বঙ্গবন্ধুর সেই টেলিফোন।

সুমনসেন চট্টগ্রাম জেলা প্রতিনিধি-

বিভিন্ন আলোকচিত্রে বঙ্গবন্ধুকে ৩২ নন্বরের বাড়িতে বসে ল্যান্ডফোনে কথা বলতে দেখা যায়। ওই টেলিফোনের নম্বর কত ছিল?

এখন কেউ বলতে না পারলেও চার অংকের এই ফোন নম্বর সেই সময়কার রাজনৈতিক নেতাকর্মী, পুলিশ, সাংবাদিক এবং প্রশাসনের মুখস্ত ছিল। নম্বরটি ২৫৬১। কথায় বললে বলা হতো: পঁচিশ একষট্টি। এই নম্বরে ফোন করে যে কেউ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কথা বলতে পারতেন।

বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক এবং আওয়ামী লীগ নেতা মগবাজারের আকতার সর্দার মৃত্যুর কয়েক বছর আগে এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলার বলেন, ‘তখন ঢাকায় এত রাস্তাঘাট ও গাড়িঘোড়া ছিল না। সবাই পায়ে হেঁটে ৩২ নম্বরে গিয়ে নেতার সঙ্গে দেখা করতেন। যেতে না পারলে পঁচিশ একষট্টি নম্বরে ডায়াল ঘুড়িয়ে কথা বলে নিতাম। বাসায় থাকলে বঙ্গবন্ধু নিজেই ফোন তুলতেন।’

এই একটিই ফোন ছিল বঙ্গবন্ধুর বাসায়। দেশের নির্বাহী প্রধান হওয়ার পরেও লাল টেলিফোন, সাদা টেলিফোন বা সবুজ টেলিফোনের চিন্তা করেননি। যদি তাই করতেন, তাহলে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তায় ঢাকা প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন ছেড়ে তিনি বট, ঝাউ, কাঁঠাল আর বাঁশঝাড়ে ঘেরা ধানমন্ডির বাড়িটি বেছে নিতেন না। নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া সৌখিনতা করে বঙ্গবন্ধু এবং তার পরিবারের সদস্যরা কিছু করতেন না।

এ কারণে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ছিল একটিই ফোন। ড্রয়িংরুমে বেতের টি-টেবিলে রাখা থাকত ফোনটি। পরিবারের সদস্যরা সবাই মিলেমিশে সেটি ব্যবহার করতেন।

৩২ নম্বরের বাড়িতে আসার পর এই ফোন নেয়া হয়। তার আগে বঙ্গবন্ধুর নামে আর কোনো টেলিফোন বরাদ্দ ছিল না।

কারাগার যার ঘর-সংসার ছিল, বাইরে এমন সৌখিনতার চিন্তা কখনও তার মাথায় ঢোকেনি। ষাটের দশকে এ বাড়ি বানানোর পর নিতান্ত প্রয়োজনীয় বস্তু হিসাবে তিনি টেলিফোনের সংযোগ দিয়েছিলেন।

এতে যোগাযোগ সহজতর হলেও বঙ্গবন্ধুর জীবনে অনেক সময় তা বিড়ম্বনা ডেকে আনত। পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার লোকজনের মূল টার্গেট ছিল বঙ্গবন্ধুর ফোনটি। তারা ২৪ ঘণ্টাই আড়ি পাতত। শোনার চেষ্টা করত ফোনে তিনি কী কথা বলেন। তার কাছে কারা কারা ফোন করেন এবং কী কথা হয় সেটা গোয়েন্দারা রেকর্ড করত।

১৯৬১ সালের ১ অক্টোবর এ বাড়িতে ওঠার পর থেকেই বঙ্গবন্ধুর সবকিছু গোয়েন্দা তদারকিতে চলে আসে। তবে বঙ্গবন্ধুর চৌকষ রাজনীতিও তাদের চেয়ে কোনো অংশে কম ছিল না। বিভিন্ন সহকর্মী, রাজনৈতিক নেতা এবং ছাত্রনেতাদের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ কথা বলার সময় তিনি ছদ্মনাম এবং সাংকেতিক (কোডেড) শব্দ ব্যবহার করতেন, যাতে গোয়েন্দারা কথাবার্তা বুঝতে না পারে।

ফজলুল হক মনি ফোনে বঙ্গবন্ধুর কাছে নিজেকে ‘বালুওয়ালা’ বলে পরিচয় দিতেন। তারা বাড়িওয়ালা এবং বালুওয়ালা পরিচয়ে প্রথমে দেনা-পাওনা নিয়ে আলাপ জুড়ে দিতেন। এর মাঝে কোড বা সাংকেতিক শব্দে প্রয়োজনীয় কথাবার্তা সেরে নিতেন। অপরদিকে সিরাজুল আলম খান ফোনে বঙ্গবন্ধুকে ‘ইটাওয়ালা’ হিসাবে পরিচয় দিতেন। এ পরিচয় শুনতে পেয়ে গোয়েন্দারা আড়িপাতা বন্ধ করে দিত।

বঙ্গবন্ধুর ঘটনাবহুল রাজনৈতিক জীবনে ৩২ নম্বরের টিঅ্যান্ডটি ফোনটি অনেক কিছুর সাক্ষী। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরবেলায় একদল বিপথগামী সেনা অফিসার এ বাড়িতে আক্রমণ চালালে সেই ফোনটি হয়ে ওঠে শেষ ভরসাস্থল। বঙ্গবন্ধু তখন ফোনের মাধ্যমে বিভিন্ন স্থানে যোগাযোগ করেছিলন।

এর সঠিক বর্ণনা পাওয়া যায় বঙ্গবন্ধুর রেসিডেন্ট পিএ আ ফ ম মোহিতুল ইসলামের বর্ণনায়। তিনি বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বাদীও। তার বর্ণনা অনুযায়ী, ১৪ আগস্ট রাত ৮টা থেকে ১৫ আগস্ট সকাল ৮টা পর্যন্ত তিনি ৩২ নম্বর বাড়িতে দায়িত্বরত ছিলেন। হঠাৎ করে তিনি ঘুমিয়ে পড়েন। এরপর টেলিফোন মিস্ত্রির ডাকে তার ঘুম ভেঙ্গে যায়। মিস্ত্রি বলেন, প্রেসিডেন্ট সাহেব আপনাকে ডাকছেন। তখন সময় ভোর ৪টা কি ৫টা হবে। বঙ্গবন্ধু তাকে বলেন, সেরনিয়াবাতের বাসায় দুষ্কৃতকারীরা আক্রমণ করেছে। এ কথা শুনে তিনি (মোহিতুল) ওই ফোন থেকে পুলিশ কন্ট্রোল রুমে ফোন করেন। অনেক চেষ্টার পরও লাইন পাচ্ছিলেন না। এরপর গণভবন এক্সচেঞ্জে লাইন লাগানোর চেষ্টা করেন। ফোন ধরে ‘হ্যালো হ্যালো’ বলে চিৎকার করা অবস্থায় বঙ্গবন্ধু নিচে এসে তার হাত থেকে রিসিভার নিয়ে বললেন, ‘আমি প্রেসিডেন্ট বলছি’।

ঠিক তখনই দক্ষিণ দিকের জানালা দিয়ে একঝাঁক গুলি এসে কক্ষের দেওয়ালে লাগে। গুলির শব্দে তারা শুয়ে পড়েন মেঝেতে। কিছুক্ষণের জন্য গুলির শব্দ বন্ধ হলে বঙ্গবন্ধু নিচ থেকে উপরে উঠে যান। এর মধ্যে আবার গোলাগুলি শুরু হয়। বঙ্গবন্ধু তখন তার সেই ফোন নিয়ে ব্যস্ত। ফোনে তিনি তার সামরিক সচিব কর্নেল জামিলকে বলেন, ‘জামিল তুমি তাড়াতাড়ি আসো। আর্মির লোকজন আমার বাসা অ্যাটাক করেছে। সফিউল্ল্যাহকে ফোর্স পাঠাতে বলো।’

সেই ফোন থেকে এরপর সেনাপ্রধান জেনারেল শফিউল্লাহকে ফোন করেন বঙ্গবন্ধু। বলেন ‘শফিউল্লহ, তোমার ফোর্স আমার বাড়ি অ্যাটাক করেছে। কামালকে বোধ হয় মেরে ফেলেছে। তুমি জলদি ফোর্স পাঠাও।’

ফোনের ওপাশ থেকে শফিউল্লাহ বলেছিলেন ‘আই অ্যাম ডুয়িং সামথিং, ক্যান ইউ গেট আউট?’

বঙ্গবন্ধুকে বাঁচাতে এসে প্রাণ দেন কর্নেল জামিল। জেনারেল সফিউল্লাহ ৩২ নম্বরমুখী হননি। পরদিন মোশতাকের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করার জন্য বঙ্গভবনে হাজির হয়েছিলেন।

খুনিচক্র সপরিবারে হত্যা করে বঙ্গবন্ধুকে। বিশাল দেহের মানুষ শেখ মুজিবের রক্তাক্ত লাশ পড়ে থাকে সিঁড়ির উপর। সেই টেলিফোন থেকে খুব বেশি দূরে নয়।