১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে ১৬ই ডিসেম্বর সশস্ত্র তিরানব্বই হাজার সৈন্য নিয়ে জেনারেল নিয়াজীর নেতৃত্বে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আত্মসমর্পণে বাধ্য হন এবং বাংলাদেশ বিজয়ের স্বাদ পায়।

যে কোনো যুদ্ধে সবচেয়ে প্রথম এবং বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় নারী (বর্তমানে রোহিঙ্গা মহিলারা)। যাদের বয়স ১৫-২৫। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের অবদানে চিরস্মরণীয়, চিরভাস্বর, অম্স্নান একটি নাম বীরাঙ্গনা। বীরাঙ্গনা নামটির প্রতিফলনে ভেসে ওঠে চোখের সামনে বেদনাবিধুর কাহিনী।

“চিরসুখী জন ভ্রমে কি কখন, ব্যথিত বেদন বুঝিতে পারে, কি যাতনা বিষে, বুঝিবে সে কিসে, কভু আশী বিষে দংশেনি যারে।’ যার ব্যথা সেই জানে। দংশিত ব্যক্তিই কেবল বিষের জ্বালার তীব্রতা বুঝতে পারে, অন্য কেউ নয়।

একজন স্বাভাবিক মানুষ কোনো কারণে অন্ধ হয়ে গেলে তিনি বুঝতে পারেন চোখের কি প্রয়োজনীয়তা। হঠাৎ পঙ্গুত্ববরণ করলে জানতে পারেন পায়ের কি উপকারিতা। অস্বাভাবিকভাবে অসুস্থ হলেই সুস্থতার নেয়ামত মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে পারেন। হতদরিদ্র, দরিদ্র, নিপীড়িত, নির্যাতিত ও আর্তজনেরই কষ্ট বা বুকের হাহাকার কি সুখে থাকা পায়রাদের কলরব ঠেলে কানে আসে? কিছু ঋণ শোধ করা যায় না। তবে শোধ করার চেষ্টা করতে হয়। উদাসী গৃহকর্তাদের ঘরের উপোসি বিড়ালের দুঃখ বিনয়ের সঙ্গে শোনানোর জন্যই এই স্বাধীনতার মাসে তথা গর্ব ও অহংকারের সন্ধিক্ষণে কিভাবে নারী জাতির সম্মান ও মর্যাদা চিরতরে বৃদ্ধি করা যায় তার জন্যই লিখছি।

অতীতে এই পৃথিবীর তিন মহাকবি আমাদের দেখিয়েছেন উন্মক্ত বা মদমুক্ত পুরুষ যখন নারীর ওপর অত্যাচার করেছে তখন অবশ্যাম্ভাবী ধ্বংস হয়েছে।

হেলেনকে অপহরণের জন্য অপূর্ব সুন্দর ট্রয়নগরী ধ্বংস হয়েছে। সীতা হরণের জন্য ভুবন বিখ্যাত স্বর্ণময়ী লঙ্কার বিনাশ ঘটেছে আর পুরুষের রাজসভায় দ্রোপদীর অসম্মানে কুরু বংশকে ধ্বংস করেছে সমূলে।

যে সভায় দুঃশাসন দ্রোপদীকে বিবস্ত্র করেছিল সেই সভায় পান্ডব ও কৌরব বংশের সব বীরপুরুষ ছিলেন। কিন্তু কোনো বীরই দ্রোপদীকে রক্ষা করেননি। পাকিস্তানও নারীর প্রতি অত্যাচারের কারণে ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে ১৬ ডিসেম্বর সশস্ত্র তিরানব্বই হাজার সৈন্য নিয়ে জেনারেল নিয়াজীর নেতৃত্বে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আত্মসমর্পণে বাধ্য হন এবং বাংলাদেশ বিজয়ের স্বাদ পায়। যে কোনো যুদ্ধে সবচেয়ে প্রথম এবং বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় নারী (বর্তমানে রোহিঙ্গা মহিলারা)। যাদের বয়স ১৫-২৫। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধেও এর ব্যতিক্রম হয়নি।

মুক্তিযুদ্ধের অবদানে চিরস্মরণীয়, চিরভাস্বর, অম্স্নান একটি নাম বীরাঙ্গনা। বীরাঙ্গনা নামটির প্রতিফলনে ভেসে ওঠে চোখের সামনে বেদনাবিধুর কাহিনী। মনে প্রশ্ন জাগে, কি রহস্য ছিল তাদের অবয়বে কি-ই বা অপরাধ ছিল তাদের আচরণে, কথা-বার্তায়, ব্যবহারে? কামুক মনকে উত্তেজিত করা লোলুপ দৃষ্টির সেই পাকিস্তানি পশুদের কাছে তাদের একমাত্র অপরাধ ছিল টগবগে সম্ভ্রম মেশানো যৌবন এবং জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ ছিল সতীত্ব।

সেই যৌবনই হলো তাদের জীবনের সবচেয়ে বড় শত্রম্ন। পাকিস্তানি পশুদের মনোরঞ্জনের জন্য এদেশীয় দালালদের সহযোগিতায় তাদের শিবিরে বা ক্যাম্পে জোরপূর্বক টেনে-হিঁচড়ে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। তাদের কান্না, আর্তনাদ বা চিৎকার আকুতি-মিনতি শয়তানদের মন গলাতে পারেনি।

ফলে তাদের ওপর চালানো হয় পাশবিক, অমানবিক ও নৃশংস নির্যাতন। তাদের করুণ আর্তনাদে থমকে যেত উড়ন্ত একঝাঁক পাখির দল, বেদনায় মুষড়ে উঠত কুয়াশার শান্ত সকাল, সূর্য লজ্জা পেয়ে মাঝেমধ্যে মেঘের আড়াল হতো, চিৎকারে ভেঙে যেত সমস্ত নীরবতা, কান্নায় ভেসে যেত মরুভূমির শুষ্কতা, আর যন্ত্রণায় ছটপট করত ঝরে পড়া পাতারা।

কী অসীম ত্যাগ। যাদের সর্বোচ্চ ত্যাগের বিনিময়ে আজ আমরা স্বাধীন আকাশ পেলাম, আজ সেই আকাশ থেকেই দিনে প্রচন্ড রোদ আর বর্ষার দিনের বৃষ্টি তাদের মাথা গোঁজানো ঠাঁইয়ের নিত্যসঙ্গী। স্বাধীন জমিন পেলেও তারা এই জমিনে স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারতেন না। ক্ষুধার জ্বালা, সম্ভ্রম হারানোর বেদনা, সামাজিক বদনাম আর নিষ্ঠুর আকাশও যেন এক সময়ের যৌবনের মতো শত্রম্ন। সব দুঃখ, কষ্ট, জ্বালা, যন্ত্রণা, অপমান, বদনাম একাকার হয়ে মিশে আছে তাদের দুর্বিষহ জীবনে। সমাজে, সংসারে, বাবা এবং মায়ের বাড়িতে ঠাঁই হয়নি তাদের। বিয়ে হলেও সংসার হয়নি। আর সংসার হলেও তার রক্ষা হয়নি। অনেকে পেটের বাচ্চা নষ্ট করেছিল। কার ও সন্তান প্রসব হলে লোকলজ্জার ভয়ে গোপনে তা ফেলে দিয়েছিল। আর অনেকে অন্ধকার ভবিষ্যৎ দেখে আত্মহত্যা করেছিল। অনেকেই হয়তো মনে করেছিল আত্মহত্যার মতো মহাপাপের পথ বেছে না নিয়ে তারা একাই চলতে পারবে। হয়তো তাদের দুঃখ সে সময়ের বাস্তবতা সমাজ মেনে না নিলেও পরিবার-পরিজন ঘৃণাভরে হলেও মেনে নেবে। হয়তো সন্তানরা তাদের মায়েদের ব্যথা উপলব্ধি করে এক সময় মধুর ডাক মা বলে ডাকবে। শুধু আমাদের দেশেই নয় সারাবিশ্বে যুদ্ধের সময় নির্যাতিত, নিপীড়িত নারীদেরই একতরফা দোষ দেওয়া হয়। নারী হয়ে জন্ম নেওয়া এবং বীরাঙ্গনা হওয়ারই তাদের একমাত্র অপরাধ। এর মধ্যে কোনো মা বেদনায় কুঁকড়ে ওঠা পেটের অবৈধ সন্তান নিয়ে রাস্তার পাশে, রেলের বস্তিতে, লোকালয় থেকে দূরে, নিজ এলাকা থেকে অন্যত্র গিয়ে অথবা সরকারি খাসজমিতে গিয়ে একটু আশ্রয় নিয়েছিল।

শীতের দিনে প্রচন্ড ঠান্ডায় বুকের উষ্ণতা দিয়ে, মায়া-মমতার আর্দ্রতা দিয়ে, অজানা শঙ্কা দিয়ে সন্তান জন্ম দিয়েছেন। পরে সেই সন্তান নিজের জন্মপরিচয় বা পিতৃপরিচয় জানতে না পেরে বা বুঝতে পেরে চির দুঃখিনী বা জনম দুঃখিনী মাকে ফেলে দূরে পালিয়ে গেছে। তবে চলে যাওয়ার আগে দিয়ে যায়নি দশ মাস দশ দিনের পেটে রাখার ভাড়া।

মাতৃজঠরে বহনের খরচ, মাতৃক্রোড়ে বা বুকের সঙ্গে জাপটে ধরা ভালোবাসার দাম। নিজে অর্ধাহারে, অনাহারে থেকে, অর্ধমৃত বা প্রায় মৃত শরীরে বা মুখে নিজে খাবার না দিয়ে তাদের খাওয়ানোর মূল্য। দিনে ও রাতে একাকী সেবা করার পরিশ্রমের ফল আর জন্মের সময়ের পৃথিবীর সবচেয়ে মরণযন্ত্রণা প্রসব ব্যথার উপহার। ধর্ষিত বা নির্যাতিত নারীর সংখ্যা নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। সে সময় বিদেশি প্রতিবেদনে এ সংখ্যা ১০ লাখের মতো বলা হয়েছে।

ইতিহাসবিদ ডক্টর মুনতাসীর মামুন তার ‘বীরাঙ্গনা-১৯৭১’ শীর্ষক গবেষণায় দেখিয়েছেন যে এ সংখ্যা আনুমানিক ৬ লাখের কাছাকাছি। দৈনিক বাংলার বাণী পত্রিকায় ১৯৭২ সালে প্রকাশিত অস্ট্রেলিয়ান ডা. জিওফ্রে ডেভিসের প্রতিবেদন হতে নির্যাতিত নারীর সংখ্যা সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যায়।

তিনি নির্যাতিত নারীদের সেবাদানের জন্যই বাংলাদেশে এসেছিলেন। তার মতে মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিতা নারীর সংখ্যা চার লাখের কম নয়। এই হিসাবের তিনি একটি পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দিয়েছেন- ধর্ষিতাদের চিকিৎসার জন্য ফ্রেব্রম্নয়ারি মাসে ঢাকায় একটি হাসপাতাল স্থাপন করা হয়। সরকারি কর্মচারীদের হিসাব মতে, ধর্ষিতা মহিলাদের আনুমানিক সংখ্যা ২ লাখ।

ডা. ডেভিস বলেন, অন্তঃসত্ত্বা মহিলার সংখ্যাই ২ লাখ। অন্তঃসত্ত্বা মহিলাদের সাহায্য সংক্রান্ত কর্মসূচি শুরু হওয়ার আগেই দেড় লাখ থেকে ১ লাখ ৭০ হাজার মহিলা গর্ভপাত করেছেন। অবশিষ্ট ৩০ হাজারের মধ্যে কেউ কেউ আত্মহত্যা করেছেন, কেউ কেউ তার শিশুদের নিজের কাছে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কিন্তু হানাদার বাহিনী গ্রামে গ্রামে হানা দেওয়ার সময় যেসব তরুণীকে ধর্ষণ করেছে তার হিসাব রক্ষণে সরকারি রেকর্ড ব্যর্থ হয়েছে।

পৌনঃপুনিক লালসা চরিতার্থ করার জন্য হানাদার বাহিনী অনেক তরুণীকে তাদের শিবিরে নিয়ে যায়। এসব রক্ষিত তরুণীকে অন্তঃসত্ত্বার লক্ষণ কিংবা রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে, হয় তাদের পরিত্যাগ করা হয়েছে নয় তাদের হত্যা করেছে।

সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ তথা হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি স্বাধীনতার মহানায়ক দূরদৃষ্টিসম্পন্ন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘বীরাঙ্গনাদের যে তালিকা তৈরি করা হয়েছে তা বিনষ্ট করে ফেলুন কারণ সমাজ এদের গ্রহণ করবে না।’ তিনি বুঝতে পেরেছিলেন মুক্তিযুদ্ধ হলেও সমাজের মূল কাঠামোর কোনো পরিবর্তন হয়নি। তবে নির্যাতিত নারীদের পুনর্বাসনের জন্য তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।

বীরাঙ্গনাদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, ‘সন্তানদের বাবার নামের জায়গায় তার নাম এবং ঠিকানা ৩২ নম্বর ধানমন্ডি লিখে দিও।’ দীর্ঘ ৫০ বছরে রোগে, শোকে, অন্তর্জ্বালায় জর্জরিত জীবন প্রদীপ কারও নিভে গেছে, কারও বাকি আছে। তাদের আছে বুকভরা হাহাকার, নেই প্রিয়জনের সঙ্গে অভিমান বা খুনসুঁটি। এখনো আছে সোহাগপুর বিধবা পলস্নী, নেই তাদের সংসার। তাদের চোখ আছে, অশ্রম্ন নেই। কলাগাছের মতো শুকনা শরীর আছে, শক্তি নেই।

কিশমিশের মতো গাল আছে, সৌন্দর্য নেই। মুখে ঠোঁট আছে, বলার ভাষা নেই। নেই তাদের সামাজিক মর্যাদা ও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। দুঃখিত ভুল করলাম। বর্তমান সরকারপ্রধান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ২৯ জানুয়ারি ২০১৫ মহান জাতীয় সংসদে বীরাঙ্গনাদের মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দিয়ে প্রস্তাব পাস হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৬ই সেপ্টেম্বর ২০১৫ জারিকৃত প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় ৪১ জন বীরাঙ্গনাকে প্রথম মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি দিয়ে গেজেট প্রকাশ করে পরে ধাপে ধাপে আজ পর্যন্ত মোট বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ৪৩৮ জন (চলমান)। এ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নির্যাতিত বীরাঙ্গনাদের প্রথমবারের মতো মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হলো। যা নারী জাতির জন্য বা মানব জাতির জন্য শ্রেষ্ঠ উপহার।

নির্যাতিতকে রাষ্ট্রীয় সম্মান দেওয়ায় তিনিও আন্তর্জাতিকভাবে সম্মানিত হচ্ছেন। অন্যকে সম্মান দিলে নিজেও সম্মানিত হওয়া যায়। এটাই তার জ্বলন্ত প্রমাণ। পরিশেষে মহিমান্বিত মুক্তিযুদ্ধের সময় সব মৃত ও জীবিত বীরাঙ্গনাদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা এবং তাদের প্রত্যাশিত জীবনের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য কামনা করছি। সম্মানিত পাঠক এবং বিবেকবানদের প্রতি অনুরোধ করছি যে কোনো সময় অথবা সামাজিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে নারী জাতির সম্মান যেন আর হানি না হয়।

ভুবন বিখ্যাত শিল্পী সাবিনা ইয়াসমিনের কণ্ঠে দেশাত্মবোধক গানের একটা কলি লিখে শেষ করছি ‘চোখ থেকে মুছে ফেল অশ্রম্নটুকু, এমন খুশির দিনে কাঁদতে নেই, হারানো স্মৃতির বেদনাতে, একাকার করে মন রাখতে নেই,..।’

তথ্যসূত্র : অনলাইন