জেমস আব্দুর রহিম রানা: চলমান ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) নির্বাচনে সহিংসতা থামছেই না। নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সঙ্গে মাঠ প্রশাসনের বৈঠকে ঢাকা ও খুলনা বিভাগে সহিংসতার আশঙ্কার পরও প্রাণহানি কমেনি। বরং একের পর এক সহিংসতায় মৃত্যুর মিছিল ভারি হচ্ছে। ছয় ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের কেবল দ্বিতীয় ধাপ শেষ হয়েছে। ইতোমধ্যে কফিনের মিছিল শুরু হয়ে গেছে। সামনের ধাপগুলোতে যে আরও মৃত্যুর মিছিল নামবে তা সহজেই অনুমেয়।
অথচ ইউপি নির্বাচনের চিত্র আগে এমন ছিল না। সরকারের প্রশাসনিক কাঠামোর সর্বনিম্ন এই স্তরটি ছিল রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষপাতের বাইরে। এখানে এক প্রার্থী অন্য প্রার্থীর সঙ্গে কুশল বিনিময় করতেন, একই সঙ্গে প্রচারে অংশ নিতেন। পোস্টারে পোস্টারে ছেয়ে যেত গ্রামের পর গ্রাম। রীতিমতো হই চই পড়ে নির্বাচনী এলাকায়। নির্বাচনের পর আবার যে যার মতো, বিজয়ী প্রার্থীকে সহযোগিতা, সম্মান করতেন।
কিন্তু এখন সেসব কথা অতীত। ২০১৬ সালের ২২ মার্চ দেশে দলীয় প্রতীকে ইউপি নির্বাচন শুরু হয়। এরপর নষ্ট হয় আগের সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ। শুরু হয় সংঘাত-সংঘর্ষ-সহিংসতা। শান্তিপূর্ণ নির্বাচন ব্যবস্থা হয়ে ওঠে রক্তাক্ত। বর্তমানে নির্বাচন চলাকালে প্রায় প্রতিদিনই মারামারি, সংঘর্ষ, ভাঙচুর, গ্রেপ্তার চলছেই। বেড়েছে নিজ দলের মধ্যে আন্তঃকোন্দল ও রেষারেষি। ধারাবাহিকভাবে সহিংসতা বাড়তে থাকায় দলীয় প্রতীকে ইউপি নির্বাচন থেকে সরে আসার কথা ভাবছে খোদ ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতাকর্মী।
একই সুরে কথা বলছেন বিএনপিসহ অন্য দলের নেতাকর্মীরাও।
এ বিষয়ে ইসির সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নির্বাচনে অন্য দলের কিংবা স্বতন্ত্র প্রার্থী থাকলেও ভোটের মাঠে কার্যত ক্ষমতাসীনরাই। ভোটে আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগই। ক্ষমতাসীন দলের নিজেদের মধ্যকার সংঘাত- সহিংসতা নিয়ন্ত্রণ করা নিয়ে বেকায়দায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও। স্থানীয়ভাবে দুই পক্ষই শক্তিশালী হওয়ায় কিছুকিছু জায়গায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। আবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উভয়পক্ষের সাথে সখ্যতা থাকার কারণেও সহিংসতা রোধের ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।
সূত্র জানায়, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রতীক প্রশ্নে দলের শীর্ষ নেতাদের আবারও মতামত নিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত ২৫ অক্টোবর আওয়ামী লীগ স্থানীয় সরকার নির্বাচন মনোনয়ন বোর্ডের সভায় ইউপি নির্বাচনে প্রতীক নিয়ে নতুন করে মতামত গ্রহণ করা হয়। সভায় বেশির ভাগ সদস্য ইউপি নির্বাচনে প্রতীক না রাখার ব্যাপারে পরামর্শ দেন।
সূত্র জানায়, ইউপি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট সহিংসতায় শুরু থেকে এ পর্যন্ত দেশে অর্ধশতাধিক মানুষ মারা গেছেন। এর মধ্যে অধিকাংশই আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতাকর্মী। সর্বশেষ ১১ নবেম্বর দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনের দিন যে ৭ জন মারা গেছেন তারা সবাই আওয়ামী লীগের। দলের চরম দুর্দিনে এসব নেতাকর্মীই তৃণমূল পর্যায়ে আওয়ামী লীগকে সাহস ও শক্তি যুগিয়েছেন। কিন্তু এখন দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হওয়ায় স্থানীয় নেতাকর্মীরা ঐক্যবদ্ধ থেকে নির্বাচন করতে পারছেন না।
কেউ কেউ দলের নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর পক্ষে কাজ করলেও অন্যরা বিদ্রোহী প্রার্থীর পক্ষে অবস্থান নিচ্ছেন। আবার কোন কোন ইউপিতে একাধিক বিদ্রোহী প্রার্থী হয় আওয়ামী লীগ থেকেই। আর এ সুযোগে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে কোন কোন এলাকায় বিএনপি নেতাকর্মীরা ইউপি চেয়ারম্যান-মেম্বার নির্বাচিত হয়ে যাচ্ছেন। এভাবে দুই ধাপের ইউপি নির্বাচনে বিএনপির শতাধিক চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজনৈতিক ও সামাজিক অবক্ষয় এসব ঘটনার জন্ম দিচ্ছে। তবে এই সহিংসতার জন্য প্রার্থী এবং রাজনৈতিক দলের কর্মীদের অসহনশীল মানসিকতাই অনেকাংশেই দায়ী। এ অবস্থা নিরসনে নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলের কর্মী এবং প্রার্থীর সমর্থকদের সহনশীল হতে হবে। রাজনৈতিক দলের কর্মীরা সংযত হলে সহিংসতা কমে আসবে। সহিংসতা কমানোর ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীদের বড় ভূমিকা রয়েছে।
পর্যবেক্ষক মহল মনে করছেন, দলীয় প্রতীকে ইউপি নির্বাচন হওয়ায় অনেক সময় সবচেয়ে যোগ্য প্রার্থী বিজয়ী না হয়ে অপেক্ষাকৃত দুর্বল প্রার্থী চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে যান। এর ফলে তৃণমূল পর্যায়ের মানুষ সঠিক জনপ্রতিনিধি না পাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হন। কখনও কখনও অধিকতর সৎ, শিক্ষিত, মেধাবী ও যোগ্য প্রার্থী দলীয় প্রতীক না পেয়ে নির্বাচন থেকেই সরে দাঁড়ান। আবার দলের কোন পদে নেই কিন্তু দলের সমর্থক এলাকার অনেক জনপ্রিয় লোক ইচ্ছে করলেও দলীয় প্রতীক না পাওয়ায় নির্বাচন করতে পারেন না। এর ফলে অনেক ভাল মানুষ স্থানীয় সরকার প্রতিনিধি হওয়া থেকে বঞ্চিত হন। এসব কিছু বিবেচনা করেই আওয়ামী লীগের একটি অংশ প্রতীক ছাড়া নির্বাচনের ব্যাপারে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে বার্তা দেন। এই বার্তা এখন দল ও সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে এবং বিষয়টি নিয়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে।
এদিকে প্রথম ধাপের চেয়ে দ্বিতীয় ধাপের ইউপি নির্বাচনে বেশি সহিংসতা হওয়ায় তৃণমূল পর্যায়ের আওয়ামী লীগ নেতারাকর্মীরাও আতঙ্কিত। তাই ইতোমধ্যেই পরবর্তী ধাপের ইউপি নির্বাচনে স্বতন্ত্র মনোনয়নের দাবি জোরালো হচ্ছে। ইউপি নির্বাচনে স্বতন্ত্র মনোনয়নের সুযোগ চেয়ে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বোর্ডের কাছে লেখা নোয়াখালী-৪ (সদর ও সুবর্ণচর) আসনের সংসদ সদস্য একরামুল করিম চৌধুরীর চিঠি একটি জলন্ত উদাহরণ।
এ চিঠির কপি প্রধানমন্ত্রী বরাবরেও পাঠানো হয়েছে। দ্বিতীয় ধাপের ইউপি নির্বাচনের দিন তিনি প্রধানমন্ত্রীর কাছে চিঠি লিখে নিজ নির্বাচনী এলাকায় ইউনিয়ন ও পৌরসভা নির্বাচনে দলীয় মনোনয়নের পরিবর্তে স্বতন্ত্র মনোনয়নের জন্য আওয়ামী লীগের স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ডে চিঠি দেন। চিঠির একাংশে তিনি বলেন, দেশে শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখা এবং দলীয় নেতাকর্মীদের রক্তক্ষয়ী সংঘাত থেকে মুক্তির প্রত্যাশায় উন্মুক্তভাবে (স্বতন্ত্র) নির্বাচন অনুষ্ঠানের সুযোগ রাখার আবেদন করছি। তার এ চিঠির বিষয়টি নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গন বেশ সরগরম হয়ে উঠেছে।
নির্বাচন বিশেষজ্ঞদের মতে, ইউপি নির্বাচনে কাউকে দলীয় প্রতীক না দিয়ে নির্বাচন সবার জন্য উন্মুক্ত রাখা হলে অপেক্ষাকৃত ভাল প্রার্থী বিজয়ী হবেন। আর তখন প্রশাসনের লোকেরাও সব প্রার্থীর দিকে সমান নজর রাখবেন। কিন্তু এখন যেই প্রার্থী সরকারী দলের প্রতীক পান তার প্রতি প্রশাসনের সুনজর থাকে এর ফলে এই প্রার্থী অপেক্ষাকৃত বেশি প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করেন। আর এই প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করেই সংঘাত-সহিংসতা বৃদ্ধি পায়।
এদিকে ইউপি নির্বাচনে চলমান সহিংসতা নিয়ে শুরু থেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করে আসছে অন্যতম শক্তিশালী রাজনৈতিক দল বিএনপি। সরকারকে এ ক্ষেত্রে তারা ব্যর্থ বলেও ঘোষণা করেছে। এ বিষয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের ভাষ্য, দেশে নির্বাচনের যে হাল তা নিয়ে আর কথা বলতে চাই না। বিএনপি দলীয়ভাবে ইউপি নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না। তবে সরকারী দল আওয়ামী লীগ নিজেরা নিজেরাই মারামারি ও খুনোখুনি করছে।
সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না জেনেই আমরা দলীয়ভাবে এ নির্বাচনে অংশ না নেয়ার সিদ্ধান্ত নেই। বিএনপি দলের কাউকে নির্বাচন করতে বলেনি। তবে ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তে বিএনপির কেউ এ নির্বাচনে অংশ নিলে সেটা তার বিষয়। আগে নিরপেক্ষ সরকার, তারপর হবে নির্বাচনের চিন্তা। নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া কোন নির্বাচনে অংশ নেবে না বিএনপি। আর আমরা আগে থেকেই দলীয় প্রতীকে ইউপি নির্বাচনের বিপক্ষে ছিলাম। কিন্তু সরকার আমাদের কথা আমলে নেয়নি।
উল্লেখ্য, ২০১৬ সালে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আইন সংশোধনের মাধ্যমে ইউপি নির্বাচনসহ স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক ব্যবহার করার বিধান করা হয়। যদিও সরকারের বাইরে থাকা বেশ ক’টি রাজনৈতিক দলই তখন দলীয় প্রতীকে নির্বাচনের বিরোধিতা করেছিল। আওয়ামী লীগের কোন কোন নেতাও এমনটি চাননি। তবে দলীয় হাইকমান্ডের সিদ্ধান্ত হওয়ায় এ বিষয়ে তখন আওয়ামী লীগের কেউ বিরোধিতা করেননি। কিন্তু এখন এ নিয়ে দলের অনেক নেতাকর্মীই বিব্রত।
কারণ, নির্বাচনে একজনকে দলীয় প্রতীক নৌকা দিলে আরও একাধিক বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে যাচ্ছেন। এর ফলে ভোট দিতে গিয়েও বিব্রত হতে হয়।
এ অবস্থায় সহিংসতা কমানোর ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীদের বড় ভূমিকা রয়েছে বলে বিজ্ঞ মহল মনে করেন। বিজ্ঞজনের মতে নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলের কর্মী এবং প্রার্থীর সমর্থকদের সহনশীল হতে হবে। রাজনৈতিক দলের কর্মীরা সংযত হলেই চলমান নির্বাচনী সহিংসতা কমে আসবে।
দৈনিক কলম কথা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।