বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি বিকাশের এক মহান পৃষ্ঠপোষক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবঃ

উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে আইউব খানের পতনের পর জেনারেল ইয়াহিয়া খান ক্ষমতার মসনদে বসেন এবং বাধ্য হয়েই ১৯৭০ সালে দেশে সাধারণ নির্বাচনের ঘোষণা দেন। এই নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ বিপুল ভোটে জয়লাভ করে। কেন্দ্রীয় আইনসভায় (জাতীয় পরিষদ) আওয়ামী লীগ ৩১৩ টি আসনের মধ্যে ১৬৭ টি আসন লাভ করে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। নির্বাচনের পরপরই বঙ্গবন্ধু বাংলার কবি সাহিত্যকদের বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির বিকাশে আত্মনিয়োগ করার আহ্বান জানান। তিনি তৎকালীন সংস্কৃতি ও চলচিত্র বিষয়ক সাপ্তাহিকী পূর্বানীর ষষ্ঠ প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উপলক্ষে ৩১ ডিসেম্বর ১৯৭০ ঢাকার হোটেল পূর্বানীর এক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে বলেন :
“জনগণের স্বার্থে এবং বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে নতুন করে গড়ে তোলার জন্যে সাহিত্যকদের প্রাণ খুলে আত্মনিয়োগ করার জন্য আমি আবেদন জানাচ্ছি। আমি তাঁদের আশ্বাস দিচ্ছি শিল্পী, কবি এবং সাহিত্যকবৃন্দের সৃষ্টিশীল বিকাশের যেকোন অন্তরায় আমি এবং আমার দল প্রতিহত করবে। আজ আমাদের সংস্কৃতির সামনে কোন চক্রান্ত নেই, শাসন বা নিয়ন্ত্রণের বেড়াজাল নেই। শিল্পী সাহিত্যিকরা আর মুষ্টিমেয় সুবিধাভোগী ব্যক্তিবর্গের জন্যে সংস্কৃতি চর্চা করবেন না। দেশের সাধারণ মানুষ, যারা আজও দুঃখী, যারা আজও নিরন্তন সংগ্রাম করে বেঁচে আছে, তাদের হাসি কান্না, সুখ দুঃখকে শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির উপজীব্য করার জন্যে শিল্পী, সহিত্যিক সংস্কৃতি সেবীদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি”।

“স্বাধীনতার পর বাংলাভাষা ও সংস্কৃতির বিকাশের জন্যে প্রায় কিছুই করা হয়নি। শিল্পী সাহিত্যিক এবং সংস্কৃতিসেবীদের তাঁদের সৃষ্টিশীল কাজের মাধ্যমে মানুষের আশা-আকাংক্ষা প্রতিফলিত করতে দেয়া হয়নি। যে সংস্কৃতির সাথে দেশের মাটি ও মনের সম্পর্ক নেই তা বেশি দিন টিকে থাকতে পারে না। ধর্ম ও জাতীয় সংহতির নামে আমাদের সংস্কৃতিকে ধ্বংস করার চেষ্টা করা হয়েছে। বাঙলা সংস্কৃতির বিরুদ্ধে এই চক্রান্ত আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতির বিকাশে অন্তরায় সৃষ্টি করেছে। কিন্তু আমাদের জনগণ এই চক্রান্ত প্রতিহত করেছে। আপনারা সবাই আমাদের মহান ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস জানেন। বাংলা ভাষা ও বঙ্গ সংস্কৃতিকে ধ্বংস করার জন্যে জাতীয় পুনর্গঠন ব্যুরো স্থাপন করা হয়েছে। পাকিস্তান বেতার ও টেলিভিশনও এই ষড়যন্ত্রের দোসর। তারা রবীন্দ্র সঙ্গীত প্রচার বন্ধ করে দিয়েছিল এবং আজও এ ব্যাপারে উঁচু মহলে জোর আপত্তি রয়েছে। জনগণ তাদের ভাষা ও সংস্কৃতির বিরুদ্ধে এই চক্রান্ত সহ্য করবে না। বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে যেসব বাঙালি সরকারী সমর্থন পেয়েছেন, তাঁদের দিন আজ শেষ”।

ছাত্রলীগের ২৩ তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর অনুষ্ঠানে (১৯৭১ সালের ৪ জানুয়ারি) প্রধান অতিথির ভাষণে অত্যন্ত ক্ষোভের সাথে বঙ্গবন্ধু বলেন :
“অতীতে বাংলাদেশের গৌরবময় ইতিহাসকে বিকৃত করার সুপরিকল্পিত চেষ্টা করা হয়েছে। বাংলা ভাষা, সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যকে ধ্বংস করার চেষ্টা করা হয়েছে। আমার মুখের ভাষাকে কেড়ে নেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। আমরা আন্দোলন করে তা রুখেছি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুলকে বাদ দিয়ে বাংলাভাষা এবং সাহিত্যের কথা ভাবা যায় না। কিন্তু এর উপর বারবার হামলা এসেছে। ভেবে অবাক হতে হয় কাজী নজরুলের কবিতার শব্দ পরিবর্তন করা হয়েছে। গানের শব্দ বদল করে রেডিওতে গাওয়া হয়েছে। তারা মুসলমানী করিয়েছে। এ অধিকার তাদের কে দিল?”

বঙ্গবন্ধু বাংলার কবি সাহিত্যিকদের বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির বিকাশে আত্মনিয়োগের আহ্বান জানিয়েই কেবল ক্ষান্ত থাকলেন না, তিনি ঘোষণা করলেন ক্ষমতা গ্রহণের দিন থেকেই তিনি সরকারী অফিস আদালতে বাংলা ভাষা চালু করবেন। ১৯৭১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমীর একুশের অনুষ্ঠানের উদ্বোধনী ভাষণে তিনি বললেন :

“ভাষা আন্দোলনের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে আমি ঘোষণা করছি যে, আমার দল ক্ষমতা গ্রহণের দিন থেকেই সকল সরকারী অফিস আদালত ও জাতীয় জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে বাংলা চালু করবে। এ ব্যাপারে আমরা পরিভাষা সৃষ্টির জন্যে অপেক্ষা করবো না। কারণ তাহলে সর্বক্ষেত্রে কোন দিনই বাঙলা চালু করা সম্ভব হবে না। এই অবস্থায় কিছু কিছু ভুল হবে, কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে না। এভাবেই অগ্রসর হতে হবে”।

বঙ্গবন্ধু ৭ কোটি বাঙালিকে দেয়া তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছিলেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে তাঁর দল আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন সত্ত্বেও পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা শুরু করলে এবং ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতের অন্ধকারে অতর্কিতে ঢাকায় বাঙালি নিধন শুরু করলে বঙ্গবন্ধু সেই রাতেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। শেষমেষ দীর্ঘ নয় মাস এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে এবং দুই লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। আর দেশ স্বাধীনের পরপরই বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের সংবিধানের ৩ নম্বর অনুচ্ছেদে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করেন।