞ্চল। সেই বৈষম্যের ভূখণ্ড এখন বিশ্ববাসীর চোখে উন্নয়নের বিস্ময়।
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ মানব উন্নয়নের অনেক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ দ্রুত এগিয়েছে। ১৯৯০ সালে পাকিস্তানের গড় আয়ু ছিল ৬০ বছর। বাংলাদেশের চেয়ে ২ বছর বেশি ছিল তাদের গড় আয়ু। ২০১৮ সালে বাংলাদেশের গড় আয়ু ৭২ বছর, যা পাকিস্তানের চেয়ে ৫ বছর বেশি। জাতিসংঘের সর্বশেষ মানব উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশ ১৮৮ দেশের মধ্যে ১৩৩তম। পাকিস্তানের অবস্থান ১৫৪তম। পাঁচ বছরের কম শিশু মৃত্যুহারেও এক সময় বাংলাদেশ পিছিয়ে ছিল। ২০১৮ সালের হিসাবে বাংলাদেশে জন্মগ্রহণের পর পাঁচ বছরের নিচের প্রতি এক হাজার শিশুর মধ্যে ৩২ জনের মৃত্যু ঘটে। পাকিস্তানে এ সংখ্যা ৬৯ জন। বাংলাদেশে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির হার ৭৩ শতাংশ আর পাকিস্তানে ৪৩ শতাংশ।
গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর সমকালকে বলেন, পাকিস্তানের সঙ্গে বিরোধে মূল কারণ ছিল অর্থনৈতিক বৈষম্য। বাংলাদেশ গরিব অঞ্চল ছিল। এখানে ব্যবসা, শিল্প ছিল না। সরকারের উন্নয়ন কার্যক্রম ও নীতিও ছিল পশ্চিম পাকিস্তানকেন্দ্রিক। করাচি ছিল কসমোপলিটান শহর আর ঢাকা ছিল মফস্বল শহর। সেই থেকে ৬ দফা, তারপর মুক্তিযুদ্ধ। স্বাধীনতার পর অনেকেই বলেছেন, বাংলাদেশ রাজনৈতিক স্বাধীনতা পেলেও অর্থনৈতিক মুক্তি পাবে কিনা, তাতে সংশয় রয়েছে। এমনকি পাকিস্তানের নেতারা বলেছেন, পূর্ব পাকিস্তান আলাদা হয়ে যাওয়ায় তাদের বোঝা কমেছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের বেসরকারীকরণ নীতি, নতুন নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি এবং উদ্যোক্তাবান্ধব নীতিমালা দেশকে এগিয়ে নিয়েছে। কিন্তু পাকিস্তান দ্বন্দ্ব-সংঘাতের কারণে অর্থনৈতিকভাবে এগোতে পারেনি। এমনকি সামাজিকভাবেও পিছিয়ে পড়েছে।
দৈনিক কলম কথা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।